বিকেলে ভোরের গল্প - পর্ব ৫

Submitted by WatchDog on Saturday, March 13, 2021

পোল্যান্ড হতে রওয়ানা দিয়ে ট্রেনে খুব একটা ঘুমাতে পেরেছি তা নয়। চার বিছানার কম্পার্ট্মেন্টে দুটোই ছিল খালি। একমাত্র সহযাত্রী ওয়ারশ হতে যোগ দিয়েছে। প্রয়োজনীয় কিছু কথা ছাড়া তেমন কোন বাক্যালাপ হয়নি। উঠার সাথে সাথে ব্যাগ হতে ভদকার বোতল নামিয়ে বসে গেছে নিজ কাজে। পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশে এ আজব সংস্কৃতি। ট্রেনে ওভার-নাইট জার্নি ও ভদকার সাথে তাদের সম্পর্কটা যেন অবিচ্ছেদ্য। ওরা এ কাজটা করবেই। ট্রেনে উঠা মাত্র পরনের কাপড় ছেড়ে রাতের পোশাক পরে বের করবে ভদকার বোতল। এবং তা চলতে থাকবে স্টক না ফুরানো পর্যন্ত। মাতলামির চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পরবে। এবং শুরু করবে নসিকা্র মাল্টি ডিরেকশনাল মিউজিক। এ যাত্রায় আমাকেও যোগ দেয়ার অনুরোধ করেছিল সহযাত্রী। ধন্যবাদ জানিয়ে আমার লম্বা জার্নির কথা জানাতে আর বেশী জোরাজুরি করেনি।

খুব ভোরে জার্মান পুলিশের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ডাকের তীব্রতা এতটাই রুক্ষ যাদের হার্টে সমস্যা তাদের বেলায় তা হয়ত চরম কোন পরিণতি ডেকে আনতে বাধ্য। আমি অবশ্য এসবের সাথে ইতিমধ্যে আপোষ করে নিয়েছি। মেনে নিয়েছি জার্মানরা এমনই।
ঢাকার সদরঘাটে দেখা ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের মত গলায় একধরণের ট্রে ঝুলিয়ে পঙ্গপালের মত ওরা ঢুকে পরে ট্রেনের বগিতে। চোখেমুখে মনুষ্যত্বের কোন ছায়া থাকেনা। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে সাইন্স ফিকশনের একদল রোবট। আন্তর্জাতিক সীমান্তের রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে জার্মান ভাষাকে ব্যবহার করে ইমিগ্রেশন ভাষা হিসাবে। এবং তা ভয়াবহ কর্কশ।

মুখের ভাষা যে খুব একটা লম্বা হয় তা নয়। খুব সীমিত ও সংক্ষিপ্ত শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাপ্ত হয় ইমিগ্রেশন পর্ব।
পাসপোর্ট চাইবে। হাতে নিয়ে দ্রুত পাতা উল্টাবে এবং ছবির পৃষ্ঠায় এসে থেমে যাবে। এক মিনিটের জন্যে স্থির হয়ে যাবে তাদের শরীর। পলক না ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে সামনের মানুষটির দিকে। দু'একবার তাকাবে পাসপোর্টের ছবির দিকে। এবং এসব শেষ হওয়ার পর খটাস করে সিল মারবে পাসপোর্টে। ভালমন্দ কিছু না বলে চলে যাবে পরের জনের কাছে।

চব্বিশ ঘণ্টার ট্রানজিট ভিসা সেন্ট পিটার্সবার্গ হতেই নেয়া ছিল। তাই বর্ডার পুলিশের হরেক রকম সাইকোলজিক্যাল কেরামতিতে বিভ্রান্ত হওয়ার কোন কারণ ছিলনা। পাসপোর্টে ওরা যে সীলটা মারে তার শব্দও ছিল সীমিত; পূর্ব জার্মানির সংক্ষিপ্ত নাম DDR (Deutsche Demokratische Republik) ও তারিখ। আমার বাংলাদেশি পাসপোর্টের মোটা আকৃতির মূল কারণ ছিল পূর্ব জার্মান সীমান্তের এই সিল।

