এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে - ৩য় পর্ব

Submitted by WatchDog on Tuesday, January 12, 2010

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ওইয়াটাইটাম্বো ষ্টেশনে ট্রেনটা থামতেই দু’দিক হতে ঝাপিয়ে পড়লো ফেরিওয়ালাদের কাফেলা, ৪/৫ বছরের ছোট বাচ্চা হতে ৮০ বছরের বৃদ্বা, হাতে হরেক রকমের সওদা; কম্বল, স্কার্ফ, আল্‌পাকা পশুর লোম দিয়ে তৈরী বাহারী শীতকালিন পোশাক, অনেকের পিঠে ঝোলানো ছোট ছোট বাচ্চা। কুস্‌কো হতে যারা বাসে করে মাচু পিচু যাচ্ছে তারা এ ষ্টেশনে ট্রেন ধরছে, চারদিকে হৈ হোল্লর, চেঁচামেচি। যে পাহাড়ি নদী এতক্ষন ডান-বা করে সাপের মত আমাদের অনুসরন করছিলো খুব কাছ হতে তাকে দেখলাম, ষ্টেশনটার বুক চিড়ে উন্মাদের মত নামে যাচ্ছে যেন। পানির এত রাক্ষুষে শক্তি থাকতে পারে পাহাড়ি নদীর তান্ডব না দেখলে ধারণা করা অসম্ভব। এলোমেলো হাটাহাটি করলাম কিছুক্ষন প্লাটফরমের বাইরে, দু’টো চাবির রিং কিনলাম নিউ ইয়র্কের বন্ধুদের জন্যে। পাহাড় পাহাড় আর পাহাড়, এ যেন পাহাড়ের সমুদ্র। এন্ডিসের এ অংশটার সাথে পেরুর অন্য এলাকার, ইকুইডর এবং বলিভিয়ার এন্ডিসের ব্যাপক তফাৎ; এখানে পাহাড়ের শরীর সবটা ঢেকে আছে সবুজের আচ্ছাদনে, আর বাকি এন্ডিস শুধুই তামাটে, গাছপালা বিহীন উলঙ্গ এক দৈত্য যেন। একটা জিনিষ দেখে চমকিত হলাম, প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আলেহান্দ্রো তলেদোকে ভোট দেয়ার জন্যে দেয়ালে দেয়ালে চিকা। বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাষ বেড়িয়ে এল, নির্বাচনে আমাদের বাড়ির দেয়ালটার করুন চেহারাটা চাইলেও ভূলা সম্ভব ছিলনা।

মিনিট বিশেক পরে হিস হিস করে এগিয়ে চললো আমাদের ট্রেনটা। আমার ট্যুর গাইড আকাশফুরে কোত্থেকে উদয় হল যেন, কুসকো ষ্টেশনে তার সাথে শেষ দেখা এবং কথা ছিল মাচু পিচু ষ্টেশনে আমাকে খুঁজে বের করবে। বিদেশে বিভূঁয়ে হারিয়ে যাওয়ার ভয় অনেক আগেই কেটে গেছে; পকেটে দু’একটা ক্রেডিট কার্ড আর চলনসই ইংরেজি জানা থাকলে হারানোটা কোন সমস্যাই না, বরঞ্চ এ এক ধরনের এডভেঞ্চার। ব্রীফ করলো আমার ট্যুরের পরবর্তী অংশটুকু, বেশ ক’টা টিকেট ধরিয়ে দিল কাজে লাগবে বলে। এক ধরনের অস্হিরতা পেয়ে বসলো আমায়, তর সইছেনা যেন। ট্রেনের জানালায় মাথা গলিয়ে উৎসুক হয়ে কি যেন খূঁজছে সবাই, একই প্রশ্ন সবার চোখে মুখে, আর কতদূর? দূর হতে ষ্টেশনটা দেখে মনটা একটু দমে গেল, এ যে দেখছি একেবারেই সাধারণ। অসংখ্য মানুষের মিছিল, ফেরিওয়ালাদের ভীড় আর থরে থরে সাজানো দোকান পাটের মিছিলে স্বপ্নের মাচু পিচুকে খুঁজে পেলামনা। প্লাটফরমে পা রাখতেই ঠান্ডা একটা পাহাড়ি বাতাস সমস্ত শরীরকে ঝাকি দিয়ে গেল। পেরুর জাতীয় পোশাক আর বাদ্যযন্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে একটা গ্রুপ, ঝন ঝন করে উঠলো তাদের বাদ্যযন্ত্র। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় প্রতিধবনি হয়ে ফিরে এল সে সূরের মূর্ছনা। চমকে উঠলাম আমি, আরে তাইতো, ঠিক এরকম একটা দৃশ্যইতো দেখেছিলাম অষ্ট্রেলিয়ার এসবিএস টিভিতে যা পৃথিবীর এ প্রান্েত আসতে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। আকাশের দিকে চাইলাম, ছেড়া ছেড়া মেঘ ছাড়াও বিন্দু রেখার মত ছোট একটা বাসের চলাচল চোখে পড়লো। নিথর হয়ে আসলো হাত-পা, আমাকে উঠতে হবে ঐ উচ্চতায়। তারপরই কেবল দেখা মেলবে হারানো ইন্‌কা রাজ্যের।

