এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে - ৮ম পর্ব

Submitted by WatchDog on Wednesday, October 7, 2009

Andes Mountains - South America

প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ঠিকঠাক হয়ে বসতেই ড্রাইভার জানাল দুঃসংবাদটা, আমরা কোপাকাবানা হয়ে লা পাস যাচ্ছিনা। ও পথটা ধর্মঘটকারীদের দখলে চলে গেছে। রক্তারক্তির খবরও নাকি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। অজানা আশংকায় মনটা অস্থির হয়ে উঠল, এমন একটা ঘোলাটে পরিবেশে ঠিক হচ্ছে ত বলিভিয়া যাওয়াটা! কোপাকাবানা নামটার সাথে অনেক দিনের পরিচয়, বেশ ক’টা বিখ্যাত স্থাপনা আছে দেখার মত। ১৬০০ শতাব্দীর স্প্যনিশদের তৈরী Basilica of Our Lady of Copacabana পর্য্যটকদের কাছে খুবই পরিচিত নাম। গির্জাটা দেখতে পর্য্যটকের দল মৌমাছির মত ভীড় জমায় পৃথিবীর এ কোনায়। তা ছাড়া লেক টিটিকাকার তীরে এটাই বলিভিয়ার মূল শহর। শহরটার সৌন্দর্য্য নিয়ে ভ্রমন দুনিয়ায় অনেক উপকথা চালু আছে। লম্বা দীর্ঘশ্বাষ ফেলে দূর করলাম কোপাকাবানা না দেখার দুঃখ। ৩০ মিনিটের ভেতর পেরু-বলিভিয়ার সীমান্ত শহর দেসাগুয়াদে্‌র পৌছে গেলাম। নড়বড়ে একটা কাঠের সেতুর সামনে এসে বাসটা থেমে গেল, এখানেই পেরুর শেষ। সেতুর ওপারে বলিভিয়া। অন্য একটা বাস ধরতে হবে সীমান্তের ওপার হতে, বলিভিয়ান বাস। ’তুমি কি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক’, প্রশ্ন করল আমার সহযাত্রী ভিক্টোরিয়া। ’না, আমি অষ্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টে ভ্রমন করছি, অবশ্য নিউ ইয়র্ক ফিরে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের শপথ নিতে যাচ্ছি’ উত্তর দিয়ে কারণ জানতে চাইলাম এমন প্রশ্নের। ভিক্টোরিয়া জানাল, পৃথিবীর এ অঞ্চলে মার্কিন পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমন খুব একটা নিরাপদ নয়। বলিভিয়ান এন্ডিসের অনেক বিপদজনক বাক আছে, যেখানে ওৎ পেতে থাকে অপহরনকারীর দল। অপহরন ব্যবসায় মার্কিন নাগরিকদের চাহিদা নাকি সবার শীর্ষে। আমার জ্যাকেটে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা সম্বলিত একটা পিন দেখে ভিক্টোরিয়া অনুরোধ করল খুলে ফেলার জন্যে। এসব শুনে একেবারেই হতাশ হয়ে পরলাম, এলাম নতুন কিছু দেখব বলে অথচ পদে পদে দেখছি ভয়ঙ্কর সব বাধা। হা হা করে হেসে উঠল মেয়েটা, বুঝতে পারল আমার মনের অবস্থা। ’ভয় পেওনা, এ গুলোই কিন্তূ এন্ডিস দেখার আনন্দ, তাছাড়া তোমার চেহারা অনেকটাই বলিভিয়ানদের মত, বিপদ আসলে মিশে যেও ওদের ভীড়ে’, বলতে গিয়ে হাসিতে ফেটে পরল সে। এমন বিপদজনক সুন্দরী যদি ৬ মাস এন্ডিসের বাকে বিচরনের পরও জীবিত থাকে, তা হলে আমার কেন বিপদ হবে, এমন একটা সমীকরনের ফলাফল বের করে নিজেই নিজকে আস্বস্ত করলাম।

