সংগ্রামী

Submitted by Visitor (not verified) on Monday, March 15, 2021

সম্ভ্রান্ত এক গােড়া মুসলিম পরিবারে বিয়ে হয় আমার। স্বামী দশ দিন পরেই ফিরে চলে যায় কর্মস্থলে।

সউদিতে কর্মরত চার বছর পর পর সে দেশে আসে। আমি শ্বশুর শাশুড়ি ও তার ভাইবােনদের নিয়ে সুখে দিন কাটাতে লাগলাম। অল্প বয়স আমার । সুন্দর স্বামী প্রাপ্তি, সুন্দর পরিবার এবং আমি এতাে বেশি খুশি ছিলাম যে সব কিছুর ওপর স্বামীর সঙ্গ পাবার শূন্যতা ছাড়া আমার আর কিছুর অভাব থাকলাে না।

রােজ সারা দিনের সব কাজ সেরে গভীর রাতে তাকে চিঠি লেখা আমার জীবনে সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত বলে মনে করতাম। সারা দিনের সব কাজের ভার আমার ওপর দিয়ে তারাও নিশ্চিন্ত ছিল। আনন্দে তার আসার দিন গুণতাম। ভাের পাচটায় সবাই উঠতাম। নামাজ পড়ে সবার নাশতা বানানাে দিয়ে দিন শুরু হতাে আমার। ক্লান্তি ছিল না আমার। সুখী ছিল তারাও আমাকে নিয়ে।

রােজ তার চিঠি আসতাে। আমিও রােজ পােস্ট করতাম। আনন্দে ভাসতে থাকলাম। কিন্তু সুখ বড় ক্ষণস্থায়ী। আমার দেবর অর্থাৎ তাদের দ্বিতীয় সন্তানটি প্রায় আমারই বয়সী। হঠাৎ তার মধ্যে কু-প্রবৃত্তি নাড়াচাড়া দিল । সহানুভূতির ছলে ঘরে এসে যখন-তখন হানা দিতাে। ভয়ে আর দুর্ভাবনায় দিশাহারা হলাম।

সম্ভ্রান্ত পরিবারের মমতাময়ী মা-কে বাধ্য হলাম এক সময় খুলে বলতে। তিনি প্রথমে অবাক। পরে পরামর্শ দিলেন, সাবধানে থেকো। সব সময় ঘরে দরজা বন্ধ করে রেখাে । হালকা তিরস্কারও করলেন তার সেই সন্তানকে।

হয়তাে এটাই হলাে আমার ভুল। কুসন্তানটি ক্ষেপে উঠলাে। তার আসল চেহারা, তার মা-বাবা কেন জানলাে? জ্বালাতন বেড়ে গেল।

শ্বশুরও তাকে নিষেধ করলেন। কিন্তু সেই ভাইটি তার প্রবাসী বড় ভাইকে চিঠিতে কি জানালাে জানি না। প্রবাসের সেই সুন্দর ভালােবাসা ভরা চিঠি আসা বন্ধ হলাে।

আমাকে লেখার পরিবর্তে বাবা-মায়ের কাছে সে চিঠি লিখলাে, বের করে দাও ওই মেয়েকে আমার বাড়ি থেকে। যে বুকে মাথা রেখে আমি শান্তি পেতে চাই সেই বুক সে কি করে বাড়িয়ে দেয় আমার ছােট ভাইয়ের দিকে?

আমার কোনাে কথাই শােনা হলাে না। পরিবারের প্রথম ও প্রবাসী সন্তানের কথা রক্ষা হলাে। আমাকে বাপের বাড়িতে সেই রাতেই পাঠানাে হলাে। কাঁদলাম আর কাঁদলাম। যে মেয়েটি হেসে হেসে পরিবারের সকলের জন্য কাজকর্ম করতাে, এক নিমেষেই পরিবারের সবাই তার ওপর অনায়াসে মন উঠিয়ে ফেললাে। প্রবাসে যােগাযােগের চেষ্টা করলাম। যেকোনাে মফস্বল শহর থেকে চিঠি পােস্ট করলে বিদেশে সেই চিঠি যেতে সময় লাগতাে প্রায় এক মাস। ব্যর্থ হলাম তার সঙ্গে যােগাযােগ করতে সময় মতাে।

এরই মধ্যে তাদের এক দুঃসম্পর্কের চাচাতাে ভাই আমাদের বাড়ি বেড়াতে এলাে। ওদের ওখানে নয় মাস থাকার সময় ওই ভাইকে আসতে দেখেছি ওই বাড়িতে অনেকবার। হাসি-খুশি, প্রাণবন্ত ও ধনী মানুষ হিসেবে ওনাকে সবাই চিনতাে।

তিনি আমাদের বাড়িতে আসাতে প্রাণ ফিরে পাই। এসে কিছু কথার পর জানালেন যে, তিনি আমাকে নিতে এসেছেন। ওই সংসারে যাতে আমি ফেরত যাই সে জন্য তিনি সব রকম চেষ্টা করবেন।

