"আমি বিদ্যুৎ দিয়েছি, টিভি দিয়েছি..."

Submitted by WatchDog on Saturday, May 27, 2023

একই গল্প বার বার টেনে আনি লেখায়। দু চারজন যারা আমার লেখার সাথে অনেকদিন ধরে আছেন তারা নিশ্চয় বিরক্ত হবেন। তবে আমার বিচারে লেখার কনটেন্ট গুলো প্রাসঙ্গিক এবং বয়সের ভারে নুয়ে পড়েনা।তেমনি একটা গল্প আবারও করতে চাচ্ছি।

এ গল্প নয়, অভিজ্ঞতার ঝাঁপি হতে নেয়া বাস্তব ঘটনা।
পরিবর্তন ঘটছে সোভিয়েত সমাজে। আরও পরিষ্কার করলে বলতে হবে পরিবর্তন অথবা পূর্ণগঠনের চেষ্টা চলছে। এ প্রক্রিয়ার রুশ অনুবাদই হচ্ছে পেরেস্ত্রইকা।

ওয়ান-ম্যান শো সোভিয়েত রাজনীতির কর্ণধার তখন মিখাইল সের্গেইভিচ গর্বাচেভ। ক্ষমতা হাতে পেয়েই গলা পচা সোভিয়েত রাজনীতিকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা শুরু করেন। তারই অংশ হিসাবে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে সীমিত আকারে গণতন্ত্র চর্চার নির্দেশ দেন। তারই ধারাবাহিকতা হিসাবে আমাদের বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদের ক্লাসে বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিতর্কের সুযোগ ইন্ট্রডিউস করা হয়।

আমি যে হলটায় থাকতাম সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন কোনার প্রায় ৫০টা দেশের ছেলেমেয়েদের আবাসন ছিল। স্বভাবতই জীবন ছিল বহুমুখী। তবে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক ছিল ইউনিভার্সিটির যুব কম্যুনিস্ট পার্টি। ঐ পার্টিই নির্ধারণ করে দিত কে হবে হল সংসদের সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক। একবার কেউ নির্বাচিত হলে কোর্স শেষ না করা পর্যন্ত সে-ই বার বার সিলেক্টেড হতো।

সে যাত্রায় উপর হতে নির্দেশন এলো, হল সংসদের নির্বাচন হবে।
ঢাক ঢোল পেটানোর পর এক শনিবার সন্ধ্যায় আয়োজন করা হল ভোটের। হলের কনফারেন্স রুম অনেকে জমায়েত হল। ভোট হবেন ওপেন এবং মুখে মুখে। ব্রীফিংয়ের পর শুরু হল নির্বাচন।

প্রার্থী দুজন। উপস্থিত ভোটারদের কাছে জানতে চাওয়া হল কারা প্রথম প্রার্থীকে হল সংসদের সভাপতি হিসাবে দেখতে চায়।
প্রায় সবাই হাত তুলে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে রায় দিল।
এবার এলো দ্বিতীয় প্রার্থীর পালা।
আবারও সবাই হাত তুলল।
আমার মত যারা নির্বাচন কি তা বুঝতে সক্ষম তাদের ব্যপারটা ব্যাপক হাসির খোঁড়াক যোগাল।
উপস্থিত নির্বাচন কমিশন কি করবে বুঝতে পারল না। আমি দাঁড়িয়ে প্রস্তাব করলাম নির্বাচন হতে হবে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে। এবং তা হবে একজনের এক ভোট নিয়মে।
একজন রুশ ছাত্র রাগে ফেটে পরল। আমাকে আখ্যা দিল বুর্জুয়া সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে। তার মতে দুজন প্রার্থীর দুজনই তার বন্ধু। সুতরাং একজনকে রেখে অন্যজনকে ভোট দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হবেনা। তাই ভোট সিস্টেমে একজনের অগুনিত ভোট দেয়ার অধিকার থাকাটা তার জন্যে ছিল জরুরি।
গোলমাল বেধে গেল নির্বাচনী মাঠে। শুরু হল ঐতিহাসিক রুশ গালা গালি। কমিশন বাধ্য হল নির্বাচন স্থগিত করতে। তবে বেশিদিনের জন্যে নয়।

দ্বিতীয় যাত্রার নির্বাচনে আগে আমি উদ্যোগ নিয়ে হলের বিদেশি ছাত্রদের সাথে কথা বললাম এবং নির্বাচনের রাতে হাজির থাকার জন্যে সবাইকে অনুরোধ করলাম। এ ফাঁকে আমার তিউনেশিয়ার বন্ধুকে সভাপতি ও আফ্রিকার দেশ চাদের ইউনুস ওৎমানকে সাধারণ সম্পাদক বানিয়ে গোপনে একটা প্যানেল তৈরি করে রাখলাম।

আবারও শনিবারের রাত। যুব কম্যুনিস্ট পার্টির অনেক হোমরা চোমরা উপস্থিত। তারা নির্বাচন পরিচালনা করার দায়িত্ব পালন করবে।
প্রার্থী বাছাইয়ের শুরুতেই আমি ঘোষণা দিলাম আমাদের দুই প্রার্থীর নাম। উপস্থিত রুশদের সবাই থ হয়ে গেল। জীবনেও ভাবেনি তাদের আভ্যন্তরীণ ব্যপারে বিদেশিরা নাম গলাবে।
উপস্থিত ভোটারদের চেহারা দেখে নির্বাচন কমিশন বুঝতে পারল ভোট হলে কে জিততে যাচ্ছে।
বিদেশি সভাপতি পার্টির কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলনা। তাই সে রাতে নির্বাচন আর এগোয়নি।

গল্পটার উপসংহার হচ্ছে, গণতন্ত্র হচ্ছে একটি ধারাবাহিক চর্চা। এ চর্চা লম্বা সময় ধরে ব্যহত হলে একটা প্রজন্মের কাছে এর আসল মূল্যবোধ ফিকে হয়ে আসে। এবং এক সময় ভুলে যায় গণতন্ত্র কি এবং কেন। গর্বাচেভের আগে সোভিয়েত দেশে গণতন্ত্র চর্চার রেওয়াজ ছিলনা। ওখানে একে একে শাসন করে গেছে স্তালিন, ব্রেজনেভদের মত একনায়ক ও তাদের অধীনে পরিচালিত ফ্যাসিবাদ।

এবার ফিরে আসি নিজদের পরিচিত পরিবেশের বাংলাদেশে।
এ দেশের জন্ম হয়েছিল গণতন্ত্র বিকাশের পথ ধরে। প্রথমে এর টুটি চেপে ধরেন শেখ মুজিব। এবং সব শেষে তারই কন্যা।
শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসনের ফলে দেশে এমন একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠছে যাদের কাছে গণতান্ত্রিক নির্বাচন এখন একটি অপরিচিত কাঠামো। যত দিন যাবে এ প্রজন্মের পরিসর বাড়তে থাকবে।টিকটক এ প্রজন্মের কাছে গণতান্ত্রিক নির্বাচন, আইনের শাসন, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা সবই হবে ভিন দেশের গল্প যা নিয়ে তাদের সামান্যতম আগ্রহ থাকবে না।

এমন প্রজন্মের কাঁধে ভর করেই জন্ম নেবে নতুন এক কিম জুং উন পরিবার, যাদের ছায়াতলে বেড়ে উঠবে একদল দাস। এই প্রজন্মের কাছেই যখন কেউ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে যাবে তাদের মগজ কাজ করবে আমার হল সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া রুশদের মত।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন