ঘুরে এলাম ইসরায়েল/প্যালেস্টাইন - পর্ব ৫

Submitted by WatchDog on Monday, April 19, 2021

Israel

তেল আবিবের কানেন্টিং ফ্লাইট রাত ১১টায়। নষ্ট করার মত হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। ভাবছিলাম এদিক ওদিক ঘুরে তারপরই কেবল চেক-ইন করবো। নিকট অতীতের অভিজ্ঞতার শিক্ষা, এয়ারপোর্টের সময়কে বিশ্বাস করতে নেই। নিমিষেই বদলে যেতে পারে সবকিছু। তার উপর ইমিগ্রেশন পার হয়ে লম্বা লাইন ধরে ভেতরে ঢুকার ভেতরও ছিল অনিশ্চয়তা। কোথায় কখন সমস্যার জন্ম হয় পূর্বাভাষ করার কোন উপায় ছিলনা। তাছাড়া আমি যাচ্ছি এমন একটা দেশে, যেখানে প্রতিদিনের জীবন ডুবে থাকে সমস্যার অথৈ সাগরে। একদিকে প্যালেষ্টাইনিদের প্রতিরোধ, পাশাপাশি ইস্রায়েলি সৈন্যদের নির্মমতা। সবমিলিয়ে ইস্রায়েল নামের দেশটায় যাওয়া যেমন কঠিন, বেরিয়ে আসাও খুব একটা সহজ না। বিশেষকরে আমার মত একজন জন্মগত মুসলমানের জন্যে।

কোন ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন ও স্ক্যানিং পার হয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে। দেখলে মনে হবে আলোর হাঁট জমেছে টার্মিনালে। সাথে মানুষের স্রোত। হরেক রকম মানুষ। যেন সাদা, কালো, বাদামি, এশিয়ান সহ গোটা বিশ্বের খন্ড একটা মানচিত্র এখানে। এলোমেলো হাঁটছে সবাই। কেউ হাতে টিকেট নিয়ে দৌড়াচ্ছে নিজ গেটের দিকে। আমার মত যাদের হাতে অফুরন্ত সময় তারা পথভ্রষ্ট পথিকের মত এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কেউ কেউ ডুকে পরছে ট্যাক্স ফ্রী দোকানগুলোতে। শেষমিনিটের কেনাকাটা সেরে অনেকে তৈরী হচ্ছে লম্বা জার্নির। সে জার্নির দূরত্ব অনেকের জন্য হয়ত আফ্রিকার গহীন জঙ্গল অথবা ব্রাজিলের আমাজন নদী পর্যন্ত। টুকাটাক কেনাকাটি আমিও সেরে নিলাম। যদিও ডিনারের সময় অনেকটা বাকি, তবু ম্যাকডোনাল্ড রেষ্টুরেন্টে আগাম কিছু খেয়ে নিলাম। সব প্রয়োজনীয়তা শেষকরে ফ্লাইট যখন আকাশে উড়বে রাতের খাবার পরিবেশনে তখনো অনেকদেরী। অতীতে কলোম্বিয়ার বগোটা হতে নিউ ইয়র্ক ফেরার পথে তিক্ত এক অভিজ্ঞতা এড়াতেই অসময়ের এ ডিনার।

ইউনাইটেডের ৯৫৪নং ফ্লাইট জি৯৬ গেইট হতে ছেড়ে যাবে। হাতে তখনো নষ্ট করার মত ২ ঘণ্টা সময় আছে। হাতের ছোট ব্যাগ আর কাধের ঝুলন্ত ল্যাপটপ্টা শেষবারের মত চেক হাঁটা দিলাম নির্দিষ্ট গেইটের দিকে। কাছাকাছি আসতেই বিস্মিত হলাম। বেইসমেন্টে মূল ফটক। পাশাপাশি অন্যন্য ফ্লাইটে ঢুকার চাইতে তেল আবিবগামী ফ্লাইটে ঢুকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাসপোর্ট চেক, তার উপর নতুন করে স্ক্যানিং।

গায়ের শেষ তুলাটা পর্যন্ত খুলে রাখতে হলো স্ক্যানিং মেশিনের বেল্টে। সান ফ্রানসিস্কো শহরে জানতাম চীনাদের ঘণবসতি। এই প্রথম খুব কাছহতে অনুভব করলাম এর সত্যতা। ইমিগ্রেশন ও স্ক্যানিং মেশিন অপারেটরদের সবাই চীনা। মাঝে মাধ্যে বিনা কারণে এশিয়ান ব্যাকগ্রাউন্ডের ইমগ্রেশন অফিসাররা ঝামেলা বাধায়। সামান্য ত্রূটিকে বিশাল কোনকিছুতে রান্নাকরতে ভালবাসে। এ দৌড়ে চীনারা সবসময় এগিয়ে। তারপর দাঁড় করানো যাবে ভারতীয়দের। এসব ব্যপারে আমার অভিজ্ঞতার ঝাপি অনেক ভারী। তাই কিছুটা হলেও জানা ছিল কি করলে ঝামেলা এড়ানো যায়।

