গ্রীষ্মের এক রাতে

Submitted by WatchDog on Saturday, February 22, 2020

গ্রীষ্মকালটায় পর্যটকে গিজ গিজ করে ইংলিশ রিভেয়েরার শহরগুলোতে। বিশেষকরে টর্কি ও পেইংগটনে। শরতের শুরুতে জনশূন্য শহরগুলোকে কেউ যদি ভুতের নগরী ভেবে ভুলকরে অন্যায় কিছু হবেনা। আক্ষরিক অর্থেই জীবন থেমে যায় এখানে। স্থানীয়রা বাদে পর্যটকদের কাউকে দেখা যায়না। অথচ পর্যটনই শহরগুলোর প্রাণ।

প্রতি গ্রীষ্মেই ইংল্যান্ড আসা হয়। ঘুরে বেড়ানোর তাগাদাটা প্রথমবারই সেরে নিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার আগমনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সামার জব। সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে ট্রেনে করে রওয়ানা দিলে দুই রাত, দুই দিন জার্নির পর পৌঁছানো যেত লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অথবা লিভারপুল স্ট্রীট রেল ষ্টেশনে। পোল্যান্ডের ওয়ারশা হয়ে পূর্ব বার্লিন পর্যন্ত ছিল একটানা জার্নি। এরপরই শুরু হতো ঝামেলা। পায়ে হেটে বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করার পর পশ্চিম বার্লিন। ওখান হতে নেদারল্যান্ড অথবা বেলজিয়াম-গামী ট্রেন ধরে রাতের ফেরীতে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে সকালে পৌঁছতাম হারউইচ অথবা ডোবার ঘাটে। এবং আবারও ট্রেন এবং এ যাত্রায় শেষ গন্তব্য লন্ডন।

সে গ্রীষ্মে আবহাওয়া ছিল অস্বাভাবিক রকম উত্তপ্ত। টুরিস্টদের সংখ্যাও ছিল অনুমানের বাইরে। রিভেয়েরার বীচে উন্মুক্ত বক্ষের রমণীরা ভিড় জমাতে শুরু করায় এলাকার আকর্ষণ বহুগুণ বেড়ে যায়। টর্কির স্থানীয় এক বাংলাদেশি সিলেটী ভাইয়ের রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করি আমি। দুপুর ১২টায় খুলে ৩টায় বন্ধ হয়। সন্ধ্যা ৬টায় খুলে প্রায় সারা রাত খোলা থাকতো এসব রেস্টুরেন্ট। শেষ রাতের দিকে ডিস্কোটেক হতে বেরিয়ে আসতো ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ তরুণী। রেস্টুরেন্ট মালিকদের টার্গেট থাকতো এসব ক্ষুধার্ত নিশাচরের দল। ওরা দলবেঁধে ঢুকে হৈ চৈ করে মাথায় তুলে রাখতো রেস্টুরেন্টের পরিবেশ। এবং এদের প্রায় সবাই থাকতো মাতাল।

তেমনি এক শনিবারের রাত। ভোর বোধহয় ৩টা। এক সাথে ১০-১৬ মাতাল ঢুকে পরল আমাদের রেস্তোরায়। ঢুকেই অশ্রাব্য খিস্তি আউড়ে ভারতীয়দের গালি-গালাজ শুরু করে দিল। বলাই বাহুল্য ওসব গ্রাহকদের কাছে আমরা সবাই ছিলাম ভারতীয়। ওরা খাবারের অর্ডার দিয়ে টেবিলে বসে পরল। কেউ কেউ বারে ঢুকে বোতল টানাটানি শুরু করল। আমরা সামনে ছিলাম ৩ জন। এবং সবাই রুশ দেশ হতে আসা ছাত্র। রান্নাঘর ছিল দোতলায়। ওখানে আরও ৩ জন। মালিক ছিল পেইংগটনের রেস্টুরেন্টে। তাকে খবর দেয়া হল। তিনি পৌছার আগেই শুরু হয়ে গেল অল-আউট আক্রমণ। বার ভেঙ্গে তচনচ করে দিল। রান্নাঘর হতে আমাদের শেফ ভাই ইন্টারকমে ম্যাসেজ পাঠালেন। উপর হতে এমু-নেশন আসছে, আমরা যেন ব্যবহার করতে শুরু করি।

হাতে টানা খাদ্য চলাচলের এলিভেটরটা খুলতেই দেখা গেল ওখানে কয়েক বালতি মরিচের গুড়া। সাথে ৩টা বড় মগ। এক কথায় সন্মুখ যুদ্ধের মারণাস্ত্র। কয়েক সেকেন্ডে নিজেদের কর্তব্য ঠিক করে নিলাম। আক্রমণে নামতে হবে আমাদের।

মগ ভর্তি মরিচের গুড়া হিংস্র হায়েনার মত ছুড়ে মারলাম মাতালদের চোখে মুখে। গোটা রেস্তোরায় তৈরি হল ভয়াবহ পরিবেশ। বাতাস ভারী হয়ে এলো। শ্বাস নিতে আমাদেরও কষ্ট হচ্ছিল। কিচেন হতে আরও তিন জন যোগ দিল আমাদের সাথে। কোন করুণা না দেখিয়ে আক্রমণ তীব্র করলাম। ভেন্ডালিজমে ইতিমধ্যে যোগ দিল আরও অনেকে। অপর পক্ষ সংখ্যায় আমাদের অতিক্রম করে গেল খুব সহজে। রাস্তা দিয়ে যারাই যাচ্ছিল তারা সবাই যোগ দিল ভাংচুরে।

ইতিমধ্যে পুলিশে খবর দেয়া হয়েছে। পুলিশ আসার আগেই মালিক এসে হাজির। অন্য রেস্টুরেন্ট হতে আরও কজন স্বদেশী হাজির। এবার মালিক আমাদের তিনজনকে দ্রুত কাপড় বদলে রাস্তায় চলে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। কারণ আমরাও ছিলাম টুরিস্ট। এ দেশে কাজ করার অনুমতি নেই।

শেষরাতের দিকে পুলিশ এলো। তাও গোটা দশেক গাড়ি ভর্তি করে। সাথে আসলো স্থানীয় টিভি ও পত্রিকার সাংবাদিকরা। আমরা তিনজন ততক্ষণে চেহারা বদলে মিশে গেছি জনারণ্যে। পুলিশের মোকাবেলা করলো মালিক নিজে ও সাথে আনা বাকিরা। আমাদের গল্প তাদের মুখ হতে বের হল। পুলিশ তা রেকর্ড করলো।

পরদিন স্থানীয় মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হল রাতের কাহিনী। দিনভর পুলিশ ও সাংবাদিকরা ভীর করলো রেস্তোরায়। মালিক আমাদের তিনজনকে পাওনা চুকিয়ে অনুরোধ করলো রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি না আসতে। আমরা পেইংগটন বীচে উন্মুক্ত বক্ষের মহিলাদের ভীর আর কাসিনোর স্লট মেশিনে ঘুরে কাটিয়ে দিলাম গোটা দিন। রাতে ঘরে ফিরে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার ফেরার পালা।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন