জীবন নদীর গল্প - শেষ পর্ব

Submitted by WatchDog on Saturday, February 15, 2020

''এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়''...হেলাল হাফিজ ভাল কবি সন্দেহ নেই। তবে আমার শ্রেষ্ঠ সময়টায় আমি যেমন মিছিলে যাইনি, তেমনি যৌবনেও যেতে হয়নি যুদ্ধে। বরং যুদ্ধই আমার কাছে এসেছে এবং আমি সে যুদ্ধকেই আমার শ্রেষ্ঠ সময় হিসাবে দাবি করতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করিনি। নিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থার দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে একে একে বারটা বছর কাটিয়ে গেছি ইউরোপের এ প্রান্তে। কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে জীবন নদীর কক্ষপথ আবিষ্কারের জটিল সময়টা আমি উপভোগ করেছি নিজের মত করে।

দিনশেষে সব পাখিকে যেমন ঘরে ফিরতে হয় আমাকেও ফিরতে হয়েছিল। গেল সহাস্রাব্দির শেষদিকে চোখের পানি চোখে চেপে কোন এক সুন্দর সকালে বিদায় জানাতে হয়েছিল প্রিয় লেখক লিও তলষ্টয় ও ফেঁওদর দস্তায়ভস্কির দেশকে। আহামরি এমন কেউ বনে গেছি এমন দাবি না করলেও একজন মানুষ হিসাবে ঘরে ফিরেছি এ বিশ্বাসে কোনদিন ফাটল ধরেনি। অনেক বছর পর আবার ইউরোপে পা রাখতেই সেলুলয়েডের ফিতায় যেন ভেসে উঠল ফেলে আসা দিনগুলো। এর আগে কম করে হলেও বিশ বার ঘুরে গেছি জার্মানিতে। তাই জাপান এয়ারলাইন্সের বিমান হতে বের হয়ে ফ্রাঙ্কফুর্টের টারমেকে পা রাখতেই মনে হল এ মাটির গন্ধ আমার খুব পরিচিত, খুব আপন।

ওসাকা হতে বিদায় পর্বটা ছিল খুবই সাদামাটা। আমি জানতাম জাপান হতে বের হওয়ার পর আমার অস্ট্রেলিয়ান পরিচয়টা হয়ত অনেকদিন ব্যবহার করা হবেনা। তবে ফ্রাঙ্কফুর্টে শেষবারের মত ব্যবহার করতে বাধ্য হলাম। হাতে মাত্র চার ঘণ্টা সময়। চাইলেও এয়ারপোর্টের চৌহুদ্দি পেরিয়ে বাইরে যাওয়া সম্ভব ছিলনা। হাতে যথেষ্ট সময় না থাকায় কৈশোরে সময় কাটানো দেশটায় নতুন করে পা ফেলা হলনা। একটা ইচ্ছা সময়ের কাছে বলি হওয়ায় একটু যে কষ্ট হয়নি তা-নয়। ইউরোপ আমাকে অনেক দিয়েছে। দিয়েছে একাডেমিক শিক্ষা, দিয়েছে মানুষ হবার দীক্ষা। আরও দিয়েছে নিজের মনোজগতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার খোলা জানালা। উদ্দেশ্যহীন হাটাহাটি আর দুয়েকটা সুভিনিয়রের দোকানে ঢু মেরেই কাটিয়ে দিলাম এয়ারপোর্টের ঘণ্টাগুলো। রাত ঘনিয়ে আসার আগেই চেপে বসলাম পরের ফ্লাইটে। গন্তব্য টেক্সাস। এই অঙ্গরাজ্যের ডালাস শহরের ডালাস-ফোর্টওয়ার্থ এয়ারপোর্টই হবে আমার শেষ গন্তব্য। বহমান জীবন নদীর শেষ ল্যান্ডিং প্লেইস।

রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করায় কাজ হলোনা। কোথায় যেন অনিশ্চয়তার একটা ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল 'হে যাযাবর, আর কত!! এবার ক্ষান্ত হও। ঘর বাধার সময় এখন। আয়নার তাকিয়ে দেখ, চুলে পাক ধরেছে!' জীবন নদীর জটিল সমীকরণ মেলানোর এমন তাগাদা শেষবার কবে অনুভব করেছি মনে করতে পারলাম না। কখন ঘুমিয়ে পরেছি টের পেলাম না। অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন দেখলাম। ভাষা কোর্স শেষ করে ইউক্রেনের আজব সাগরের তীরে আমি। সাথে আরও কজন বন্ধু। আলজেরিয়ান সহপাঠী মজিদ বাল্লুল চরিত্রকে ব্যাঙ্গ করে আমি কবিতা পাঠ করছি! রুশ শ্রোতারা বাংলা না বুঝে অবাক হয়ে শুনছে আমার কবিতা। সিরিয়াস কবিতার আড়ালে আমি বাংলায় গণহারে গালি দিয়ে যাচ্ছি। শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শুনছে আর আমি গায়ে চিমটি কেটে হাসি থামাচ্ছি। বাংলা আর সাথে মজিদ বাল্লুলের ফ্রেঞ্চ! ... নুয়া...শালা তুই সিগারেট চোর...ভিক্ষুক...

কেবিন ক্রুর মিষ্টি আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল। সকাল হয়ে গেছে। টোষ্ট, ফ্রাইড ডিম, চীজ, সসেজ, সাথে ধূমায়িত কফি...। খিধায় পেট চু চু করছিল। গোগ্রাসে গিললাম সকালের নাস্তা। স্থানীয় সময় কটা, বুঝার কোন উপায় ছিলনা। আসলে আমরা এখন কোথায় তাও হদিস করতে পারলাম না। হবে হয়ত আতলান্তিকের উপর কোথাও। নাস্তা পর্ব শেষে ফ্লাইটের সবকটা জানালা আটকে বাতি নিভিয়ে দিল কেবিন ক্রুর দল। আবারও ঘুমের পালা। স্লো মোশনের সময় কখন শেষ হবে তার কোন হিসাব কষতে গেলাম না। আমি জানতাম এখনও অনেক পথ বাকি।

আকাশে বেশ ক'বার চক্কর দিয়ে ল্যান্ড করল আমাদের ফ্লাইট। চরম ব্যস্ত এয়ারপোর্ট। ল্যান্ডিং ক্লিয়ারেন্স পেতে তাই একটু সময় লাগে। ল্যান্ডিং ঝামেলা শেষ হতেই বেরিয়ে আসলাম ছোট্ট পরিসরের অফুরন্ত জীবন হতে। ইমিগ্রেশনের লম্বা লাইন দেখে ভড়কে গেলাম। বাইরে আমার জন্য ভাগ্নি তাদের এক বছরের বাচ্চা নিয়ে অপেক্ষা করছে। খুবই বিব্রত বোধ করব যদি প্রয়োজনের চাইতে বেশি সময় ওদের অপেক্ষায় রাখতে হয়। ইউএস সিটিজেন ও গ্রীনকার্ড হোল্ডারদের জন্য নির্ধারিত লাইনে ঢুকে এগুতে থাকলাম। লাইন লম্বা হলেও তা খুবই দ্রুত এগুচ্ছিলো। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের আধা সাদা আধা কালা ধরণের ইমিগ্রেশন অফিসারের মুখোমুখি হতে বিশাল একটা হাসি দিয়ে এগিয়ে দিলাম হাতের প্যাকেটটা। পালটা হাসির কোন নিশানাই দেখা গেলনা ভদ্রলোকের চেহারায়। একদম কোল্ড স্টোন চেহারার মূর্তিমান পাথর। অবাক হলাম না। জানতাম ওরা এরকমই হয়। পূর্ব হতে পশ্চিম বার্লিনে প্রবেশ করার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তাদের কাছে এসব হবে একেবারে ডালভাত। পাসপোর্ট সহ ইমিগ্রেশন প্যাকেটটা হাতে দিতেই হিমশীতল গলায় বলল, তোমাকে পাশের একটা কামরায় যেতে হবে। ওখানে কেউ একজন কাগজপত্র পরখ করার পর সন্তুষ্ট হলেই কেবল ভিসা ইস্যু করবে। এবার হতাশ হবার পালা। এমনিতেই লম্বা জার্নি শেষে ক্লান্ত, তার উপর মানসিক চাপ। সব মিলিয়ে অপেক্ষার পালা দীর্ঘায়িত হল কেবল।

