এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে - ৬ষ্ঠ পর্ব

Submitted by WatchDog on Tuesday, January 12, 2010

পূর্ব প্রকাশের পরঃ

বলিভিয়ায় ৭ দিন ধরে সাধারণ ধর্মঘট চলছে খবরটা নিশ্চয় কুস্‌কো এবং লিমার ট্রাভল এজেন্টদের জানা ছিল, অথচ টিকেট বিক্রীর সময় প্রসংগটা নিয়ে কেউ কথা বলেনি। মনটা খারাপ হয়ে গেল অনিশ্চয়তার গ্যড়াকলে আটকে গিয়ে। হোটেল কাউন্টারে খোজ নিয়ে ধর্মঘটের বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম। বেশ ক’দিন ধরেই ধর্মঘট চলছে। বলিভিয়া শুধু দক্ষিন আমেরিকারই নয় বরং পৃথিবীর অন্যতম গরীব দেশ। ক্ষমতা নিয়ে দুটি রাজনৈতিক দল এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে কাড়াকাড়ির ফলে এ দেশটি ইতিমধ্যে সামরিক অভ্যুত্থানে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মর্যাদা লাভ করেছে। দারিদ্র এবং র্দুনীতির ভীত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কতটা শক্ত মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের পাশাপাশি বলিভিয়াও তার বাস্তব প্রমান। ৯ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের কোন কমতি নেই, অথচ র্দুনীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার মান একেবারেই অমানুষিক। ট্রেড ইউনিয়ন গুলো এ যাত্রায় দু’টো দাবি নিয়ে হরতাল করছে; এক, তেলের দাম কমাতে হবে, দুই, প্রাকৃতিক গ্যাসকে জাতিয়করন করতে হবে। এ নিয়ে সরকার এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো একে অপরের মূখোমুখি দাড়িয়ে, কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজী নয়। দেশটার সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যাচাই না করে ভ্রমন করার পরিকল্পনার জন্যে নিজকে ছাড়া অন্য কাউকে দায়ী করতে পারলামনা। হোটেল ম্যানেজার জানাল যেতেতু কাল শনিবার হয়ত ধর্মঘট কিছুটা শিথিল হতে পারে, এবং এমনটা হলে তারা যেভাবেই হোক আমাকে একটা বাসে উঠিয়ে দেবে। কিছুটা আশান্নিত হয়ে রাতের খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে গেলাম।

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, সাথে শক্ত তামাটে পাথরের রাস্তাগুলো হাল্কা নিয়ন আলোতে এক ধরনের ভৌতিকতা সৃষ্টি করছে যা হলিউডের ভৌতিক ছায়াছবির কথাই মনে করিয়ে দেয়। প্রচন্ড শীত, পথচারীদের সবার মুখ বিভিন্ন কারুকার্যের চাদরে ঢাকা। দু’কান ছড়িয়ে দু’দিকের ল্যাজ সহ মাথার টুপি ছোটবেলায় দেখা দক্ষিন আমেরিকার ছায়াছবির যেন বাস্তব প্রতিফলন। সবকিছু ছাপিয়ে চেহারার যতটুকুই বেরিয়ে আসছে তাতে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেচে থাকার কঠিন ছাপ। এক টুকরো কাপড়ে সন্তানদের পিঠে ঝুলিয়ে মহিলাদের পথচলা অবচেতন মনে কল্পনা করলে ভ্যান গগের কোন অসমাপ্ত ছবির দৃশ্যপট মনে করিয়ে দেবে। শহরের রাস্তাগুলো সাগরের ঢেউয়ের মত উচু নীচু, সাপের মত আকাবাকা। কিছুদূর হাটলেই হূদ কম্পনে দাপাদাপি শুরু হয়, পা জড়িয়ে আসে। সমুদ্রপৃষ্ট হতে এত উচুতে আছি চাইলেও তা ভূলে যাবার নয়। দু’তিন ব্লক হাটতেই ’পইয়্যো লা ব্রাসা’ নামের হোটেলটা চোখে পরল। পয়্যো লা ব্রাসা, অর্থাৎ ফ্রাইড চিকেন। দক্ষিন আমেরিকার দেশে দেশে ফ্রাইড চিকেনের এত কদর চোখে না দেখলে তা বিশ্বাষ করা মুস্কিল। সুইং দরজা ঠেলে ভেতিরে ঢুকতেই অন্য এক পুনোর চেহারা ফুটে উঠল, গিজ গিজ করছে খদ্দেরের ভীড়ে। ধোয়া এবং ভাজা মুরগীর গন্ধে চারদিক মৌ মৌ করছে। কিছুক্ষন অপেক্ষা করতেই এক তরুনী এগিয়ে এল, হাসিমূখে অভ্যর্থনা জানাল। সাধারণ মানের হোটেল, চেয়ার-টেবিলে দৈন্যতার ছোয়া। কিন্তূ চারপাশের মানুষগুলোর খাওয়ার ভেতর কোন ফাক ফোকর খুজে পেলামনা, ওরা খাচ্ছে আর জীবনকে উপভোগ করছে নিজের মত। জোড়া জোড়া তরুন তরুনী টেবিলে খাবার ভূলে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে। মা-বাবা সন্তানাদি নিয়ে উপভোগ করছে রাতের খাবার। চারদিকে চ্যাচাম্যাচি হৈ চৈ। অর্ডার নিতে আগের সে তরুনী এগিয়ে আসতেই দমে গেলাম, কি ভাবে অর্ডার করব, নিশ্চয় সে ইংরেজী জানেনা আর আমারও স্প্যনিশের দখল যথেষ্ট নয়। সমস্যা হল, পেরুভিয়ানদের অনেকের চেহারাই আমাদের মত, এবং আমাকে তাদেরই একজন ভেবে তরুনী গলগল করে স্প্যনিশ বলে গেল। মুচকি হেসে জবাব দিলাম, ‘ইয়ো ন হাবলা স্প্যনিয়ল‘। চোখ বড় করে হো হো করে হেসে উঠল। আমি স্প্যনিশ জানিনা এমনটা সে মোটেও আশা করেনি, বাকা একটা হাসি দিয়ে হারিয়ে গেল খদ্দেরের ভীড়ে। কিছুক্ষন পর ফিরে এল ততোধিক সুন্দরী এক তরুনী সাথে নিয়ে। ’ম্যা আই হেল্প ইউ সিনয়্যর?’ হাতে চাদ পেলাম যেন, কোয়ার্টার চিকেন, পটেটো ফ্রাই এবং ইন্‌কা কোলার অর্ডার দিয়ে আলাপ শুরু করলাম তরুনীর সাথে। আমি নিউ ইয়র্ক হতে এ অঞ্চলে এসেছি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করল, আমার অবস্থা খুলে বলতেই শান্তনা দিতে চাইল। তৈলাক্ত খাবার, বেশী খাওয়া গেলনা। সবশেষে এককাপ ধূমায়িত কফি নিয়ে অনেকক্ষন পর্যবেক্ষন করলাম পৃথিবীর এ অঞ্চলের সাধারণ মানুসের জীবন। আমাদের জীবন হতে খুব কি একটা তারতম্য? মনে হলনা! আশাতীত টিপস্‌ পেয়ে তরুনীর সাদা চেহারা একেবারে লাল হয়ে গেল। মুচকি হেসে দরজা পর্য্যন্ত এগিয়ে দিল, ‘পরের বার আসলে ওয়েন্ডিকে খোজ কর‘, শুভরাত্রি জানিয়ে আবারও হারিয়ে গেলাম আলো আধারে ভরা ভুতুরে শহরে।