তিনি প্রভাবশালী ছিলেন বলে সবাই ওনাকে মেনে চলতাে। আমারও মনে বিরাট আশা হলাে যে, আমার আর ভয় রইলাে না। আমরা সৈয়দপুর এয়ারপাের্টের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমার মা কাঁদলেন । আমি কাঁদলাম ।

দূরত্ব বেশি হওয়ায় এয়ারপাের্টে পৌছে দেখি প্লেন আমাদের আসার আগেই ছেড়ে দিয়েছে। তিনি একটুও হতাশ না হয়ে বললেন, চিন্তার কিছু নেই। চলাে ট্রেনে যাই। আমি তখন আসন্ন স্বামী হারানাের ভয়, সংসার হারানাের ভয় এবং ওই সংসারে ফিরে যাবার আনন্দে দিশাহারা।

আমরা সৈয়দপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠলাম দুপুরে। সন্ধ্যার পর ঘাটে এসে ট্রেন থামলাে। এরপর স্টিমার। এপারে আবার ট্রেন। সব রাতের ব্যাপার। এপারে এসে ট্রেনে উঠলাম।

রাত গভীর তখন। আমার শরীর ভালাে না। উল্টোপাল্টা জার্নির জন্য পেটেও ব্যথা। রুমে আমরা শুধু দুজন। আমার ভয় হতে থাকলাে। এমনি করে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

হঠাৎ ঘুম ভাঙলাে। টের পেলাম আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন দেবতুল্য ভাইয়া। জোরে তাকে ধাক্কা দিয়ে সােজা। হয়ে বসলাম। চিৎকার করে উঠলাম। বললাম, আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। ফিরে যেতে চাই ওই সংসারে। বাঁচান দয়া করে।

তিনি শক্ত করে আমাকে চেপে ধরলেন এবং বললেন, সারাটা রাত নিজেকে সংযমের মধ্যে রেখেছি। তােমার মতাে একটা মেয়েকে একা পেয়ে বসে থাকবাে? তিনি অমানুষের মতাে আচরণ শুরু করলেন।

নিরুপায় হয়ে বললাম, ভাইয়া, আমার শরীর ভালাে না। আমাকে ছােবেন না। আমি সুস্থ নই।

কিন্তু না। যে মানুষটা সকাল থেকে আমার সহযাত্রী হিসেবে জোহর, আসর, মাগরিব এবং এশার নামাজ পড়েছেন নিয়ম মতাে সেই মানুষটাই তার লালসা সারা রাত ধরে মেটালেন আমার শরীরের ওপর দিয়ে। ট্রেন যতাে জোরে চলে, ওনার অত্যাচারের পালা বাড়ে।

নিঃশব্দ রাতে ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দে মিলিয়ে গেল আমার চিৎকার। রক্তাক্ত হলাম। ক্লান্ত হলাম, নষ্ট হলাম। এবং সব হারালাম, সব কিছু। এরপরের গল্প খুব সংক্ষিপ্ত ।

আমাকে ডিভাের্স দেয়া হলাে। চরিত্রহীনা হিসেবে ঢুকতে দেয়া হলাে না ওই বাড়িতে। বড় ভাইয়ের সঙ্গে ট্রেনে ইচ্ছাকৃত রাতি যাপনের বিকৃত কাহিনী অজানা রইলাে না প্রবাসেও।

একা ফিরে এলাম মায়ের বাড়িতে মরার তীব্র আকাঙ্ক্ষায়।

বােধহয় বেঁচে থাকার সাধ আরাে তীব্র। আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হলাে। এক সময় ঢাকায় এলাম চাকরি নিয়ে। এক আত্মীয়ের সাহায্যে প্রথমে ছােট চাকরি, পরে বড় চাকরি এবং সংগ্রাম শুরু হলাে।

জীবনের একুশ বছর পর আমি একজন সফল নারী। সম্ভ্রান্ত কি না জানিনা। কিন্তু সচ্ছল পরিবারের এক ভদ্র সন্তানের বিবাহিতা স্ত্রী, গর্বিতা মা। সচ্ছলতা আমার চারপাশে।

ট্রেনে উঠতে অনেক দিন ভয় পেয়েছি। নামাজ পড়া মানুষ দেখে অনেক দিন ভয় পেয়েছি। সারাক্ষণ ভয় পেয়ে পেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখন নারীবাদী আন্দোলনে অংশ নিই।

এখন সমাজের এই নােংরা নিয়ম দুমড়ে-মুচড়ে ফেলতে পারি অনায়াসে।

এখন ট্রেনে চড়ে প্রায়ই দিল্লি, মাদ্রাজ যাই। তবে ট্রেনে একাকী অন্ধকারে আমার জীবনের সেই দুঃস্বপ্নের দৃশ্য কল্পনা করে এখনাে শিউরে উঠি।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
— অনলাইন থেকে সংগৃহীত

ভালো লাগলে শেয়ার করুন