জীবন নদীর গল্প - পর্ব ৩

Submitted by WatchDog on Saturday, February 15, 2020

স্বপ্ন যেন একটা জিয়নকাঠি, যা ঘোর অন্ধকারেও মানুষকে আলো দেখায়। পথ দেখায় জীবন নদীর শেষ বন্দরের। স্বপ্নই হয়ত মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। এক অর্থে স্বপ্নের মৃত্যু মানে জীবনের মৃত্যু। আমিও দেখি। অনেক সময় স্বপ্নের কোন আগা-মাথা থাকেনা। থাকেনা কোন সীমানা। এই যেমন গেল সপ্তাহে এ দেশে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের (৪৫০০ কোটি টাকা) একটা লটারি হয়ে গেল। সূর্য তখন উঠি উঠি করে। সান্দিয়া পাহাড়ের উচ্চতার সাথে সূর্যের লড়াইটা জমে উঠার আগেই আমি কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। বিরামহীন ট্রাফিকে যন্ত্রের মত ড্রাইভ করতে করতে অচমকাই স্বপ্নটা চেপে ধরে...আমি জিতে গেছি ৫০০ মিলিয়ন ডলার। সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ভাইবোনদের সবাইকে যদি ১০ কোটি করে দেই বাকি জীবন ওরা অনায়াসে পার করতে পারবে। দুই সন্তানের নামে ৫০ মিলিয়ন করে ১০০ মিলিয়ন জমা করলেও অনেক টাকা থেকে যায়! অবচেতন মনে চলে যাই পেরু, ব্রাজিল সহ দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আমাজন নদীতে। হাল্কা একটা বজরায় চড়ে পাড়ি দেই এ নদী...জীবনের সাড়া শব্দ নেই কোথাও! চারদিকে শুনশান নীরবতা!! কর্কশ পুলিশ সাইরেনে ভেঙ্গে যায় স্বপ্ন। সামনে নিশ্চয় কোন দুর্ঘটনা ঘটে থাকবে। অস্ট্রেলিয়ায় মাইগ্রেট করার মাঝেই যদি স্বপ্ন পূরণের সমীকরণ মিলিয়ে ফেলতাম তাহলে বাকি জীবনটা হয়ত বিবর্ণ হয়ে যেত। হলুদ পাতার মতে ঝড়ে ঝড়ে পরত বেঁচে থাকার দিনগুলো। দূরের দেশ আমেরিকা যাওয়ার সুযোগটা হয়ত সে স্বপ্নেরই অংশ ছিল, যা জীবন নদীর চলার পথে বাতিঘর হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল।

রুশ দেশের পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের চাহিদা তাই আমাকে থামিয়ে দেয়নি। আমি জানতাম হাতের নখ নিয়ে পাহাড় কাটার মতই অসম্ভব ছিল ঐ দেশ হতে কোনকিছু বের করে আনা। তবে বিশ্বাস ছিল নিশ্চয় কোথাও না কোথাও সমাধান লুকিয়ে আছে যা আমাকে খুঁজে নিতে হবে। মিশনের শুরুটা ছিল খুবই ট্র্যাডিশনাল। সিডনীস্থ আমেরিকান কনস্যুলেট হতে বের হয়ে সোজা চলে যাই রুশ কনস্যুলেটে। রিসিপশনের নাম লিখিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। বেলা গড়ায়, কেউ আর আসেনা। বন্ধ হওয়ার কিছুটা আগে ঝকঝকে পোশাকের এক তরুণ এসে পরিচয় দিল সে ভিসা সেকশনের প্রধান। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন আমার সমস্যা ও চাহিদাটা। শুরুটা ইংরেজিতে হলেও রুশ ভাষায় আমার দক্ষতার কথা জানিয়ে হরহর করে বলে গেলাম ওদের দেশে কাটিয়ে আসা জীবনের লম্বা সময়ের কাহিনী। ভুলটা বোধহয় এখানেই করেছিলাম। রুশ ভাষায় একটা শব্দ আছে 'নাখ্‌লিয়েবনিক' - কাছাকাছি বাংলা হবে পরজীবী। আমি ঐ দেশে ছিলাম তার মানে তাদের রুটি হালুয়া খেয়ে বড় হয়েছি, তাই রুশদের চোখে আমি ম্লেচ্ছ। বদলে গেল ভদ্রলোকের গলার সুর। 'আপনি' হতে তুই তুকারিতে নেমে এলো আলাপচারিতা। হাতে একটা দরখাস্ত ধরিয়ে পূরণ পূর্বক ফি সহ কাউন্টারে জমা দেয়ার অনুরোধ করল। সময়ের কথা জানতে চাইলে খাঁটি রুশ ভাষায় একটা গালি দিল এবং জানিয়ে দিল দরখাস্ত মস্কোস্থ মিনিষ্ট্রি অব ফরেন এফেয়ার্স হয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গ যাবে। ওখান হতে ওটা ফিরতি পথ ধরবে এবং হাটি হাটি পা পা করে ফিরে আসবে অস্ট্রেলিয়ায়। আমাকে আশান্বিত হতে বলল এবং এক পা এগিয়ে মূল ফটকে পর্যন্ত এগিয়ে দিল। ফিরতি পথে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে আমিও চলে গেলাম ফেলে আসা সোভিয়েত দেশে। ওখানে হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়েনা..., আবার টুপাইস খসালে ক্রেমলিনের দরজা পর্যন্ত খুলে যায়!

দু সপ্তাহ পর ফিরে গেলাম রুশ কনস্যুলেটে। যান্ত্রিক কিছু শব্দ ব্যবহার করে উত্তর দিল। এসব শব্দের সাথে আমি প্রায় ১১ বছর বাস করেছি। তাই অবাক হলাম না। পরের ভিজিট ছিল আরও দুই সপ্তাহ পর। একই উত্তর। এ ফাঁকে সেন্ট পিটার্সবার্গ ও মস্কোতে পরিচিত অপরিচিত যারা ছিল সবার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। সময়টা ছিল দুঃস্বপ্নের। দুদিন আগে চেচেন মুসলমানদের কেউ একজন মস্কোর মেট্রো রেলে বোমা হামলা করে বেশ কজনকে হত্যা করেছে। রুশরা হন্যে হয়ে খুঁজছে সম্ভাব্য আরও হামলাকারীদের। এমন একটা সময়ে জন্মসূত্রে একজন মুসলমানের জন্য পুলিশ ক্লিয়ারেন্স বের করা বলতে গেলে অসম্ভবই ছিল। উপায় না দেখে যেতে হল আমেরিকান কনস্যুলেটে। রহস্যময় একটা প্রস্তাব পেলাম ওখানে। এবার প্রতি সপ্তাহে রুশ কনস্যুলেটে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল, এবং ফেরার সময় লিখিত একটা কাগজ, যাতে লেখা থাকবে আমি ওখানটায় গিয়েছিলাম, সংগ্রহ করার জন্য। তাই করা শুরু করলাম। সপ্তাহে একবার হাজিরা দেই এবং অনুরোধ করে কনস্যুলেটের প্যাডে লিখিয়ে আনি আমার উপস্থিতি। এমন একটা ডকুমেন্ট ইস্যু করতে কোন টালবাহানার মুখোমুখি হইনি। এ রকম ৫/৬টা কাগজ সংগ্রহের পর আমি ক্লান্ত হয়ে পরলাম। এবং একদিন ফাইনাল সিদ্ধান্তের জন্য আমেরিকান কনস্যুলেটে ফিরে গেলাম। অনেকটা সারেন্ডারের সুরেই জানালাম, ভিসা দাও বা না দাও, আমার পক্ষে রুশ দেশের ডকুমেন্ট জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছেনা। এবারের ভদ্রমহিলা মুচকি একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল রুশ কনস্যুলেট ভিজিটের সর্বমোট কটা ডকুমেন্ট আমার হাতে আছে। সবগুলো ডকুমেন্ট হস্তান্তরের পর উৎফুল্ল হয়ে জানাল আমার ভিসা পাওয়ায় আর কোন বাধা নেই। এবার অবাক হওয়ার পালা। এর রহস্য কি জানতে চাইলে উত্তরে ভদ্রমহিলা যা বলল তাতে খুশি হব না রাগ করব বুঝতে পারলাম না। ওরা নাকি প্রথম হতেই জানত রুশ দেশ হতে ক্লিয়ারেন্স আনা আমার পক্ষে সম্ভব হবেনা। ফাইলে ডকুমেন্ট থাকার বাধ্যবাধকতার জন্যই নাকি আমাকে রুশ কনস্যুলেটে যেতে বাধ্য করেছিল।

৭ দিন পরের একটা তারিখ দিল। ঐদিনই ইস্যু হবে আমার ভিসা। মার্টিন প্যালেসের উঁচুতলার দালানটা হতে বের হয়ে পাশের গোলাকার একটা বসার জায়গায় কিছুক্ষণের জন্য বসে রইলাম। মনে হল আমি পেরেছি! দুই পরাশক্তির টানাটানিতে আমি উৎরে গেছি।

- চলবে


ভালো লাগলে শেয়ার করুন