জীবন নদীর গল্প - পর্ব ৫

Submitted by WatchDog on Saturday, February 15, 2020

ছেড়ে যাচ্ছি অস্ট্রেলিয়া। পিছুটানার মত এমন কোন স্মৃতি রেখে যাচ্ছিনা। অথচ কোথায় যেন একটা লুকানো কষ্ট, যার কোন স্বরলিপি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চাইলেও বুঝতে পারছিলামনা কষ্টটা কিসের। পাঁচ বছর আগে দেশটায় প্রথম যখন পা রেখেছিলাম বিশেষ কোন স্বপ্ন ছিলনা। ছিলনা চাওয়া পাওয়ার হিসাব মেলানোর কোন অংক। শূন্য হতে জীবন শুরুর অভিজ্ঞতা আগেও ছিল। তাই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব-হীন একটা দেশে নিজকে হারিয়ে যেতে দেইনি। প্রশান্ত মহাসাগরের কোলঘেষে রাশি রাশি ঢেউ আর নীল নীল আকাশের নীচে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সিডনি শহরকে প্রথম দেখাতেই ভাল লেগে গিয়েছিল। রেন্ডউইক, কেংসিংটন, মারুবরা হয়ে হিলসডেলে কাটানো দিনগুলিতে ছিল স্বপ্নের আবেশ। কুজি, মারুবরা আর বণ্ডাই বীচের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউগুলোর কোলাহল কান পাতলেই শোনা যেত। লা পেরুসের নীলাভ পানি আর অন্তহীন খোলা আকাশ ঘীরে গাংচিলদের অলস ঘোরাফেরা জীবন নিয়ে চরম বিতৃষ্ণ কাউকেও সুখী করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। গোটা অস্ট্রেলিয়াকেই মনে হয়েছিল সেলুলয়েডের ফ্রেমে বাধানো স্লো মোশনের একটা জীবন। নিজকে এমন একটা জীবন তথা দেশের নাগরিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার ভেতর ছিল একধরনের আন্তসন্তূষ্টি। পাঁচ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে দেশটায় এমন অনেকের সাথেই পরিচয় হয়েছে যারা পরবর্তীতে আজীবনের জন্য বন্ধু অথবা শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে থেকে যাবে। সজলের প্রসঙ্গ এর আগেই টেনেছি। কিশোর আর বর্ণালীদের সাহায্য সহযোগিতা না পেলে হয়ত দেশটায় পা শক্ত করার মত মাটি খুঁজে পেতাম না। ডেফিন, পিকু, রুমি, রিকো সহ এমন আরও অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছিল যাদের সান্নিধ্যে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি পৃথিবীর এমন এক প্রান্তে যেখানে আমার কেউ ছিলনা। সুবেদ ভাই আর নীনা ভাবিদের সাথে পরিচয় এক কথায় বদলে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার জীবন। এদের সবাইকে ছেড়ে যেতে যতটা না কষ্ট তার চেয়ে ঢের কষ্ট হয়েছিল জীবন শুরু করার আগেই স্বপ্নের এমন একটা দেশ ছেড়ে যেতে। তবে আমি জানতাম এখানে ফিরে আসতে আমার কোনদিন অসুবিধা হবেনা। কারণ আমি এদেশের পাসপোর্ট-ধারী বৈধ নাগরিক।

কুয়াশাচ্ছন্ন সেপ্টেম্বরের সকাল। ওসাকা কানসাই এয়ারপোর্টে বিমান ল্যান্ড করতেই মনে হল হুরমুর করে বৃষ্টি নামবে। উন্নত বিশ্বের প্রথম সারির দেশ জাপান। ছোটবেলায় সেই 'ওশিন' ছায়াছবি দিয়ে পরিচয়। এরপর জীবন নদীর অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মহোৎসব দেশটাকে আরও কাছে এনেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের মিত্র জাপানকে নিয়ে একসময় অনেক রিজার্ভেশন ছিল। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে কম্প্রোমাইজ করতে বাধ্য হয়েছি দেশটার অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সাক্ষী হয়ে। আমাকে একদিন একরাত থাকতে হবে ওসাকায়। এমনটাই টিকেটের বাধ্যবাধকতা। অবশ্য জাপান এয়ারলাইন্স হোটেলের ব্যবস্থা রেখেছে রাতের জন্য। বিনাখরচে দেশটাকে দেখার এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলাম না। ট্রানজিট ভিসার বদলে ভিজিটর ভিসা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে লম্বা লাইন। সবাইকে খুব দ্রুতই পাসপোর্টে সীল মেরে ভেতরে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছিল। আমার পালা আসতেই কেমন যেন বদলে গেলে অফিসারের চেহারা। পাসপোর্টের ছবির সাথে বার বার আমার চেহারা মেলাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। কিছু সময় পর নিজের বসকে কাউন্টারে কল করল। সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল। সাথে আমার ধৈর্যের ঘড়িও টিকটিক করছিল। এক সময় কথা বলতে বাধ্য হলাম। জিজ্ঞেস করলাম সমস্যাটা কোথায়? উত্তরে মিনমিন করে কি বলল কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আমি জানতাম আমার মত চেহারার লোকদের সাথে জাপানি ইমিগ্রেশনের সমস্যার অন্ত নেই। কিন্তু আমি ঢুকছি একজন অস্ট্রেলিয়ান হিসাবে। আরও কিছুটা পার হতে অনেকটা ক্ষিপ্ত হয়ে জানিয়ে দিলাম অসুবিধা থাকলে আমাকে ভিসা দেয়ার কোন দরকার নেই। ট্রানজিটই আমার জন্য যথেষ্ট। কারণ এয়ারলাইন্সের বুক করা হোটেলটা ছিল এয়ারপোর্টের চৌহুদ্দিতেই। ওরা নিজেদের ভেতর কি নিয়ে যেন তর্ক করছিল। ধৈর্যের সবকটা বাধ ভেঙ্গে যাওয়ায় আক্রমণে চলে যেতে বাধ্য হলাম। এবার বাঁকা প্রশ্নে জিজ্ঞেস করলাম, সমস্যা কি আমার অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টে, না আমার চামড়ায়? বিনয় পরিবেশেই শেষ হল বিদেশ ভ্রমণের এই তিক্ত পর্ব। ৯০ দিনের ভিসা দিয়ে মাথাটা একটু কাত করে জাপান উপভোগের আমন্ত্রণ জানালো। হাতের ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে আমিও লম্বা একটা ধন্যবাদ জানালাম। ভুলা বুঝাবুঝি হয়ে থাকলে তার জন্যে ওরা ক্ষমা চাইলো। আমি আমার তির্যক ভাষার জন্য ক্ষমা চাইলাম।

