স্মৃতির মেঠোপথ - ৩

Submitted by WatchDog on Sunday, February 23, 2020

বিলাসিতায় বেড়ে না উঠলেও অভাবে বড় হইনি আমরা। চাহিদার কোনকিছুই অপূর্ণ থাকেনি আমাদের। ৬০'এর দশকে চলাচলের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল খুবই দুর্লভ। আমাদের ছিল। আব্বা যে বছর পার্লামেন্টের নির্বাচনে গেলেন ব্যবহারের জন্য দ্বিতীয় গাড়ির সংযোজন ছিল অনেকটা বিলাসিতা। যদিও তার আসল মালিক ছিল আমাদের জুটমিল। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের আবিষ্কার তখন ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে পৃথিবীর এ অঞ্চলে। ফোন কোম্পানির জোরালো আবেদনে সাড়া দিচ্ছিল না স্থানীয় জনগণ। হয়ত প্রয়োজনও বোধ করেনি। কোন এক সুন্দর সকালে বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম অদ্ভুত একটা যন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে আমাদের পরিবারে। কুচকুচে কালো রংয়ের ভূতুরে ফোনটা চোখ বন্ধ করলে আজও মনে করতে পারি। নাম্বারটাও মনে আছে, ৯এ। ততোধিক কালো রংয়ের হাতল ঘুরিয়ে প্রথমে স্থানীয় এক্সচেঞ্জে অনুরোধ করতে হতো কাঙ্ক্ষিত নাম্বারের জন্য। ওরাই যোগাযোগের বাকি পর্ব সমাধা করে দিত। আমাদের জন্য মূল যোগাযোগ ছিল নাম্বার ৯। আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

স্কুলে আমার কোন সমস্যা ছিলনা। লেখাপড়া নিয়ে পরিবারের বাকি কাউকে চিন্তা করার তেমন কোন উপলক্ষ দিইনি। ছোটবেলা হতেই নিজের যোগ্যতার উপর বিশ্বাস করতে শুরু করি। যদিও বাসায় পড়ানোর জন্য একজন শিক্ষক আসতেন। স্যারের নামটা মনে নেই। স্থানীয়ভাবে কালা বিএসসি নামেই পরিচিত ছিলেন। শিক্ষকতা করতেন স্থানীয় গান্ধী স্কুলে। পরবর্তীতে পৃথিবীর অনেক দেশে অনেক শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছি, কিন্তু এমন অদ্ভুত শিক্ষকের দেখা আর কোনদিন পাইনি। এসেই ঘুমের আয়োজন করতেন। এক কাপ চা ও সাথে একটা টোস্ট বিস্কুটের জন্য দস্তুরমত অনুনয় করতেন। মাথায় এক ধরনের পাগলামি কাজ করতো স্যারের। প্রতিবেশী কাউকে দেখলে কঠিন ভাষায় সমালোচনা করতেন। স্যারকে নিয়ে এমন অনেক কাহিনী আছে যা বলে শেষ করা যাবেনা। আর যাই থাকুক, শিক্ষক হিসাবে স্যারের যোগ্যতা নিয়ে কোন সন্দেহ ছিলনা। আব্বা তখন স্কুল গভর্নিং বডির সভাপতি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হালিম স্যার থাকতেন রাস্তার ওপারে কালু মিয়ার বাসায়। প্রায়ই আসতেন আব্বার সাথে দেখা করতে। পড়ার ঘরে বসে অপেক্ষা করতেন। ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে অপেক্ষা করতাম কখন মুক্তি পাব এ জড়তা হতে। স্যার পাগলা হালিম নামে পরিচিত ছিলেন অনেক মহলে। আসলেই বোধহয় পাগল ছিলেন। যতক্ষণ আব্বার জন্য অপেক্ষা করতেন ততক্ষণ আমাদের হোম-ওয়ার্কের খাতা গুলো হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতেন। লাল কালি দিয়ে ভুল গুলো মার্ক করতেন। গভীর অসন্তুষ্টি নিয়ে নিজের সাথে নিজেই কথা বলতেন। থেমে থেমে আমাদের সাথে কথা বলতেন এবং তার প্রায় সবটাই ইংরেজিতে।

বন্ধু বলতে ইলিয়াসই ছিল আমার একমাত্র স্কুল-বন্ধু। বন্ধুত্বটা কখন ও কোথা হতে শুরু হয়েছিল তা আজ মনে নেই। স্কুলের সে বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বে রূপ নিতে সময় লাগেনি। কারণ চিন্তা-ভাবনায় অনেক কিছুতেই আমাদের অবস্থান ছিল এক মেরুতে। ওদের রাঙ্গামাটির কামাল ভিলা বাড়িটা ছিল আমার জন্য নতুন এক শুরু। ওদের পড়ার ঘরের ছোট লাইব্রেরীটা ছিল আমার জন্য পৃথিবী আবিষ্কারের খোলা এক জানালা। সে জানালায় উঁকি দিয়েই আমি নিজের জন্য আবিষ্কার করেছিলাম অন্য এক পৃথিবী। সে পৃথিবীর পরিসর নরসিংদীর মত ছোট থানা শহরেই সীমাবদ্ধ ছিলনা, সে পৃথিবীতে বাস করতো অন্ধ গ্রীক কবি হোমার, রুশ দেশের লিও টলষ্টয়, আন্তন চেখভ সহ বাংলা সাহিত্যের অনেক মহারথী। বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্মের পাশাপাশি কৈশোরের বেড়ে উঠার সাথে যোগ হয় সে সময়ের জন্য নতুন এক খেলা, ক্রিকেট। ওদের বাড়ির পাশের ছোট জমিটাকে খেলাটা আবিষ্কারের গবেষণাগারে পরিণত করি আমরা দুজন। কদিন পর আমাদের সাথে যোগ দেয় বন্ধু সেলিম। একে একে নাম লেখায় আমিরুল, শাহজালাল, শাজাহান, মাইনুদ্দিন, মানজার, কিশোরদের দুভাইয়ের মত অনেকে। তবে সবচাইতে উল্লেখ করার মত যিনি যোগ দেন তিনি আমাদের সবার প্রিয় আবুদা। এভাবেই রেললাইনের ওপারের ক্রিকেটকে আমরা এপারে নিয়ে আসি। মার্বেল ও ডাংগুলির আসর হতে অনেককে উঠিয়ে এনে মাঠে নামাই। উদয়ন ক্লাব নাম নিয়ে প্রথম টুর্নামেন্ট খেলতে যাই রেললাইনের ওপারে। প্রথম বারের মত আবিষ্কার করি চাইলে আমরাও পারি। এবং এ পারা ধীরে ধীরে শাখা মেলবে এবং ব্যাক্তি আমাকে নিয়ে যাবে পৃথিবীর এ প্রান্ত হতে ও প্রান্তে।

- চলবে


ভালো লাগলে শেয়ার করুন