ওরা কিছু বলার আগেই আমি পরনের কাপড় ছাড়া বাকিসব বেল্টে রেখেদিলাম। অফিসার অন ডিউটিকে খুব সন্তুষ্ট দেখালো। প্রয়োজনের চাইতে একমিনিটও দেরী হলোনা ঝামেলা শেষ করতে। বেল্ট হতে সবকিছু কুড়িয়ে আসল জায়গায় ফিরিয়ে নিতে বেশকিছুটা সময় পার হয়ে গেল। খুব সাবধানে গুনে গুনে সবকিছু যত্নকরে প্যাক করলাম। বিশেষ চোখ রাখলাম পাসপোর্ট ও বোডিং পাসের দিকে। এক মিনিটের জন্যেও ভুলে গেলাম না আমি কোথায় যাচ্ছি। আমার ভাল করে জানাছিল কথা ও কাজে সামান্য হেরফের হলেই আমাকে কাঞ্চনজংঘা পাহাড় ডিঙ্গাতে হবে। আমি আমার ইস্রায়েল যাওয়ার উদ্দেশ্য ও বিধয়ের স্টোরি সোজা করে নিলাম। মনে বিশ্বাস ছিল, সত্য বললে কোথাও কোন সমস্যা হবেনা।

বোয়িং'এর বিশাল এক ফ্লাইট। শত শত যাত্রী। সবাই নিজ দেশে যাচ্ছে। তিন ধর্মের দেশ ইস্রায়েল। যাত্রীদের পরনের পোশাক দেখেই বুঝা যায় কে কোন ধর্মের। ইহুদিদের মাথার টুপি জাতীয় টেফিল্লিন নামে পরিচিত বস্তুটা বলে দেয় ওদের পরিচয়। মুসলমান বলতে যে দু'চারজন ছিল তাদের সবার পরনে ট্রাডিশলান আরবী পোশাক। দু'চারজন ভারতীয় পোশাকেও তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সাদা আমেরিকানদের কেউ ভ্রমণ করছে বলে মনে হলোনা।

যাত্রীর মিছিল শেষ হতে লম্বা সময় লেগে গেল। অনেকে একাধিক হ্যান্ড লাগেজ ও শিশু নিয়ে প্রবেশ করায় তাদের বসাতে যথেষ্ট সময় ব্যায় করতে হলো এয়ার হোষ্টেজদের। আমার দু লাইন সামনে ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে এক ইস্রায়েলি পরিবার বসায় রাতের ঘুম কেমন হতে পারে কিছুটা আন্দাজ করেনিলাম। সামনে পেছনে যতদূর তাকালাম কোথাও খালি কোন সীটের দেখা পেলামনা। মনে মনে কিছুটা হতাশ হলাম। খালি কোন সীট পেলে ওখানে ঘুমের আয়োজন করতে পারতাম। অতীতে অনেক ফ্লাইটে এ সুবিধা নিয়েছি। আমার চার সীটের লাইনটা তখনও খালি। মনে মনে দোয়া করলাম অন্তত একটা সীট যেন খালি যায়।

একদম শেষমুহূর্তে একজন এসে জানান দিল জানালার পাশের সীটটা তার। ২০-২৫ বছর বয়সী অনিত্য সুন্দরী এক ইহুদি মেয়ে। চমৎকার একটা হাসি দিয়ে গুছিয়ে নিল নিজের সীট। কোন ভণিতা না করে নিজের পরিচয় দিল। সারাহ, জন্মগত ইস্রায়েলি। সান ফ্রানসিঙ্কোর কোন এক ইউনিভার্সিটির সোস্যাল সায়েন্সের ছাত্রী। ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে। জন্ম হাইফা শহরে হলেও তার মা-বাবা এখন তেল আবিবের বাসিন্দা। ওখানেই যাচ্ছে। নিজকে একজন টেলিকম প্রকৌশলী হিসাবে পরিচয় দিতে খুশি হয়ে জানালো তার এক ভাইও এই লাইনের প্রকৌশলী। ইস্রায়েল প্রথম যাচ্ছি জানতে পেরে আমাকে জানালার পাশের সীটে বসার আহবান জানালো। ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের অস্বীকৃতি জানালাম। লম্বা জার্নিতে আমি আইলসের সীটে বসতেই পছন্দকরি। তাতে মধ্যরাতে বাথরুম চাপলে আসা-যাওয়ায় অনেক সুবিধা।

অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম গোটা ফ্লাইটের দুটা সীটই কেবল ফাঁকা। এবং তা আমাদের সাঁড়িতে।

- চলবে।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন