এন্ডিস পর্বত মালার বাঁকে বাঁকে - ১৩তম পর্ব

Submitted by WatchDog on Friday, October 16, 2009

Andes Mountains - South America

আবারও অনিশ্চয়তা! কুফা যেন পিছু ছাড়ছেনা কিছুতেই। একদিনে এত ঝামেলা সয্য করার জন্যে চাই বায়োনিক শরীর! মাছে ভাতে বাংগালীর শরীর এমন বিরামহীন হাংগামার জন্যে মোটেও তৈরী নয়, এ সহজ সত্যটা আগেই বোধহয় বুঝা উচিৎ ছিল। অস্থিরতা ধীরে ধীরে হতাশায় পরিনত হল। হাতের লাগেজটা মাটিতে বিছিয়ে জিন্দালাশ হয়ে বসে পরলাম খোলা আকাশের নীচে। সূর্য্যটা বিদায় নিয়েছে অনেকক্ষন হল। একদিকে হায়েনার মত এন্ডিসের বিশাল চূড়া, বিপরীত দিকে লাখ লাখ নিয়ন বাতির রহস্যময় ’লা পাজ’ নগরী, এ যেন কল্পরাজ্যের স্বপ্নপূরীর মত, চোখে দেখা যায় কিন্তূ কাছে যাওয়ার উপায় নেই! যমজ বাসটাকে দেখা গেল বেশ কিছুক্ষন পর। ক’জন যাত্রী উঠিয়ে ওটাও চলে গেল একই কথা বলে। মহিলাদের প্রাধান্যের কারণে আমার জায়গা হলনা এ যাত্রায়। তীর্থের কাকের মত বসে রইলাম পরবর্তী বাসের আশায়। প্রায় ৪০ মিনিট পর থামল দ্বিতীয় বাস্‌টা। এবার মিস হলে হয়ত সাড়াটা রাত এখানেই কাটাতে হতে পারে, তাই পরি মরি করে উঠে পরলাম। বসার জায়গা নেই, গাদাগাদি করে কোন রকমে দাড়িয়ে রইলাম লাগেজটা হাতে নিয়ে। যে সমস্যার কথা ভেবে এতক্ষন উৎকণ্ঠিত ছিলাম এসে গেল সেই মহেন্দ্রক্ষন, বাস কন্ডাক্‌টর জানতে চাইল, কোথায় যাচ্ছি আমরা? একজন আরেকজনের দিকে তাকাই, কিন্তূ কারও মুখে কোন উত্তর পাওয়া গেলনা। সাহষকরে আমিই বল্‌লাম, সানফ্রানসিস্‌কো প্লাজা! ট্যুর গাইডের মুখে উচ্চারিত নামটা মাথায় গেথে গিয়েছিল, সময় মত মনে করতে পারায় সহযাত্রীরা প্রশংষার দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। ভাড়া পরিশোধ করতে হল ডলারে, এক ডলার সমান কত বলিভিয়ানো আর কতই বা গন্তব্যস্থলের ভাড়া তার কোন ধারণা না থাকায় ৫ ডলার নোটের সবটাই রেখে দিল ভাংতির অযুহাতে। এ সব নিয়ে চিন্তিত হওয়ার মত মানষিক অবস্থা ছিলনা কারও। শুধু তজ্‌বী গোনার মত বেহুস হয়ে গুনছিলাম অন্তিম মুহুর্তের। এবং শেষ পর্য্যন্ত এল সেই মুহুর্ত। বাস কন্ডাকটারদের কেউ একজন প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে ছুড়ে ফেল্‌ল বাস হতে, লাগেজটাও ছিট্‌কে পরল হাত হতে।