কুয়াশার চাদরে ঢাকা এন্ডিসের চূড়াগুলো দিগন্তরেখায় খুজে পেতে কষ্ট হল, নিকষ কালো অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে সবকিছু। রাস্তায় মানুষের সংখ্যাও বিপদজনকভাবে কমে গেছে। উদ্দেশ্যবিহীন আরও কিছুটা পথ হাটাহাটি করার সিদ্বান্ত নিলাম। এ ফাকে মনটাও বেশ হাল্কা হয়ে এল, ক্ষতি কি আগামীকাল যদি বলিভিয়া যাওয়া না হয়! আর সময়মত নিউ ইয়র্ক ফিরে না গেলে চাক্‌রীটা চলে যাবে এইত! তাতে কি এমন মহাভারত অশুদ্ব হয়ে যাবে ভেবে পেলামনা, চাকরী আরেকটা খুজতে হবে এই যা। মনে মনে ছক আকা শুরু করলাম আগামীকালের। নৌকায় করে লেক টিটিকাকা দিয়ে লা পাস যাওয়ার চিন্তাও মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল। সত্যি বলতে কি এমন একটা অনিশ্চয়তা হঠাৎ করেই ভাল লাগতে শুরু করল।

শহরে বিদ্যুতের আসা যাওয়া এই প্রথম খেয়াল করলাম। রাস্তার বাতিগুলো নিভে গেল বিনা নোটিশে। ভুতের বিশ্বাষ থাকলে হয়ত সামনে যাওয়া হতনা, হঠাৎ করে বাইসাইকেলের আওয়াজে পিলে চমকে উঠল। সামনে একটা কাঁচা বাজারে আলোর দেখা পেয়ে ঢুকে গেলাম। বিক্রেতার দল সাড়ি সাড়ি পন্য সাজিয়ে বসে আছে শেষ খদ্দেরের আশায়। টিমটিম করে কেরোসিনের কুপি জ্বলছে প্রতিটি দোকানে। বয়সের ভারে নূয্য দোকানীর দল একই সাথে মসলার পাশাপাশি গিনিপিগ এবং শুয়রের মাংস বিক্রী করছে। উদভ্রান্তের মত হাটাহাটি করলাম কিছুক্ষন। এমন একটা বাজারের সাথে কেন জানিনা ’৭১’এ দাদাবাড়িতে দেখা কাচা বাজারের মিল খুজে পেলাম। দু’টো প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও কোথা যেন যুগসূত্র ছিল। রাত বাড়ছিল দ্রুত, এবার হোটেলে ফিরে যাওয়ার পালা।

লেক টিটিকাকার পাড় ঘিরে হাটাহাটি শেষে হোটেলে ফিরতেই খবরটা পেলাম। খুব ভোরে দু’টো বাস যাচ্ছে লা পাস, আমিও একটা বাসের যাত্রী হতে যাচ্ছি। ভ্রমনটা হবে খুবই রিস্কি, শেষ পর্য্যন্ত গন্তব্যে পৌছাতে পারব কিনা তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। আমাকে সকাল ৫টার ভেতর তৈরী থাকতে হবে। খবরটা শুনে কেন জানি মনটা বিষন্ন হয়ে গেল, এতক্ষন ধরে আকা কল্পনাগুলো শুধু কল্পনা হয়েই থাকবে হয়ত এ জন্যে। এক কাপ ককো টি কোন রকমে গিলে বিছানায় ঝাপিয়ে পরলাম। এবারের যাত্রা কোপাকাবানা হয়ে বলিভিয়ার রাজধানী লা পাস।

- চলবে


ভালো লাগলে শেয়ার করুন