নক করতে কেউ একজন এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিল। ভেতরে আসার আহবান জানাল। মুখে হাসি নেই, অতিরিক্ত কোন কথা নেই। সবই মাপা মাপা। চাবি দেয়া পুতুলের মত আমিও খেলে গেলাম আমার খেলা।

রুমের ভেতর মাত্র দুজনকে দেখে উৎকণ্ঠা দূর হয়ে গেল। অনুমান করলাম আধাঘণ্টার বেশি সময় লাগার কথা না। ফাইল বগলদাবা করে বসে পরলাম খালি একটা চেয়ারে। কাউন্টারে তিনজন অফিসার। দুজন অন্য কাজে ব্যস্ত। কেবল একজন গ্রাহকদের নিয়ে কাজ করছে। চোখ আর কান খোলা রেখে তাকিয়ে রইলাম অফিসার আর তার সামনে বসা যুবকের দিকে।

সময় গড়াচ্ছে। কিন্তু প্রথম জনের সমস্যাই শেষ হচ্ছেনা। অফিসার একের পর এক ফোন করে চলছেন। কিন্তু সমস্যার সমাধান পাচ্ছেন না। একটু এগিয়ে গিয়ে কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসলাম। বুঝার চেষ্টা করলাম সমস্যাটা কি। যাকে নিয়ে এই সমস্যা তার দিকে তাকাতেই একটা জিনিষ পরিষ্কার হয়ে গেল; এই জনাব রাশিয়ান কমরেড এবং ইংরেজি জ্ঞানশূন্য! অফিসার চেষ্টা করছেন ফোনে কোন অনুবাদকের সাহায্য নিতে। কিন্তু পাচ্ছেন না সে সাহায্য।

আজ রোববার। চাইলেই সবাইকে সব জায়গায় পাওয়ার কথা নয়। ঘড়ির দিকে তাকালাম। উৎকণ্ঠা বাড়তে শুরু করল। ভয় পেলাম বাইরে অপেক্ষমাণ ওরা না আবার চলে যায়। একঘণ্টা পর জায়গা ছেড়ে কাউন্টারে গেলাম। পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিলাম চাইলে আমি সাহায্য করতে পারি। রুশ আমার জানা ভাষা। এই প্রথম হাসি দেখলাম অফিসারের মুখে। বলল; তাহলে তো খুবই উপকার হয়। ছোটখাটো একটা শপথ বাক্য পড়াল...যাহা বলিব সত্য বলিব টাইপের। এবার রুশ কমরেডের দিকে মুখ ফেরালাম। জিজ্ঞেস করলাম তার অরিজিন। নাম আনাতোলি, বাড়ি ইউক্রেইনের রাজধানী কিয়েভে। এসেছে কানাডা হতে। খুব দ্রুতই বুঝতে পারলাম কাগজপত্র ঠিক নেই। মিথ্যা আর বাটপারী করে এদেশে ঢুকতে চাইছে। বিশ মিনিটের মত অনুবাদ করে গেলাম তার বক্তব্য। এদেশে প্রবেশের আবেদন রিজেক্ট করে তাকে ডিটেনশনে পাঠিয়ে দিল ইমিগ্রেশন অফিসার। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমাকে লম্বা একটা ধন্যবাদ দিয়ে অপেক্ষা করতে বলল। পরিবর্তী কাষ্টমার ৮০ বছর বয়স্কা ভারতীয় মহিলা। গায়ের রঙ দেখে আন্দাজ করলাম কেরালা অথবা তামিলনাড়ুর বাসিন্দা। তিনিও এসেছেন কানাডা হতে। স্থায়ী নাগরিক হিসাবে ঢুকতে চাইছেন। আবার নতুন করে হতাশ হওয়ার পালা।

