শিক্ষাঙ্গনে প্রয়োজন আরো বেশি রাজনীতি - মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

Submitted by WatchDog on Thursday, February 11, 2010

Student Politics

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ.রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সশস্ত্র ক্যাডারদের সংঘাতের ঘটনায় দু’দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে মৃত্যু হয়েছে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু বকরের। কোনো ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত নয়, একজন নিছক জ্ঞানপিয়াসী ক্লাসে প্রথম শ্রেণীতে প্রথমস্থান অধিকারী এমন একজন পড়ুয়া ছাত্রের এই ট্র্যাজিক মৃত্যু দেশবাসীকে মর্মাহত করেছে। দেশের ঐতিহ্যবাহী সর্বোচ্চ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেন এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারল? সবার মনেই আবার পুরনো একটি প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে,- এই মৃত্যু ঘটতে পারার জন্য কি দায়ী নয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত রাজনীতি চর্চা? ছাত্রদের মধ্যে রাজনীতি চর্চা তথা ‘ছাত্র রাজনীতি’ বন্ধ অথবা কমিয়ে দিতে পারলে কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সন্ত্রাস-নৈরাজ্য দূর করা যাবে না? দুটো প্রশ্নেরই ‘হ্যাঁ’ বাচক উত্তরটাই প্রথমে সবার মাথায় আসে। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। ‘ছাত্র রাজনীতির’ প্রসঙ্গটি অত সহজ কোনো ব্যাপারও নয়। এ নিয়ে কিছু বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা যাক।

‘ছাত্র রাজনীতি’ অভিধাটি ষাটের দশকে, আমাদের ছাত্রজীবনে সেভাবে প্রচলিত ছিল না। সে সময় আমরা নিজেদেরকে ‘ছাত্র আন্দোলনের’ কর্মী বলে পরিচয় দিতাম, কখনই নিজেদেরকে ‘ছাত্র রাজনীতির’ কর্মী বলতাম না। যেমন কিনা, শ্রমিক অধিকার আদায়ের সংগঠন ও কর্মকান্ডকে সবাই ‘শ্রমিক আন্দোলন’ বলে থাকে, কেউ তাকে ‘শ্রমিক রাজনীতি’ বলে আখ্যায়িত করে না। একইভাবে নারীসমাজ, যুবসমাজ, আইনজীবী, পেশাজীবী প্রভৃতি অংশের মানুষের নিজস্ব কর্মকান্ডকে কেউ কখনো নারী রাজনীতি, যুব রাজনীতি, আইনজীবী রাজনীতি, পেশাজীবী রাজনীতি ইত্যাদি বলে না। এগুলোকে নারী আন্দোলন, যুব আন্দোলন, আইনজীবী আন্দোলন, পেশাজীবী আন্দোলন বলে আখ্যায়িত করা হয়। ‘ছাত্র আন্দোলন’ না বলে ‘ছাত্র রাজনীতি’ বলা হবে কেন? ‘ছাত্র রাজনীতি’ বললে তা দিয়ে রাজনীতির একটি বিশেষায়িত রূপ প্রকাশ পায়। কিন্তু রাজনীতির বিশেষায়ণ তো সমাজের খন্ড-খন্ড অংশ ধরে পৃথকীকৃত করা যেতে পারে না। কারণ রাজনীতি হলো সমগ্র রাষ্ট্র, রাষ্ট্রপরিচালনা, সরকার ইত্যাদির সাথে সামগ্রিকভাবে সম্পৃক্ত একটি বিষয়। রাজনীতির বিষয়বস্তু হলো সব নাগরিককে নিয়ে (তার কোনো বিশেষ অংশ নিয়ে নয়) রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে পরিচালিত কর্মকান্ড। ডানপন্থী, বামপন্থী কিংবা রুগ্ন, স্বচ্ছ ইত্যাদি ধরনের বিশেষায়ণ দ্বারা রাজনীতির চরিত্র-চেহারা চিহ্নিত করা যেতে পারে, কিন্তু ছাত্র, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইনজীবী, শ্রমিক, কৃষক ইত্যাদি ভিত্তিতে রাজনীতির বিশেষায়ণ একটা বিকৃতির জন্ম দিতে বাধ্য।

