এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে - ২য় পর্ব

Submitted by WatchDog on Tuesday, January 12, 2010

মধ্যরাতে প্রচন্ড মাথা ব্যথায় ঘুম ভেংগে গেল, দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন। কি করবো বুঝতে পারছিলামনা। এ শরীর নিয়ে ভোরের ট্রেন জার্নিটা অসম্ভব বলেই মনে হল। এমন একটা পরিস্হিতি যে হতে পারে তা একেবারে অজানা ছিলনা, সমুদ্রপৃস্ট হতে এত উচুতে শ্বাষ নেয়া কষ্টকর আগেই জানতাম কিন্তু এতটা হবে ভাবতে পারিনি। কোকা টি’র রহস্যটা বুঝতে একটু বোধহয় দেরীই হয়ে গেল। খুবই হাই ডোজের দুটো ’এডভিল’ খেয়ে লাশ হয়ে পড়ে রইলাম দক্ষিন আমেরিকার কোন এক অজানা-অচেনা হোটেলে।

ওয়্যক-আপ কলে ঘুম ভাংগতেই বেশ হাল্কা মনে হল নিজকে, মধ্যরাতের অভিজ্ঞতাটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ভাবতে চাইলামনা। এক কাপ চা ঝটপট চুমুক দিয়ে বিদুৎ গতিতে ধাবিত হলাম রেল ষ্টেশনের দিকে, ট্রেন মিস করা চলবেনা কিছুতেই। কাকডাকা ভোরের মায়াবী পরিবেশ ভেদ করে পেরু রেলের ঝকঝকে ট্রেনটাকে প্লাটফরমে দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল প্রশান্তিতে, মাচা পিচু দেখা হচ্ছে তাহলে এ যাত্রায়। মাচা পিচু - অথবা দ্যা লষ্ট সিটি আব ইন্‌কাস। কুস্‌কো হতে ৭০ মাইল উত্তর-পূবে সমুদ্রপৃষ্ট হতে প্রায় ২,৫ কিলোমিটার উচ্চতায় আশ্চর্য্য এক আর্কিওলজিক্যাল আবিস্কার। স্প্যানিশ উপনিবেশবাদের ধ্বংস যজ্ঞ হতে রক্ষা পেতে ইন্‌কারা পাহাড়ের বিশাল উচ্চতায় এমন একটা নিশ্চিদ্র আশ্রয় কি করে তৈরী করেছিল তা আবিস্কারকদের জন্যে আজও এক বিশাল বিস্ময়। ১৯১১ সালে মার্কিন ইতিহাসবিদ হিরাম বিংগহাম ইন্‌কাদের ট্রেইল খুজতে গিয়ে আবিস্কারের করেন পৃথিবীর অন্যতম এই আশ্চর্য্য সৃষ্টি। এর আর্কিওলজিক্যাল গুরুত্ব এবং স্থাপনার কারিগরী দিক নিয়ে এখনো চলছে আলোচনা, গবেষনা এবং বিতর্ক।

ঘন কুয়াশার বুক চিড়ে সকালের আলো ইতিউতি করছিল দিগন্ত রেখায়। ঘুম ভাংগছে পাহাড়ি মানুষের। উপত্যকার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা বাড়ি ঘরে মিট মিট করছে বিদ্যুৎ বাতি। ট্রেনটা অদ্ভুদ কায়দায় পাহাড়ের উচ্চতা অতিক্রম করছে, একবার সামনে আবার পিছনে, হেলে দুলে এগিয়ে চলছে সাপের মত। একটা নির্দিস্ট উচ্চতায় উঠে স্বাভাবিক যাত্রা শুরু হল। এন্ডিস পর্বতমালার বুক চিড়ে এগিয়ে চলল আমাদের ট্রেন।

খুব ছোট হতেই ঈশ্বেরের অস্তিত্ব নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছি, সৌরজগতের সৃস্টি নিয়ে বহু তত্ত্বে হাবু ডুবু খেয়েছি। ঠিক ঐ মুহুর্তে কেন জানি কোন কিছুতে বিশ্বাষ করতে ইচ্ছে করছিল, প্রকৃতির এ মোহনীয় সৌন্দর্য আপনা হতে সৃষ্টি হতে পারে অবিশ্বাষ্য মনে হচ্ছিল। ট্রেনের পাশাপাশি কল কল করে বয়ে চলছে পাহাড়ি খরস্রোতা ওর‌্যোবাম্বা নদী, এবং সে নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট লোকালয়। অদ্ভুদ কায়দায় সন্তানকে এক টুকরো কাপড়ে বেধে পিঠে করে পাহাড় বেয়ে যাচ্ছে মা, হাতে কুড়ানো লাকড়ি, সমস্ত মুখে কঠিন লড়াইয়ের ছাপ। নেশা ধরে যায় এসব দেখতে।

হোস্টেজ এসে সকালের নাস্তা অফার করলো। প্রকৃতির নৈসর্গিক মিলনমেলায় জাগতিক খাওয়া দাওয়া কেমন যেন বেখাপ্পা মনে হল, মনে হল কেউ যেন ঘুমাচ্ছে আর আমরা তার ঘুম ভাংগাচ্ছি অনাকাঙ্খিত আগ্রাসনে। হা হয়ে থেমে গেল আমার খাওয়া, সাদা ধবধবে বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া হতে সূর্য্যের আলোর বিকিরন হচ্ছে, মনে হচ্ছে আয়ানা দিয়ে কেউ বোকা বানাচ্ছে আমাদের। মাথার উপর আকাশ মাঝে মধ্যে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের আগ্রাসনে, সবুজের মেঘমালায় থরে থরে সাজানো বিভিন্ন চূড়া। হাল্কা ’এল কন্ডের পাসা’ গানের সূরটা ঐশ্বরিক এক আবহ সৃস্টি করলো ট্রেনের কামরায়, ১০-১৫ জন যাত্রীর মুখের ভাষা কোন এক জাদু মন্ত্রে আটকে গেল। সারা জীবন রোমাঞ্চিত হয়েছি মেঘের বিশালতা নিয়ে, কিন্তু পাহাড়ের বিশালতার কাছে মেঘের এমন বাধাহীন সমর্পন দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। রাশি রাশি মেঘ অসহায়ের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের গলা সমান উচ্চতায়।

কোন কারণ ছাড়াই থেমে গেল ট্রেনটা, বেশ কিছুক্ষন আটকে রইলাম একটা জায়গায়। ভয় থাকলেও নেমে পড়লাম ট্রেন হতে। কুস্‌কো হোটেলের সবাই আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল এ ধরনের এড্‌ভেঞ্চার হতে বিরত থাকার জন্যে। নিকট অতীতে মাওবাদী আবিমেইল গুজমান এবং তার সাইনিংপাথ গেরিলাদের চোরা হামলার এটাই না-কি ছিল মোক্ষম পথ। কে শোনে কার কথা, হুরমুর করে নেমে পরলো সবাই। একদিকে পাহাড়ী নদীর কল কল শব্দ, অন্যদিকে বন্য পাখীদের কিচিরমিচির গান, আর চারদিকে ভৌতিক নিঃশব্দতায় এন্ডিস পর্বতের বিশালতা, এগূলো বর্ণনার ভাষা আমার মত কাঁচা লেখকদের কলম যথেষ্ট নয়, এসব দেখা যায়, অনুভব করা যায় কিন্তু ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। হাল্কা একটা হুইসেল দিয়ে আমাদের কামরায় ফিরে যাওয়ার নোটিশ দিল ট্রেন চালক। হোস্টেজ এসে জানালো সামনে ওইয়াটাইটামবো নামের বড় একটা ষ্টেশনে থামবে ট্রেনটা এবং এর জন্যে আমাদের খাড়া হয়ে অনেক নীচে নামতে হবে। রেললাইনে কাজ হচ্ছে, তাই এ অপ্রত্যাশিত বিরতি।

সীটে বসে সান্‌রুফ দিয়ে অকাশ দেখতে শুরু করলাম। মড়মড় শব্দে নড়ে উঠলো রেললাইনের কাঠগুলো, নীচে নামছি আমরা। কিছুদূর যেতেই চোখে পরলো ষ্টেশনটা। বাহারী পোশাকে বিভিন্ন পন্য নিয়ে অপেক্ষা করছে এক গাদা এন্ডিয়ান তরুনী। নামতে হবে আমাকে, ভেতর থেকে তাগাদা অনুভব করলাম ছবি তোলার এটাই মহেন্দ্রক্ষন।
- চলবে


ভালো লাগলে শেয়ার করুন