andes mountains

বাস হতে বেরুতেই এন্ডিসের ঠান্ডা বাতাস শরীরে কাপুনী ধরিয়ে দিল। ইতিমধ্যে জেগে উঠেছে সীমান্ত এলাকার জনপদ, চারদিক গিজগিজ করছে মানুষের ভীড়ে। ভ্যান গাড়ি, সাইকেল, অটো রিক্সা, বাস, ট্রাক, হরেক রকম যানবাহন আর পায়ে হেটে হাজার হাজার মানুষ অতিক্রম করছে দুই দেশের সীমান্ত। চারদিকে মনে হল ধূলিঝড় বইছে যেন। মাঝ খানে কয়েক শ ফুট নো ম্যানস্‌ ল্যান্ড। শ্রীহীন ছোট্ট একটা ছাপড়া ঘরে ঢুকতে হল পাসপোর্টে পেরুর এক্‌জিট সীল নেয়ার জন্যে। অভিব্যক্তিহীন চাউনিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল ইমিগ্রেশন অফিসার, দপাস শব্দে বসিয়ে দিল সীলটা। ’আডিওস‘, যান্ত্রিক পুতুলের মত উচ্চারন করল বিদায় বানী।

নো ম্যানস্‌ ল্যান্ডে দাড়াতেই শিরদাড়া বেয়ে অন্যরকম একটা অনুভূতি নেমে গেল। আমি এখন কোন দেশে? চোখের সামনে বলিভিয়া আগমনের শুভেচ্ছা, পিছন ফিরে তাকালেই দেখা যাচ্ছে পেরু ভ্রমনের ধন্যবাদ বানী। এই মুহুর্তে আমার কোন দেশ নেই! ভাবতেই মনে হল এ কয়েক শ ফুটের আমিই অলিখিত বাদশাহ্‌। এখানে নেই কোন ইমিগ্রেশন, নেই পুলিশের বাকা চাউনি। প্রফুল্ল মনে দূরত্বটুকু পার হলাম।

andes mountains

বলিভিয়া! অফিসিয়াল নাম প্লুরিন্যাশনাল ষ্ট্যেইট আব বলিভিয়া। কোন সমুদ্র বন্দর ছাড়াই মধ্য দক্ষিন আমেরিকার একটি দেশ। দেশটার পূব এবং উত্তর দিকে ব্রাজিল, দক্ষিনে প্যরাগুয়ে এবং আর্জেন্টিনা, পশ্চিম দিকে চিলি এবং পেরু। ১৬ শতাব্দীতে স্প্যনিশরা দক্ষিন আমেরিকার অনেক দেশের মত এ দেশটিতেও নিজদের প্রভূত্ব কায়েম করে। ১৬ বছর এক নাগাড়ে যুদ্বের পর ১৮০৯ সালে নিজদের স্বাধীন বলে ঘোষনা দেয় বলিভিয়ানরা। কবর রচিত হয় উপনিবেশবাদের। সাইমন বলিভারের নামে দেশটার নাম রাখা হয় বলিভিয়া। উপনিবেশবাদের বিদায় হলেও তাদের স্প্যনিশ ভাষাকে বিদায় জানাতে পারেনি এ দেশের মানুষ। যদিও শত বাধা বিপত্তি নিয়ে এখনো টিকে আছে এদের আঞ্চলিক ভাষা আয়মারা এবং কোয়েচুয়া। জনসংখ্যা মাত্র ৯০ লাখ।