১৯৭৬ সালে জেনারেল জিয়া যে পিপিআর তথা রাজনৈতিক দল বিধি জারি করেন তাতে সব রাজনৈতিক দলের জন্য ছাত্র, শ্রমিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিজ নিজ দলীয় অঙ্গসংগঠনের নাম ঘোষণা করাটাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এই বিধিতে বলা হয়েছিল যে, এভাবে অঙ্গসংগঠন চিহ্নিত করে ঘোষণা না দিলে সংশ্লিষ্ট ছাত্র, শ্রমিক ইত্যাদি সংগঠনকে তৎপরতা চালানোর সুযোগ দেয়া হবে না। অবিবেচনাপ্রসূত এ নির্দেশের পেছনে যুক্তি হিসেবে দেখানো হয় যে, এর দ্বারা ছাত্র, শ্রমিক প্রভৃতি সংগঠনের কাজের জবাবদিহি করতে বাধ্য করা যাবে সংশ্লিষ্ট মুরুব্বি রাজনৈতিক দলকে। এভাবে সব ছাত্র, শ্রমিক ইত্যাদি সংগঠনকে কষ্টসাধ্য সরাসরি তদারকিতে না এনেই তাদের মুরুব্বি রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে এনেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা নিশ্চিত করা যাবে। এই আদেশের ফলে ছাত্র সংগঠনগুলো রাতারাতি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়েছিল। এভাবেই শুরু হয়েছিল মিলিটারি বুদ্ধিপ্রসূত এক ধরনের বিকৃতির। এই বিকৃতিই নানা ভয়ঙ্কর রুগ্নতাকে পরবর্তীতে ক্রমাগত লালন ও বৃদ্ধি করেছে।

