আমেরিকা, ওহ্‌ আমেরিকা! পর্ব-৩

Submitted by WatchDog on Saturday, January 9, 2021

২০০৮ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্টসিয়াল নির্বাচনে ঘটে যায় অভূতপূর্ব ঘটনা। কালো আমেরিকানদের একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে চমকে দেন গোটা পৃথিবী। রাজনীতির মাঠে অনেকটা রকষ্টার কায়দায় প্রবেশ করেন তৎকালীন ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের সিনেটর বারাক হোসেন ওবামা। আমেরিকানদের সাথে গোটা বিশ্ব স্বাগত জানায় আমেরিকার রাজনীতির এই পরিবর্তন। উচ্চা শিক্ষায় শিক্ষিত নন এবং বয়স ৫০'এর উপর এমন কোটি কোটি আমেরিকান এক কালের দাস বংশের প্রতিনিধি কালো আমেরিকানের হোয়াইট হাউসে প্রবেশ মেনে নিতে পারেনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের অস্বস্থী লুকিয়ে রাখেননি। নিজকে সাদা সুপ্রেমেসির প্রতিনিধি হিসাবে চিহ্নিত না করতে আশ্রয় নেয় ভিন্ন পন্থার। দাবি করেন, ওবামা আমেরিকায় জন্ম নেননি এবং যার কারনে তার প্রেসিডেন্সি অবৈধ। দেশটার শাসনতন্ত্র বিদেশে জন্ম নেয়া কাউকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার অধিকার দেয়না। এবং এখানেই তিনি শুরু করেন ওবামা ক্রূসেড। এই ফলস ন্যারেটিভ বিস্তারে তিনি এতটাই সফল্তা লাভ করেন যার কারনে প্রসিডেন্ট ওবামা তার নিজের বার্থ সার্টিফিকেট মিডিয়াতে প্রকাশ করতে বাধ্যহন। জনাব ট্রাম্প থমকে না গিয়ে দাবি করেন, প্রকাশিত সার্টিফিকেট ফেইক।

সাদা আমেরিকার লুকানো ক্রোধ ডোনাল্ড ট্রাম্প অতি যত্ন সহকারে বাইরে আনতে সুক্ষম হন। এবং সাথে মেশান বর্ণবাদ। এই দুইয়ের সমন্বয়ই তাকে সাহায্য করে ২০১৬ সালের দলীয় নমিনেশন পেতে। ঝিমিয়ে থাকা সাদা বর্ণবাদ জেগে উঠে এবং অনেকটা উৎসব কায়দায় ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিতে যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন।

নির্বাচিত হয়ে ট্রাম্প এক মিনিটের জন্যে ভুলে যাননি কাদের ভোটে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবং ৪ বছর পর কাদের ভোট তিনি পুণঃনির্বাচিত হতে পারেন। এমন বাস্তবতা মাথায় রেখেই তিনি ৪ বছর হোয়াইট হাউসে কাটিয়েছেন। তা করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট দেশটার শিকড়ে লুকিয়ে থাকা সাদা বর্ণবাদকে লালন পালন করেছেন। একটা বিশাল সাদা গুষ্টিকে তিনি অন্ধ মুরিদানে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। এই গুষ্টিই তার ' Make America Great Again' নামের ভূয়া ও ভাওতাবাজিকে গ্রহন করেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ভুলে গিয়েছিলেন আমেরিকার সবাই বর্ণবাদী নয়। দেশটার একটা বিরাট অংশ তার মত কোন পীরের ভক্ত নয়। মাথায় তাদের স্থায়ী একটা মগজ আছে এবং ভোটের সময় সে মগজকে তারা কাজে লাগায়। গেল ৪ বছরের ট্রাম্পীয় শাসন কালো ও আমার মত ব্রাউন আমেরিকানদের সয্যের শেষ সীমায় ঠেলে দিয়েছিল। সবাই তৈরী হচ্ছিল নভেম্বরের নির্বাচনের। বিশেষকরে ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস আন্দোলন কালোদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ায় উজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়। এবং গেল নির্বাচনে তারই প্রতিফলন ঘটে। হিলারী নির্বাচনের সময় যা ঘটেছিল এবারের নির্বাচনে তা হতে দেয়নি ডেমোক্রেটরা।

আমেরিকার নির্বাচনে কোন জালিয়াতি হয়না। পেরিয়ড! এদেশের মানুষ আইন অমান্যকরার মত অনেক কাজই করে থাকে, কিন্তু নিজের পয়সায় খেয়ে অন্য কারও জন্যে জালিয়াতি করতে যাবে এমন জাতি আমেরিকানরা না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভোট জালিয়াতির দাবির সামান্যতম কোন ভিত্তি ছিলনা। তিনি তার মুরিদানদের পক্ষে রাখার জন্যে আবিস্কার করেন জালিয়াতির ঐশ্বরিক তত্ত্ব।