ব্যাগটা কুড়িয়ে সোজা হয়ে চারদিক চোখ ফেরাতে সহযাত্রীদের কাউকে খুজে পেলামনা কাছাকাছি। ওরা কেউ নামেনি আমার সাথে। মনটা দমে গেল নতুন আশংকায়। সানফ্রান্সিস্‌কো প্লাজা! প্লাজার বিশাল ঘড়িটায় ঢং ঢং করে ৯টা বাজার সময় সংকেত বেজে উঠল। ৪ ঘন্টার পথ ১৫ ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে শেষ পর্য্যন্ত দাড়িয়ে আছি লা পাজ শহরের কেন্দ্রস্থলে; ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন, বিষন্ন এবং বিধ্বস্ত! ধাত্বস্ত হতে ৫টা মিনিট কেটে গেল। এ ধরনের অমানুষিক অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম নয়। জার্মানীর বার্লিন শহর তখনও এক হয়নি। ঐতিহাসিক বার্লিন দেয়াল পার হয়ে পশ্চিম বার্লিনের জুওলঝিশিয়া গার্টেন ষ্টেশনে হাজির হয়েছি নেদারলেন্ডের হোক-ভ্যান-হলান্ড গামী ট্রেন ধরব বলে। শেষ গন্তব্য হারউইচ হয়ে লন্ডনের লিভারপুল ষ্টেশন। পূর্ব বার্লিনে অযথা ঘুরাঘুরির কারণে শেষ ট্রেনটা মিস হয়ে যায়। হোটেল ভাড়ার যথেষ্ট টাকা নেই হাতে, তাই ষ্টেশনে রাত কাটাবার সিদ্বান্ত নেই বাধ্য হয়ে। সেপ্টম্বরের শুরু, কনকনে শীত আর পুলিশের অত্যাচারে সাড়াটা রাত দৌড়ের উপর কাটাতে হয়। সকালের প্রথম ট্রেনটা ধরতে বেলা বেজে যায় ১১টা। সীটে বসতেই সমস্ত শরীর কাপতে শুরু করে দিল, জ্বর আসছে আমার!

ভেংগে পরলে চলবেনা, এখনও অনেক পথ পাড়ি দেয়া বাকি, নিজকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম! প্লাজায় ঠায় দাড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষন। কোনদিকে গেলে হোটেল মিলবে তার কোন হদিস করতে পারলামনা। হরেক রকম মানুষের ভীরে গিজগিজ করছে চারদিক। সাহস করে একজনকে জিজ্ঞাস করতে বাধ্য হলাম, ‘দন্ডে এস্তা এল হোতেল?‘। অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী সন্দেহ নেই, কিন্তূ এই অল্পতাই অনেক সময় বিশাল কাজে আসে, বিশেষ করে অজানা অচেনা ভাষার দেশে। কাজ হল এ যাত্রায়, আংগুল উচিয়ে দেখানোর চেষ্টা বুঝতে অসূবিধা হলনা আমার। হাটতে শুরু করলাম হোটেলের সন্ধানে। কয়েক গজ যেতেই রাস্তাটা ৪৫ ডিগ্রী কোন্‌ হয়ে উপরে উঠ্‌তে শুরু করল। জ্বিহ্‌বাকে জায়গামত ধরে রাখায় অসূবিধা দেখা দিল, ম্যারাথন দৌড়ের গতিকে পাল্লা দিয়ে হার্টবীটও বাড়তে থাকল। মূখের থুথুতে এই প্রথম লবনের অস্থিত্ব অনুভব করলাম। প্রথম হোটেলটা চোখে পরল কাইয়ে পতোসির উপর, ’হোটেল প্রেসিদেন্তে’। ভাগ্য এ যাত্রায় বিমূখ করল আমায়, সীট নেই একটাও। দূরে অন্য একটা হোটেলের সাইন দেখে আশান্বিত হয়ে রওয়ানা দিলাম সে দিকে। আরও অনেক উপরে উঠতে হবে। শরীরের শেষ শক্তি ব্যায় করে হোটেল দরাজায় হাজির হতেই দেখি দরজা বন্ধ! প্রচন্ড শব্দে নক করে ইয়া নফ্‌সি ইয়া নফ্‌সি ঝপতে থাকলাম। কেউ এগিয়ে এলনা, ঘুসি মারতে বাধ্য হলাম এবার। রাজ্যের ক্ষুধা মগজের চিন্তা শক্তিকে গ্রাস করে নিয়েছে ইতিমধ্যে। খুট করে ছোট বুথের মত জানালা খুলে উকি দিল কেউ একজন। ’সিনিওরা, উস্তেদ হাবলা ইংলেজ?’ জিজ্ঞাস করলাম আমি। অন্য একজন মাথা বের করে জানাল ’পকি্‌ত‘, অর্থাৎ অল্প সল্প। সীট পাওয়া গেল ৬ তলায়, আলাদা বাথরুম। এটা আসলে একটা হোষ্টেল, ভাড়া মাত্র ৭ ডলার। হঠাৎ মনে হল পৃথিবীটা আসলে অতটা খারাপ নয় যতটা আমি ভাবছি!