‘ছাত্র রাজনীতির’ নামে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গত প্রায় তিন দশক ধরে প্রধানত যেসব কর্মকান্ড চলছে সেটা মোটেও রাজনীতি নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক তৎপরতা ও কার্যকলাপকে কোণঠাসা করে তার জায়গা দখল করে নিয়েছে কুৎসিত দলবাজি, চর দখলের কায়দায় দখলদারি, সন্ত্রাসী মাস্তানি, ক্যাডার বাহিনী নামে দুর্বৃত্তদল লালন, ক্রিমিনালদের আশ্রয়দান। রাজনীতির গন্ধ লাগানোর জন্য তার সাথে আছে নেতা-নেত্রী ভজন, দলীয় শ্লোগানের জজবা উঠানো, জোর-জবরদস্তি করে অথবা নানা সুবিধার উচ্ছিষ্ট বিতরণ করে হল-হোস্টেল ও পাড়া-মহাল্লার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে দলীয় শো-ডাউন করা, মুরুব্বি দলের ‘বড় ভাইদের’ পক্ষ হয়ে উপদলীয় তৎপরতায় শক্তি যোগানো, দল-উপদলের প্রয়োজনে পেশীশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন ইত্যাদি। রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন বনে যাওয়ায় মুরুব্বি দলের যতসব রুগ্নতা ও অধঃপতনের ধারা, তার সবটাই ষোল আনা পরিমাণে সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠনগুলোকেও গ্রাস করে ফেলেছে। দেশি-বিদেশি শাসক শ্রেণীর সুপরিকল্পিত পরিচালনায় জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে কেন্দ্র করে যে ডি-ফেক্টো দ্বি-দলীয় মেরুকরণ ভিত্তিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে তার বদৌলতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল তাদের নিজেদের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর থেকে কর্তৃত্ব ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুক্তবাজার অর্থনীতি ও তার স্বাভাবিক ফলাফল বাজার রাজনীতির দুরাচারে নিমজ্জিত হয়ে যে বাণিজ্যিকীকরণ ও দুর্বৃত্তায়নের সর্বগ্রাসী প্রলয় সৃষ্টি করেছে, তা আরো ভয়াবহ রূপ নিয়ে প্রবিষ্ট হয়েছে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলে। এভাবে তারা সাধারণ ছাত্র সমাজের প্রকৃত স্বার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাস্তানতন্ত্রের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরে পরিণত হয়েছে। মৌলবাদী শিবির চক্র এই সুযোগ নিয়ে তাদের ভয়ঙ্কর দেশদ্রোহী তালেবানি এজেন্ডা এগিয়ে নিচ্ছে। বিএনপি-র ছত্রচ্ছায়া থেকে এবং জামায়াতের সহায়তায় বিপুল পরিমাণ বিদেশি টাকায় পুষ্ট হয়ে শিবিরও অনেক প্রতিষ্ঠানে ঘাঁটি গেড়ে বসতে পেরেছে। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। শুধু মুরুব্বি দলের আজ্ঞাবাহী লেজুড় ও তার স্বার্থে পেশীশক্তি হিসেবে কাজ করাই নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা (ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল) পরিণত করেছে কোটি কোটি টাকার অবৈধ উপর্জনের উৎসে। কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে কমিশন খাওয়া, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়, হাইজ্যাকার দলকে লালন, তদবির বাণিজ্যসহ কতকিছু। এসব থেকে কামাই হয় কোটি কোটি টাকার লুটের মাল। সেই লুটের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে অনেক সময়ই সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব। কখনো দুই দলের মধ্যে, কখনো আবার একই দলের দুই বা অধিক গ্রুপের মধ্যে। তা থেকে শুরু হয় গোলাগুলি, সংঘাত, সংঘর্ষ। সিক্সটি-ফোরটি ধরনের ভাগ-বাটোয়ারার ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত এই সংঘাত চলতেই থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভিত্তি করে সৃষ্টি হয় কায়েমি স্বার্থ ও সেই স্বার্থ রক্ষার সাংগঠনিক ব্যবস্থা। ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল উভয়ই হয়ে পড়েছে এই ব্যবস্থার হাতে জিম্মি, তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। চাইলেও তারা কেউ এই জাল থেকে বের হতে পারবে না। ক্রিমিনালদের যে কোনো উপায়ে সঙ্গে রাখতেই হবে, তা না হলে তারা যে অন্য পক্ষে চলে যাবে। তাই ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল কেউই তাদের সংগঠনকে ক্রিমিনালমুক্ত করার পদক্ষেপ নিতে পারে না। সেটা তো হবে সংগঠনের জন্য আত্মঘাতী, প্রতিপক্ষের জন্য হবে পোয়াবারো। প্রতিপক্ষের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে যত বেশি সম্ভব সংখ্যায় ক্রিমিনালদের সংগঠনে রাখতেই হবে। গত এক বছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কম করে হলেও দেড় ডজনবার এসব অপরাধমূলক কাজ থেকে নিবৃত্ত থাকার জন্য ছাত্রলীগের প্রতি সতর্কবাণী এবং ‘কঠোর সতর্কবাণীও’ প্রদান করেছেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজই হয় নি। এর কারণ কি? কারণ হলো দু’টি। এক. ছাত্রলীগ এই সতর্কবাণী মেনে সংগঠনকে পরিশুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে না। আর দুই, প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবাণীর ভয়ের চেয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা লুটপাট করার প্রলোভন অনেক বেশি শক্তিশালী। কথায় বলে ‘পৃথিবীটা কার বশ? পৃথিবী টাকার বশ।’