ট্রাম্পের ভোট জালিয়াতির দাবির ভিত্তিটা কোথায় আসুন একটু খতিয়ে দেখা যাক। ২০২০ সাল গোট বিশ্বকে গ্রাস করে নিয়েছিল কোভিড-১৯ পেন্ডেমিক। ট্রাম্প শুরু হতে এই মহামারীকে সিরিয়াসলি নেননি। কি করে মহামারী প্রতিরোধ করা যায় তার সামান্যতম চেষ্টা করেননি। নিজে কোনদিন মাস্ক ব্যবহার করেননি। মুরিদানরা তার প্রতি বিশ্বস্ততা প্রমাণের জন্যে তারাও মাস্ক পরতে অভ্যাস করেনি। ভোটকেন্দ্রেও এর প্রভাব পরতে দেখা যায়। পেন্ডেমিক ঠেকানোর অংশ হিসাবে আমার মত অধিকাংশ ডেমোক্রেটই স্বশরীরে ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে মেইল-ইন ব্যলটে ভোট দেয়। অন্যদিকে ট্রাম্প সমর্থকরা পেন্ডেমিক উপেক্ষা করে দলে দলে ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়ে ভোট দেয়।

নির্বাচনের রাতে যেমনটা আশাকরা গিয়েছিল সবকটা অঙ্গরাজ্যে প্রথমে গুনতে শুরু করে যারা ভোটকেন্দ্রে ভোট দিয়েছিল তাদের ভোট। স্বভাবতই ফলাফল ঘোষণার উষালগ্নে বিভিন্ন সুইং ষ্টেইটে ট্রাম্প বিপুল ভোটে এগিয়ে থাকেন। রাত যত গড়াতে থাকে ফলাফল আসতে শুরু করে কাষ্ট করা মেইল ইন ব্যালেটের ফলাফল। এখানেই উলটে যায় ট্রাম্পের ঘণেশ। গভীর রাত পর্যন্ত যে প্যানসেলভেনিয়ায় তিনি এগিয়ে ছিলেন প্রায় ৫ লাখ ভোটে, সে প্যানসেলভেনিয়ায়ই তিনি পিছিয়ে পরেন সূর্য উঠার সাথে। এই অঙ্গরাজ্যের কালো অধুষিত ফিলাডেলফিয়ার ফলাফল আশা শুরু হতে পরিস্কার হয়ে যায় ট্রাম্প হারতে যাচ্ছেন। একই ঘটনা ঘটে মিশিগান ও উইসকন্সিনে। ফলাফলঃ ৭০ লাখ কম ভোট পেয়ে ট্রাম্পের বিশাল পরাজয়। ট্রাম্প রাতে ঘোষিত ফলাফলকে ফাইনাল ফলাফল ধরে তৈরী করেন ভোটার ফ্রড তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অঙ্গরাজ্যের কংগ্রেস, নিম্ন আদালত, উচ্চ আদালত, ফেডারেল কোর্ট ও দেশের সুপ্রীমকোর্ট ছুড়ে ফেলে ভূয়া ও ভিত্তীহীন আখ্যা দিয়ে। তাতে মোটেও দমে যাননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। যেমনটা দমে যাননি ওবামা তার বার্থ সার্টিফিকেট প্রকাশের পর।

৬ই জানুয়ারী ওয়াশিংটনের কংগ্রেস ভবনে ঘটে যাওয়া ঘটনায় অনেকে অবাক হলেও আমি অবাক হইনি। এমনকি মনে মনে আশাকরছিলাম এমন কিছু একটা ঘটুক। ট্রাম্পের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিতে এমন একটা সহিংসতার প্রয়োজন ছিল। কাল ট্রাম্প যা করিয়েছেন এটাই আসল ট্রাম্প। যাদের দিয়ে করিয়েছেন তাদের উপর ভর করেই হোয়াইট হাউসে ঢুকেছিলেন।

এতদিনের বিশ্বস্ত মুরিদদের অনেকেই কেটে পরছে।ইতিমাধ্যে ট্রাম্প কেবিনেটের পরিবহনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, সহকারী নিরাপত্তা উপদেষ্টা সহ আরও অনেকে পদত্যাগ করেছেন। সিনেট ও হাউসের অনেক সদস্য নিজদের দূরে সরিয়ে রাখতে শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে স্পীকার পলোসি ঘোষণা দিয়েছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্টকে ২য় বারের ম্ত ইম্পিচ করার। ডেমোক্রেট ও রিপাব্লিকান নেতাদের অনেকে এক হচ্ছেন শাসনতন্ত্রের ২৫তম সংশোধনী ব্যবহার করে তাকে ক্ষমতা হতে সরিয়ে দিতে। অনেক পন্ডিতদের দাবি, ডোনাল্ড ট্রাম্প যাতে ভবিষতে কোন সরকারী পদে আসীন না হতে পারেন তার জন্যে কংগ্রেসে আইন করা। মোটকথা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিধানের প্যান্ট খসে গেছে। এবার পেব্যাক টাইম। আর যারা গতকাল কংগ্রেস ভবন ক্ষণিকের জন্য দখল করে হম্বি তম্বি করেছিল ছোট হয়ে আসছে তাদের পৃথিবী। ইতিমধ্য চিহ্নিত করা হয়েছে নেতাদের। অনেকে চাকরি হারিয়েছে ইতিমধ্যে। এফবিআই ঘোষণা দিয়েছে তাদের বিচারের আওতায় আনার। এখন দলমত নির্বিশেষে অনেকে একবাক্যে স্বীকার করছেন, গতকালের ঘটনার মূল আসামী হচ্ছেন ডোনাল্ড জে ট্রাম্প।

শেষ।


ভালো লাগলে শেয়ার করুন