স্মৃতির মনি কোঠা থেকে তিয়েন আন মেন ম্যাসাকার-১

Submitted by WatchDog on Sunday, June 7, 2009

১৯৮৯ সালের ৩রা জুন। চিনের রাজধানি বেইজিং এর কেন্দ্রস্থল তিয়েন আন মেন স্কয়ারে (স্বর্গের দ্বারে) চিনের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সংঘটিত সংস্কার ও গনতান্ত্রীক আন্দোলন নির্মুল করতে ঘটেছিল ইতিহাসের নির্মমতম এক হত্যাজজ্ঞ। তিয়েন আন মেন স্কয়ারের অদুরেই এক ছাত্র নিবাসে পাচ দিন অবরুদ্ধ ছিলাম আমি সহ হংকং থেকে আগত বেশ কিছু ছাত্র। স্মৃতির মনিকোঠা থেকে হাতড়ে অবরুদ্ধ সেই পাচ দিনের চাঞ্চল্যকর ঘটনার বিবরন।


প্রথম পর্ব
------

যতদুর মনে পড়ে ১৯৮৯ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের কথা। হংকং এর শিম শা শুই এলাকার একটি গেষ্ট হাউজের দরজা ভেঙ্গে আমার ব্রিফকেস চুরির ঘটনা লিপিবদ্ধ করতে স্থানীয় পুলিশ চৌকিতে অপেক্ষা করছি, এমন সময়ে সেখানে এলেন ভারতের পাঞ্জাব এলাকা থেকে আগত হংকং এর অভিবাসী মিসেস তাজিন্দর সিং। ভিক্টরিয়া আইল্যান্ড এর একটি অভিজাত এলাকায় বসবাস এবং স্বামির সাথে যৌথ ভাবে পরিচালনা করেন নিজেদের ট্রাভেল ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম। এ সময়ে হংকং এর বিত্তশালী ব্যাবসায়ি ও শিল্পপতিদের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছিল,কারন ৯৯ বছরের লিজচুক্তি শেষে ব্রিটিশ সরকার হংকং এর মালিকানা মুল চিনের কাছে হস্তান্ততের সিদ্ধান্ত তখন প্রায় পাকাপাকি হওয়ার পথে। এজন্য অনেকেই তাদের সহায়-সম্পদ,ব্যাবসা-বানিজ্য ও শিল্প প্রতিষ্ঠান বেচে তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, মালায়েশিয়া ও অষ্ট্রেলিয়া মুখী। এ অস্থিরতা থেকে সিং পরিবার ও মুক্ত নন। ভারতের সাথে মুল চিনের সম্পর্খ ভাল না হলেও তাইওয়ানের সাথে ভারতের বন্ধুত্বপুর্ন ব্যাবসায়িক ও শিল্প সম্পর্খের সুত্রে তাইওয়ানে প্রচুর সংখ্যক ভারতীয়র বসবাস । পরিবারের একমাত্র সন্তান হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র তার পড়াশুনার পাট চুকালেই তারা স্থায়ীভাবে তাইওয়ানের কাওসাইং এলাকায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এজন্য,শিম শা শুই এলাকায় তাদের মালিকানাধীন বেশ কিছু এ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির উদ্দেশ্যে কয়েকজন সম্ভব্য ক্রেতাকে দেখাতে এ এলাকায় এসেছিলেন। ফিরে যাওয়ার পথে তার হাতব্যাগ ছিনতাই এর শিকার হয়ে এখানে এসেছেন। আলাপ প্রসঙ্গে আমার পাসপোর্ট সহ ব্রিফকেস চুরির কথা শুনে নিজের দুর্ঘটনা ভুলে আমার জন্য উদ্ভিন হলেন। জানালেন ভারত,বাংলাদেশ সহ কমনোয়েলথ ভুক্ত বেশকিছু দেশের নাগরিকেরা হংকং এ তিন থেকে ছয় মাসের এন্ট্রি ভিষা পেলেও কমনোয়েলথ থেকে বহিস্কৃত পাকিস্তানি নগরিকেরা মাত্র একমাসের এন্ত্রি ভিষা পান। মাত্র এক