হরেক রকমের ভাষা আর মানুষের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠলো রেল ষ্টেশন। খালি পা আর অর্ধ উলঙ্গ পশ্চিমা দুনিয়ার বাহারী ভ্রমনকারীদের নিয়ে স্হানীয়দের তেমন কোন মাতামাতি লক্ষ্য করলামনা, হয়তবা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মেনে নিয়েছে সবকিছু। আবাসিক হোটেল গুলোর অবস্হা অনেকটা ঢাকার মগবাজার মোড়ের হোটল গুলোর মতই শ্রীহীন, বয়ষের ভারে নূয্য। পাশাপাশি ঝকঝকে বিশ্বমানের হোটল গুলো বেশ ফাকা মনে হল। একটা জিনিষ ভ্রমন করলে শেখা যায়, যারা নিয়মিত পৃথিবীর অলি গলি চষে বেড়ায় তাদের কাছে হোটেলটা শুধু রাতটা কাটানোর একটা আশ্রয় মাত্র, এর কোয়ালিটি নিয়ে ব্যক প্যাকার্সরা খুব একটা মাথা ঘামায়না। এমনটা যেমন কোলকাতার সদর ষ্ট্রীটে দেখেছি এখানেও এর কোন ব্যতিক্রম চোখে পড়লনা।

আমার ট্যুর গাইড এসে মাচু পিচুর উপর প্রফেশনাল এক গাইডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, স্হানীয় এ্যক্সেন্টের ইংরেজী বুঝতে খুব যে একটা সুবিধা হবেনা তা নিয়ে একটু চিন্তায় পরে গেলাম। মিনিট দশেক পায়ে হেটে বাসে চড়ে বসলাম। হিসাব করে দেখলাম ড্রাইভারের পাশের সীট্‌টা হচ্ছে মোক্ষম জায়গা, প্রায় গায়ের জোড়ে দখল করে নিলাম কাঙ্খিত সীট্‌টা। শুরু হল যাত্রা। ভার্টিক্যাল জার্নি বলে কোন টার্ম আছে কিনা জানিনা, বাসের সামনের চাকা আর পিছনের চাকার ভেতর ৪৫ ডিগ্রী তফাৎ নিয়ে এ যাত্রাকে অন্যকোন নামে আখ্যায়িত করার ভাষা খুজে পেলামনা।

রোম শিউড়ে উঠার মত যাত্রা। সরু এবং আকাবাকা পাহাড়ি পথ। উলটো পথে কোন যানবাহন আসলে পিলে চমকে উঠে, এই বুঝি গড়িয়ে পরলাম পাহাড়ের মৃত্যু ফাদে! মাটি এবং ধূলার রাস্তা মাঝে মধ্যে বিপদজনক বাক, সামনের সীটে বসে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ট্রেন ষ্টেশনটাকে মনে হল এক খন্ড কাপড়। শ্বাষ বন্ধ করে শুধুই ডানে বায়ে চোখ ফেরালাম, কোথায় সে মাচু পিচু!

- চলবে


ভালো লাগলে শেয়ার করুন