অদ্ভুত দেশ এই পূর্ব জার্মানি। আরও অদ্ভুত ছিল দেশটার রাজধানী পূর্ব বার্লিন। অনেকের মতে ডি ফ্যাক্টও সিটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে মিত্র বাহিনী চারভাগে ভাগ করে নেয়। একভাগের নিয়ন্ত্রণ নেয় পূবদিক হতে আসা সোভিয়েত বাহিনী, যা পরিবর্তীতে পূর্ব জার্মানি নামে আত্মপ্রকাশ করে। বাকি জার্মানির নিয়ন্ত্রণ নেয় মিত্রবাহিনীর বাকি দেশগুলো, যা পশ্চিম জার্মানি হয়ে টিকে থাকে। পূর্ব জার্মানির রাজধানী পূর্ব বার্লিনের জন্মও এই কনফ্লিক্টের মাঝে। বার্লিন শহরকেও একই কায়দায় নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় মিত্রবাহিনী। পকেট শহর হিসাবে পশ্চিম বার্লিনের অস্তিত্ব অনেকটাই ছিল দুই পরাশক্তির আভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফসল।

পোলিশ সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব জার্মানিতে পা রাখলে এরাইভেল সিল মেরে স্বাগত জানায় দেশটার ইমিগ্রেশন পুলিশ। রাজধানী পূর্ব বার্লিন পৌঁছে বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করার সময় এক্সিট ভিসা দিয়ে বিদায় দেয় পূর্ব জার্মানি। আরও পশ্চিমে যেতে যাইলে পশ্চিম বার্লিন সীমান্ত অতিক্রম করে আবারও ঢুকতে হয় পূর্ব জার্মানিতে। এবং আবারও এরাইভেল সিল। পাশের দেশ পশ্চিম জার্মানিতে ঢুকার সময় এক্সিট সিল দিয়ে বিদায় জানায় পূর্ব জার্মানি। ইতিমধ্যে কম করেও হলেও ত্রিশবার এ পথ পাড়ি দিয়েছি আমি। একমাত্র পূর্ব জার্মান ইমিগ্রেশন সীলের কারণে আমার পাসপোর্ট ৪ বার নবায়ন করতে হয়েছিল। একসাথে ষ্ট্যাপলার করা পাসপোর্টগুলো দেখলে যে কারও মনে সন্দেহ জাগার যথেষ্ট কারণ ছিল। এ নিয়ে আমার ভোগান্তির ইতিহাসও কম ছিলনা।

খুব ভোরে পূর্ব বার্লিন ষ্টেশনে এসে ট্রেন থামলো। বাইরের পৃথিবী তখনো জেগে উঠেনি। শহরের উঁচু উঁচু দালানগুলোর মাথা ডুবে ছিল কুয়াশার চাদরে। বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের শুরুতেও শীতের প্রকোপ মুছে যায়না পৃথিবীর এ প্রান্তে। বিশেষকরে সকালের দিকে। অবশ্য চারদিকের গাছপালার দিকে তাকালে প্রকৃতির পরিবর্তন সহজেই চোখে পরে। এত সকালে কোথাও যাওয়ার তাগাদা থাকেনা, তাই ট্রেন ষ্টেশনে বসেই কাটাতে হয় কয়েক ঘণ্টা। ৯টায় ব্রিটিশ এম্বেসির ভিসা সেকশন খুলবে। ওটাই আমার প্রথম গন্তব্য। সময় মত ভিসা পাওয়া গেলে দৌড়াতে হবে নেদারল্যান্ড দূতাবাসে। সকালের ব্যস্ততা শেষ করতে দুপুর গড়াবে। এবং তারপরই অতিক্রম করতে যাবো বার্লিন দেয়াল।

সকাল ৬টার ভেতর ষ্টেশনের পাশে কফি শপটা তাদের দরজা খুলে দেয় গ্রাহকদের জন্যে। দোকানের বাইরে বেশকটা চেয়ার টেবিল বসিয়ে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়। প্রতি গ্রীষ্মে এক কাপ কফি নিয়ে অনেকক্ষণ উপভোগ করি পূর্ব বার্লিনের সকাল। এ যাত্রায়ও বাদ দিলাম না।

দরজা খুলে কাউন্টারের বৃদ্ধাকে guten morgen সম্বোধন করতেই এক ঝিলিক হাসি দিয়ে বসতে অনুরোধ করলো। পূর্ব ইউরোপে এ ধরণের হাসি খুবই বিরল। বিশেষকরে গ্রাহক-সেবায়। মনটা হাল্কা হয়ে গেল। রাতের ক্লান্তিও যেন কিছুটা দূর হলো। কফির মৌ মৌ গন্ধ সুবাসিত হয়ে উঠলো চারদিক।

- চলবে।


ভালো লাগলে শেয়ার করুন