হোটেলের ঝকঝকা রুম আর শান্ত অথচ নিরাপদ পরিবেশ দেখে মনটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। রাতে ভাল ঘুম হয়নি, তাই কয়েক ঘণ্টার জন্য একটা ঘুম জরুরি ছিল। গরম পানিতে লম্বা একটা গোসল দিয়ে লুটিয়ে পরলাম বিছানায়। অবশ্য এর আগে বন্ধু সজলের এক আত্মীয়কে ফোন করে দেখা করার সময়টা পাকা করে নিলাম। আজ সিডনি অলিম্পিকের শুরুর দিন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বিছানায় শুয়ে টিভিটা অন করতেই পর্দায় ভেসে উঠল সিডনির অলিগলি। মন আরও খারাপ হওয়ার আগে কখন ঘুমিয়ে পরেছি বুঝতে পারলাম না।

ফুরফুরে মেজাজে ঘর হতে বের হলাম। উদ্দেশ্য ডাউন-টাউন ওসাকা। নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা বলতে হয়ত বাড়িয়ে বলা হবে। আসলে আমার কোন গন্তব্য ছিলনা। পথ যেখানেই নিয়ে যায় সেখানেই থামার উদ্দেশ্য নিয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম। বেশকিছুটা অবাক হলাম বাইরের জাপানকে দেখে। ছোট ছোট বাড়িঘর, অথবা বহুতল দালান। দেখতে অনেকটা কবুতরের ক্ষুপটির মত। অবশ্য পরিচ্ছন্নতার কোন কমতি ছিলনা। ট্রেন চলছে, আমি পৃথিবীর নতুন একপ্রান্তকে গিলছি পর্যটকের চশমা দিয়ে। নতুন একটা ষ্টেশনে ট্রেনটা থামতেই মনে হল যাত্রীদের সবাই এখানে নামার জন্য তৈরি হচ্ছে। অভিজ্ঞতা বলছে এটাই হবে ডাউন-টাউন। স্রোতের সাথে মিলেমিশে আমিও নেমে গেলাম।

বাইরে বের হয়ে মানুষের স্রোত দেখে ভড়কে গেলাম। মানুষ আর মানুষ! এত মানুষের ভার এ শহর কি করে বহন করছে ভেবে অবাক হয়ে গেলাম। আমিও মিশে গেলাম জনস্রোতে। অলিগলির সব কোনা হতে ছবি তুললাম। এক পাকিস্তানী এগিয়ে এসে ছবি তোলায় সাহায্য করল। যাওয়ার সময় একটা ভিজিটিং কার্ড হাতে ধরিয়ে তার ব্যবসায় ঢুঁ মারতে আমন্ত্রণ জানালো। বিক্ষিপ্ত হাঁটলাম অনেকক্ষণ। গুনলে হয়ত কয়েক মাইল হয়ে যাবে। দুপুরের খাবার অভিজ্ঞতার জন্য একটা স্থানীয় রেস্তোরায় ঢুকলাম। অপরিচিত অনেককিছু। ইন্সটিংক্টের উপর ভরসা করে পছন্দ করলাম কয়েকটা আইটেম। এ আমার অনেকদিনের অভ্যাস। পৃথিবীর নতুন প্রান্তে কখনোই পুরানো খাবার খুঁজি না। বরং স্থানীয় খাবারের সন্ধানে নামি অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ কররা জন্যে। ভালই অভিজ্ঞতা হল এ যাত্রায়। দুপুর গড়াতে রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করল শরীরে। এবার হোটেলে ফেরার পালা। রাতে আবার যেতে হবে বাঙ্গালী ভাইয়ের দাওয়াতে।

পরদিন রাত দশটায় ফ্লাইট। লম্বা একটা জার্নি। গোটা-দিন হোটেলে শুয়ে-বসে অলিম্পিক দেখে কাটিয়ে দিলাম। বিশ্রাম শেষে যথেষ্ট শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে চেপে বসলাম পরবর্তী ফ্লাইটে। গন্তব্য জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে ডালাস।

চলবে।


ভালো লাগলে শেয়ার করুন