এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে - ৫ম পর্ব

Submitted by WatchDog on Tuesday, January 12, 2010

নক্ষত্র মেলায় ডুবে যাওয়া দূরের আকাশটাকে মনে হচ্ছিলো রহস্যময় নারীর তুলতুলে শরীরের মত। জ্বল জ্বল করা তারা গুলো মুচকি হেসে আমন্ত্রন জানাচ্ছিলো অবৈধ অভিসারে। সেপ্টেম্বরের বসন্তের রাত পৃথীবির এ অংশটায়, কনকনে শীতের রেশ এখনো প্রকৃতি জুড়ে। আরও একটা কম্বল নিতে হল সূই’এর মত হুল ফোটানো শীত হতে বাচার জন্যে। লেক টিটিকাকায় ছোট্ট একটা ইঞ্জিন বোটের ডেকে শুয়ে দূরের আকাশটা দেখতে দেখতে নিজের ভেতর একধরনের ভোতা অনুভূতির জন্ম নিচ্ছিলো। চারদিকের ভৌতিক নীরবতা আর মধ্য গগনের তারাগুলো দারুন এক কাব্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করছিল যদিও। না চাইলেও তার চেহারাটা ঘুরে ফিরে মগজের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল বারবার। এতগুলো বছর পর এখনো তাকে ভূলতে না পারার জন্য নিজকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হল। ক্লান্ত মনে হল নিজকে।

সূর্য উঠার আগেই ঝটপট নাস্তা সেরে বাস ষ্টেশনে দৌড়াতে হয়েছে পুনো গামী শেষ এক্সপ্রেস বাসটা ধরার জন্যে। ১০ ঘন্টার লম্বা জার্নি। বলিভিয়ার পথে পেরুর শেষ শহর। মাচু পিচু হতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল, কুসকোর ঘন কুয়াশায় জার্নির শেষটা ছিল বেশ ভীতিকর। সময় ছিল আমার এক নাম্বার শত্রু, এত অল্প সময়ে এত বড় আয়োজন শরীরে উপর বয়ে দিচ্ছিল কাল বৈশাখী।

সহসাই দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে গেল লোকালয়, জানালার ওপাশটায় পাহাড়ের রাজ্য এসে গ্রাস করে নিল আমাদের চলা। থরে থরে সাজানো এন্ডিসের চূড়া গুলো চলন্ত ছবির মত হারিয়ে যাচ্ছিল জানালার ওপাশ দিয়ে। নেশা ধরা প্যানোরমা, আমি যেন শুধু গিলছি আর এন্ডিসকে বুকের ভেতর আকড়ে ধরছি শক্ত করে। রাজ্যের তন্দ্রা এসে ভর করলো। বাসের কর্কশ ব্রেকে তন্দ্রা টুটে গেল কিছুক্ষনের মধ্যেই, দুপুরের খাবার খেতে হবে। ছোট্ট একটা লোকালয়ে আমাদের যাত্রা বিরিতি। বাহারী পোশাকের ক’জন এন্ডিয়ান মহিলা গান গেয়ে আমন্ত্রন জানালো খাবার টেবিলে। হরেক রকম খাবারে ভরা বাফে। জ্বিবে পানি এগে গেল মেনুতে চোখ বুলিয়ে, ক্ষুধার্ত শেয়ালের মত ঝাপিয়ে পরলাম প্লেটের উপর। শেষ কবে ভাল খাবার মুখে উঠেছে মনে করতে পারলামনা। টেবিলের আশে পাশে ঘুরাফেরা করছিল একদল আলপাকা, জিরাফের মত উঁচু গলার একধরনের ভেড়া। পর্যটকদের মনোরঞ্জনের খুটিনাটি দেখে মুগ্ব হতে হল, শ্রদ্বায় মাথা নত করতে ইচ্ছে হল পেরুর মানুষের কাছে। বাস যখন ছাড়বে অদ্ভূত একটা দৃশ্য দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল, দন্তবিহীন এবং শীতে তামাটে হয়ে যাওয়া একদল শিশু বিরল প্রজাতির পাহাড়ি ফুল ধরিয়ে দিয়ে বিদায় জানালো আমাদের, আবারও গেয়ে উঠলো এন্ডিয়ান মেয়েগুলো। ধীরে ধীরে বিন্দুর মত ছোট হয়ে পাহাড় রাজ্যে মিলিয়ে গেল জীবনের এই সুন্দর মুহুর্তগুলো। আবারও পথ চলা।