মাসের এন্টি ভিষা নিয়ে এখানে আগত জাপান, অষ্ট্রেলিয়া, দক্ষিন কোরিয়া ও তাইওয়ান গমনেচ্ছু পাকিস্তানীরা সহজে ভিষা লাভে সমর্থ হন না বিধায় ভারত ও বাংলাদেশের পাসপোর্ট চুরির ঘটনা ইদানিং বেশ বেড়ে গেছে। এখানে স্থায়ী ভাবে বসবাসরত বেশ কিছু পাকিস্তানি বখাটে যুবক এসবের সাথে জড়িত বলে তিনি জানান। পুলিশ চৌকি থেকে বিদায় নেয়ার আগে তাদের এক স্থানীয় হোমরা চোমরা পাকিস্তানি বন্ধুর মাধ্যমে আমার পাসপোর্ট উদ্ধারের চেষ্টা করার স্বেচ্ছা প্রতিশ্রুতি উনি দান করেন। পরবর্তিতে সত্যি সত্যিই উনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমার পাসপোর্ট উদ্ধারের সুবাদে এ পরিবারের সাথে আমার ঘনিষ্ট সম্পর্খ গড়ে উঠে। এ পরিবারের একমাত্র ছেলে তাজ সিং। এ সময়ে সে হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের শেষ পর্বের ছাত্র। এদের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনমানব শুন্য একটি দ্বীপে তিনদিনের জন্য একটি চাইনিজ চলচিত্রের শুটিং এ অংশগ্রহন করাকালীন সময়ে সেখানে সম উদ্দেশ্যে আসা তাজ সিং এর অধিকাংশ সহপাঠীদের সাথেও আমার হৃদ্যতা গড়ে উঠে। সে সুবাদে শা তিন এলাকাস্থ তাদের ক্যাম্পাসে সন্ধ্যা বেলার আড্ডায় আমার অনিয়মিত যাতায়াত। মে মাস গড়াতেই বেইজিং এর ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে এ ক্যাম্পাস তেতে উঠতে শুরু করে। প্রতিনিয়তই কোন না কোন মিছিল মিটিং চলছে। বাঙ্গালী হিসাবে মিছিল মিটিং এর অস্থি ও মজ্জাগত উন্মাদনা থেকে আমিও মুক্ত নই। প্রতিদিন বিপুল উতসাহ উদ্দিপনা নিয়েই অংশগ্রহন করছি। সারা চিনদেশ থেকেই সংস্কারপন্থি ছাত্র-শ্রমিক-জনতা বেইজিং এর মুল আন্দোলনে প্রতিদিন সামিল হচ্ছে। চিনা কমুনিষ্ট পার্টির পলিটব্যুরোর উচ্চপদস্থ সংস্কারবাদি নেতা ঝাও জিয়াং সয়ং এ ছাত্রদের সমাবেশে বক্তব্য রাখাতে আন্দোলন পেয়েছ ভিন্ন গতি ও মাত্রা। তিয়েন আন মেন স্কয়ারের মুল আন্দোলনে জোগ দিতে তাইওয়ান,জাপান ও কোরীয়ার ছাত্ররাও প্রতিদিন হংকং এ জড়ো হচ্ছে মুল আন্দোলনকে আন্তর্জাতীক রুপ দিতে। সে সময়ে হংকং এর ছাত্ররা প্রো ডেমোক্রেটিভ ও প্রোচাইনিজ নামক দুটি ধারায় বিভক্ত ছিল। একদিন সন্ধ্যায় অবগত হলাম যে হংকং থেকে প্রোডেমোক্রেটিভ ধারার একদল ছাত্র বেইজিং এর মুল আন্দোলনে যোগ দিতে দলবদ্ধ হচ্ছে। প্রোচাইনিজ ধারার ছাত্রদের অগচরে এ প্রস্তুতি চলছে বিধায় অত্যান্ত গোপন ও সতর্কতার সাথে তাদের যাবতীয় প্রস্তুতি চলছে। তাজ সিং এদেরই একজন সংগঠক। বেশ কিছুদিন থেকেই বাঙ্গালী ভাগ্যান্যেষীদের একটি ছোট দল গড়ে ত্রানস-সাইবেরীয়ান পাড়ী দিয়ে ইউরোপ গমনের সম্ভব্যতা যাচাইয়ের জন্য বেইজিং যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল বিধায় তাজ সিং এর প্রস্তাব লুফে নিয়েই এ দলে যোগ দিলাম।

চলবে......

ভালো লাগলে শেয়ার করুন