’হোস্তাল নাইরা’, আসলেই নাইড়্যা (ন্যাড়া), ভেতরের সবকিছুতে অযত্ম, অবহেলা আর দারিদ্রের ছাপ। এলিভেটর নেই, তাই সিড়ি ভেংগে উঠতে হল ৬ তলায়। চাবি ঘুরিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করতে মাথায় আকাশ ভেংগে পরল, খুলছেনা দরজা! নীচে নামা এ মুহুর্তে অসম্ভব আমার পক্ষে, বসে পরলাম দরাজার সামনে। আধা ঘন্টা পর রুম সার্ভিসের একজনকে দেখা গেল নতুন গ্রাহকের সাথে উপরে উঠতে। হাউমাউ করে বুঝাতে চাইলাম আমার অবস্থা। সুন্দর একটা হাসি দিয়ে অপেক্ষা করতে বল্‌ল আমায়। আরও প্রায় ১৫ মিনিট পর প্রায় ৮০ বছরের এক বৃদ্বাকে দেখা গেল সিড়ি ভাংগছে, পাগলের মত হাপাচ্ছে সে। শেষ পর্য্যন্ত অন্য একটা রুমে ঠাই নিতে হল। ধবধবে সাদা বিছানা, রংগিন টিভি আর বড় মত আয়নাটা দেখে চোখে পানি আসার মত অবস্থা। হঠাৎ মনে হল আমার বিশ্বজয়ের এখানেই বোধহয় সমাপ্তি, এবার বিশ্রামের পালা।

শরীরে শুটকির গন্ধ, পরনের কাপড়ে দশ ইঞ্চি ধূলা, জুতা জোড়া বলছে এইমাত্র হালচাষ শেষে ঘরে ফিরেছি, এমন একটা অবস্থায় বিছানায় গেলে সহাসাই ঘুম ভাংগবেনা, তাই ঝকে ঝকে বিছানাটায় ঝাপিয়ে পরার লোভ সামলাতে হল জোড় করে। প্রথমত গোসল করতে হবে যে কোন মূল্যে, পেট শান্ত করাও জরুরী হয়ে পরেছে। প্রায়রিটি সেট করে প্রথমে গোসলখানায় ঢুকে পরলাম। আধা ঘন্টা মরার মত দাড়িয়ে রইলাম ঝরনাটার নীচে। গরম পানির উষ্ণ ছোয়ায় দিনের ক্লান্তি অনেকটাই কেটে গেছে মনে হল। পোশাক বদলে রাতের খাবারের সন্ধানে বাইরে যাওয়ার সিদ্বান্ত নিলাম। সিড়ি ভাংগা এখন আর ততটা কঠিন মনে হলনা। কিন্তূ সমস্যা দেখা দিল হোটেল ফটকে, বন্ধ হয়ে গেছে রাতের জন্যে। অল্প ইংরেজী জানা মহিলার দেখা পাওয়া গেল লবিতে। সাড়াদিন পেটে কিছু পরেনি জানতে পেরে তার চোখে মুখে মমতা ঝড়ে পরল। আমাকে সাথে নিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্যান্টিনটায় ঢুকে পরল। দশ মিনিটের ভেতর গরম স্যুপ, সিদ্ব আলু এবং সাথে মুরগীর ফ্রাই নিয়ে হাজির হতেই হায়েনার মত ঝাপিয়ে পরলাম প্লেটে। খাওয়া শেষ হতে মনে হল হাত-পা কাঁপছে আমার, চক্কর দিয়ে মাথাটাও ঘুরছে মনে হল। এক কাপ কফি নিয়ে মহিলা কখন পাশে দাড়িয়েছে টের পাইনি। ’খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে, উপরে যাও এবং ভাল করে ঘুমিয়ে নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে’, মা’র মমতা নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মহিলা। চোখ ঝাপসা হয়ে এল আমার। এবার ঘুমের পালা।

- চলবে


ভালো লাগলে শেয়ার করুন