andes mountains

কালো পোশাক এবং হাতে কালাশনিকভ রাইফেল নিয়ে সামন্য ক’জন পুলিশ পাহাড়া দিচ্ছে সীমান্ত এলাকা। নিজদের মধ্যেই গল্পে নিয়ে ব্যস্ত ওরা, সীমান্ত পেরিয়ে কে এল আর কে গেল তার দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। আমাদের দেশে টোল আদায়ের ঘরগুলোর মত ছোট্ট একটা বুথে ঢুকতে হল বলিভিয়ার ভিসা নিতে। ইমিগ্রেশনের সাথে একটা শব্দও বিনিময় হলনা, ৩ মাসের ভিসা দিয়ে আমন্ত্রন জানানো হল দেশটায়। দাত বের করা হাসিতে গ্রাসিয়াস জানিয়ে পা রাখলাম আরও একটা নতুন দেশে, বলিভিয়া। কয়েক শ ফুট দূরেই দক্ষিন আমেরিকার অন্য একটা দেশ পেরু, অথচ পার্থক্য চোখে পরার মত। চারদিকে অনিয়ম আর দৈন্যতার রাজত্ব এখানে। ঠেলা রিক্সা, ভ্যান গাড়ি আর স্কুটারগুলো রাস্তা আটকে অপেক্ষা করছে যাত্রীর। একে অপরকে গালাগালি দিচ্ছে চড়া গলায়। আমাদের আরিচা ঘাটের মত ট্রাক আর বাসের কাফেলা দাড়িয়ে আছে সাড়িবদ্বভাবে। কিন্তূ ড্রাইভারদের আশপাশ কোথাও দেখা গেলনা। আবারও অজনা আশংকায় মনটা কেপে উঠল। পুনো হতে ছেড়ে আসা বাস যাত্রীদের একটা জায়গায় জমা হতে দেখে ওদিকেই পা বাড়ালাম। সহযাত্রী ভিক্টোরিয়া আমাকে দেখে বত্রিশ দাত বের করে হাসল। তার পরনের কাপড় আরও বিপদজনকভাবে কমে গেছে ইতিমধ্যে। অবাক হওয়ার মত কান্ড, এ সবের সময় পেল কখন মেয়েটা! অপেক্ষার যেন শেষ নেই। বাস আসার কোন লক্ষন দেখা গেলনা। চিন্তার রেখা ফুটে উঠল লা-পাসগামী যাত্রীদের কপালে। ঘন্টাখানেক পর ট্যুর কোম্পানীর একজন এসে জানাল রাস্তায় প্রচন্ড হাংগামা চলছে, এক সপ্তাহ হল এ লাইনে বাস চলাচল বন্ধ। বাধা পেরিয়ে দু’একটা নাকি বাস চেষ্টা করেছিল লা-পাস পৌছার, কিন্তূ হরতালকারীদের তাড়া খেয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। সরকার এবং দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে টানপোড়ন চলছে, তাই অনির্দিষ্ট কালের এই হরতাল। । পিন পতনের নীরবতা নেমে এল যাত্রীদের মাঝে। আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল একটাই চিন্তা, আজ শনিবার এবং আমাকে সোমবার মধ্যরাতে লিমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে। ভিক্টোরিয়ার অট্ট হাসিতে চিন্তায় ছেদ পরল। ‘এতটা হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই, উপায় একটা নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে’, ফুড় ফুড়ে মেজাজে বল্‌ল সে। খুব কাছে এসে ফিস ফিস করে বল্‌ল, অতিরিক্ত কিছু পয়সা ঢালতে হবে আমাদের, তবেই নাকি হারামীর বাচ্চারা নড়তে শুরু করবে। মেয়েটার এমন আজব তথ্যে অবাক হলাম আমি, এ যে দেখছি বাংলাদেশের কার্বন কপি! ১০ ডলার করে চাঁদা উঠানো হল যাত্রীদের কাছ থেকে। সবাই বিদেশী, এ নিয়ে কেউ বেশী উচ্চবাচ্য করলনা। মনে মনে ট্যুর কোম্পানীর ১৪ গুষ্টি উদ্বারের মধ্যেই সীমাবদ্ব থাকল যাত্রীদের ক্ষোভ। যাত্রী ড্রাইভারের মধ্যে গোপন শলা-পরামর্শ এবং লেনা-দেনা শেষ হওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে ছোট আকারের দু’টা বাসকে দেখা গেল দিগন্ত রেখায়। একই কোম্পানীর বাস, একেবারে যমজ ভাইয়ের মত। কিছু খাবার আর পানের জন্য দু বোতল পানি কিনে উঠে পরলাম একটা বাসে। ভিক্টোরিয়া আগেই উঠে গেছে এবং জানালার পাশের একটা সীট দখল নিয়ে অপেক্ষা করছে আমার। ধন্যবাদ জানিয়ে বসে পরলাম। ‘তোমাকে জানাইনি আতংকিত হবে বলে, রাস্তার অবস্থা কিন্তূ আসলেই খারাপ, সব কিছুর জন্যে তৈরী থেক।’, বাসটা ছাড়তেই দুঃসংবাদটা দিল ভিক্টোরিয়া।

-চলবে

ছবিগুলো ধার করা।


ভালো লাগলে শেয়ার করুন