ভারতীয় মহিলাও ইংরেজি জানেন না। ইমিগ্রেশন অফিসার এবার নেমে গেল ভারতীয় কারও খোজে। হিমশীতল এসির নীচে আমি ঘামতে শুরু করলাম। ইতিমধ্যে চার-ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। বাইরে যাদের অপেক্ষায় রেখেছি তাদের কথা ভেবে উৎকণ্ঠা আরও বাড়তে লাগল। এবার আর দেরি করলাম না...আবারও এগিয়ে গেলাম ডেস্কের দিকে। খুব বিনয়ের সাথে বললাম, চাইলে আবারও হেল্প করতে পারি তোমাদের। আমি বেশকিছুটা হিন্দি বলতে পারি। সন্দেহজনক হাসি দিয়ে আবারও আমন্ত্রণ জানাল। এবার অবশ্য দীর্ঘ হলনা বিনা-পয়সার দোভাষী সার্ভিস। ভিসা দিয়ে হুইলচেয়ারে করে বিদায় করে দিল ভারতীয় মহিলাকে। এবার আমার পালা। ঝড়ো গতির চেক-আপ শেষে পাসপোর্টে ভিসা লাগিয়ে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। শেষমুহুর্তে চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বলল,...চাইলে এফবিআইয়ে চাকরির জন্য চেষ্টা করে দেখতে পার। ওদের মাল্টি ল্যাংগুয়েজ এজেন্ট খুব দরকার। জবাবে আমিও একটা হাসির সাথে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলাম।

কাস্টম ঝামেলা শেষে এক্সিট দরজার দিকে পা বাড়াতে দেখতে পেলাম ভাগ্নির উৎকণ্ঠিত চেহারা। ওদের সবাইকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। হয়ত ধরেই নিয়েছিল এ ফ্লাইটে আমি আসিনি। সংক্ষেপে তুলে ধরলাম বিগত চারঘন্টার ঘটনা। বেল্ট হতে লাগেজ নিয়ে দরজায় বাইরে আসতেই টেক্সাসের পড়ন্ত বিকেল আমাকে সাদর আমন্ত্রণ জানালো।

মধ্য সেপ্টেম্বর। সূর্যের প্রখরতায় বাতাস পর্যন্ত কাঁপছিল। টেক্সাস! ছোটকালে ওয়েস্টার্ন উপন্যাসে পড়া অথবা মুভিতে দেখা অতি-পরিচিত একটা লোকালয়। এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমি অনেক আগেই ঢুকেছি। তবে তা ছিল কাগুজে অথবা সেলুলয়েডের ফিতায়। এবার নিজ চোখে দেখার পালা। গাড়িতে লাগেজ উঠিয়ে হাইওয়ের পথ ধরতে দিগন্তরেখায় ভেসে উঠল ডালাসের আকাশচুম্বী দালানকোঠা। এ শহরকেও অপরিচিত লাগলনা। ধারাবাহিক সিরিজ ডালাস খুব বেশিদিন আগের টিভি সিরিজ ছিলনা। জে আর চরিত্রকে ঘিরে ডালাস শহরের যে ছবি মগজে গেঁথে গিয়েছিল তার সাথে খুব বেশি কিছু তারতম্য চোখে পরলোনা। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য হেলে পরছিল। প্রায় ১৬০ কিলোমিটার গতির গাড়িতে বসে জীবন নদীর সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করলাম। হঠাৎ করেই মনে হল, এটাই বোধহয় আমার শেষ বন্দর। এখানেই ভেড়াতে হবে জীবন নদীর বহমান নৌকা।

আমার লেখারও হয়ত এখানে সমাপ্তি টানা যায়। যদিও বন্দরে স্থায়ীভাবে নৌকা ভেড়ানো এখানেও সম্ভব হয়নি। নদীর মত আমার জীবনও বয়ে যাবে ধারাবাহিক ভাবে। স্রোতের টানে আমাকে দেড়-মাসের মাথায় ফিরে যেতে হবে অস্ট্রেলিয়ায়। ছয়মাসের ভেতর আবার ফিরে আসতে হবে। তবে সে যাত্রায় আমেরিকার পূর্ব উপকূলের বন্দর পেন্সেলভানিয়ার ফিলাডেফিয়ায়। সেখানে হতে ছ'মাস পর মেগা শহর নিউইয়র্ক। বহমান নদী এখানেই থেমে যাবেনা। বইতে বইতে চলে যাবে ইনকা আর এন্ডিসের দেশ পেরুতে... কলার দেশ ইকুয়েডরে.... সামরিক অভ্যুত্থানের দেশ বলিভিয়ায়...ড্রাগের স্বর্গরাজ্য কলোম্বিয়ায়। নদীকে হত্যা না করলে সে নদী আজীবন বইতে থাকে। এবং দিনশেষে ঠাঁই নেয় সাগরে। আমিও কি তা-হলে অপেক্ষায় আছি তেমনি এক সাগরের!

সাথে থাকার জন্য পাঠকদের ধন্যবাদ।


ভালো লাগলে শেয়ার করুন