সূর্য্যের তেজ ধীরে ধীরে পড়ে আসছিল। এনাকন্ডা সাপের মত ঘন কুয়াশা এসে গ্রাস করে নিল আমাদের বাসটাকে, চারদিকে শুধু ঘন অন্ধকার। থেমে গেল আমাদের চলা। ভয় পেয়ে গেলাম, এ লোকালয়ে ডাকাতদের উৎপাতের কথা অনেক উপন্যাসে পড়েছি, ছবিতে দেখেছি। বাসের অন্য যাত্রীদের চোখেও দেখলাম একই ভীতি। হঠাৎ করে আসা সাপটা আবার হঠাৎ করেই এন্ডিসের চোরা পথে হারিয়ে গেল, আলো দেখতে পেলাম বিপদজনক বাকে। বাসটা গতি বাড়িয়ে দ্রুত পৌছে গেল একটা চূড়ায়, সূর্যাস্ত দেখবো আমারা। বোবা হয়ে গেলাম অবিস্মরনীয় দৃশ্য দেখে। বরফে আচ্ছাদিত চূড়াগুলোর কোলে অসহায়ের মত ঘুমিয়ে পড়ছে শেষ বিকেলের সূর্যটা, রক্তিম আভায় ভেসে যাচ্ছে সাদা পালকের মত বরফগুলো। যুদ্বে পর্যুদস্ত সৈনিকের মত আত্নসমর্পন করলো এতক্ষন ধরে রাজত্ব করা পাহাড়ি সূর্যটা। হাল্কা অন্ধকার এসে চাদরের মত ঢেকে দিল চূড়াগুলো। দূড়ে ভেসে উঠলো টিটিকাকার হ্রদের সমুদ্র সমান চেহারাটা। দৃশ্যপটে টিমটিম করে জ্বলে উঠলো পুনো শহরের নিয়ন বাতিগুলো। এতক্ষন পর লোকালয়ের গন্ধ পেয়ে মনটা ঝলমল করে উঠলো।

লেক টিটিকাকা, সমুদ্রপৃষ্ট হতে ১২,৫০০ ফিট (৩৮০০ মি) উচ্চতায় পৃথিবীর সবচেয়ে চলাচল যোগ্য লেক। বৃস্টি আর এন্ডিসের বরফ গলা পানির ফসল হচ্ছে প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্যপট। লেকের অন্য ধারে বলিভিয়া, অনেক পর্যটক এ লেক দিয়ে পাড়ি জমায় আরও উঁচুতে অবস্হিত লা-পাস’এ।

আমার নামের ছোট একটা সাইন নিয়ে মধ্য বয়সি এক মহিলাকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখলাম, হাত বাড়িয়ে ইশারা দিতেই নিজের পরিচয় দিল, আমার গাইড। হোটেল বুক করা ছিল লিমা হতেই। ডকুমেন্টের ঝামেলা সেরে রুমে ঢুকতেই রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করলো, বিধ্বস্ত মনে হল নিজকে। ঘন্টা খানেক বিশ্রাম নিয়ে ধীরে ধীরে ফিরে ফেলাম বিশ্ব ভ্রমনের সেই পুরানো শক্তিটাকে।

দরজায় নক করে রুমে ঢুকলো আমার গাইড। দুঃসংবাদটা পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, বলিভিয়ায় সাধারণ ধর্মঘট চলছে গত ৭দিন ধরে, কবে ভাংগবে কেউ জানেনা, আর তাই পুনো হতে ছেড়ে যাওয়া বাস গুলো বসে আছে হাত-পা গুটিয়ে। অংক কষার চেষ্টা করলাম নিউ ইয়র্ক ফিরে যাওয়ার, মেলাতে পারলাম না কোন কিছু। আমি বন্দী হয়ে গেলাম এন্ডিসের পাহাড়ি বিশালতার অনিশ্চয়তার কাছে।

- চলবে


ভালো লাগলে শেয়ার করুন