এ প্রসঙ্গে ছাত্রদলের কথা আর আলোচনার কোনো প্রয়োজন থাকে না। ছাত্রলীগের বর্তমানটা অধঃপতিত হলেও তার অতীতের একটা আদর্শবাদী রাজনৈতিক ঐতিহ্য রয়েছে। আর ছাত্রদল গঠিতই হয়েছিল সামরিক আইন ও রাষ্ট্রক্ষমতার প্রত্যক্ষ ছত্রচ্ছায়ায়, পিপিআর-এর আওতায়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পর্ব ছাড়া সাধারণ ছাত্রসমাজের স্বার্থে লড়াই করার কোনো ঐতিহ্য তার প্রায় নেই বললেই চলে। বিএনপি-র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির অনুষঙ্গ এবং ক্ষমতাধর (অথবা ক্ষমতাপ্রত্যাশী)-দের পেশীশক্তির ভূমিকা পালন করাই তাদের ঐতিহ্য। দ্বি-দলীয় মেরুকরণভিত্তিক ব্যবস্থার ফলে ছাত্রলীগের সামনে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রটাও পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে মূল প্রতিযোগিতা করতে হতো ছাত্র ইউনিয়নের সাথে। এখন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো ছাত্রদলের সাথে। আদর্শবোধ, দেশপ্রেম ইত্যাদি বাদ দিয়ে তাকে দক্ষিণপন্থা, নেতা-নেত্রী ভজন, মাস্তান বাহিনী সমবেত করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ছাত্রদলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে। ফলে অধঃপতন ঘটছে তারও। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, স্বাস্থ্য সংক্রামক নয়, কিন্তু রোগ সংক্রামক। তিন দশক ধরে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের চাল-চলন পর্যালোচনা করলে এই কথার সত্যতা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়।

যখন থেকে ছাত্রদলকে বানানো হয়েছে ছাত্রলীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন থেকেই ছাত্রলীগের চরিত্রের অধোগতি। ছাত্রদলের সাথে তাকে দুষ্কর্মের প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছে, ছাত্রদলকেও সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকতে হয়েছে এবং এভাবেই উভয়ে আজ দুষ্কর্মের ফাঁদে জিম্মি হয়ে পড়েছে। কিন্তু আশির দশকের আগে যখন ছাত্রলীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বামপন্থী আদর্শবাদী সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন, তখন তাকে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে আদর্শবাদিতা ও দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক চেতনা ও উন্নত সাংস্কৃতিক-মানবিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে। সুন্দরের কম্পিটিশনে টিকে থাকার জন্য তাকেও সুন্দর হওয়ার চেষ্টা করতে হয়েছে। কিন্তু শাসক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আজ নানাভাবে ছাত্র ইউনিয়নকে দুর্বল ও প্রান্তস্থিত করে ফেলা হয়েছে। প্রকৃত রাজনীতিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্বাসিত করা হয়েছে।

একথা আজ তাই দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে দুষ্কর্ম, অনাচার ও নৈরাজ্যমূলক কাজকর্ম ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নামে চালানো হচ্ছে তা রাজনীতি নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনীতিকে বস্তুত নির্বাসিত করা হয়েছে। তিন দশক ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এক হিসেবে ‘রাজনীতি শূন্য’ হয়ে আছে। যেটুকু রাজনীতি আছে তা বহন করে চলেছে ছাত্র ইউনিয়নসহ বামপন্থী সংগঠনগুলো। কিন্তু দ্বি-দলীয় মেরুকরণ ভিত্তিক ব্যবস্থায় তাদেরকে প্রবল প্রতিকূলতার মাঝে কাজ করতে হচ্ছে। চলতি হাওয়ার দূষিত প্রবাহের উল্টো ধারায় তাদেরকে উজান ঠেলে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হচ্ছে। অবশ্য তাদের অপেক্ষাকৃত সেই ক্ষীণ শক্তিই নিশ্চিত করছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অতীত ঐতিহ্যের জাগরুক থাকাটা। সামসুন্নাহার হলের আন্দোলন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আগস্ট ছাত্র বিদ্রোহ, যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতার জাগরণ ও লাগাতার আন্দোলনের ধারা, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা, সৃজনশীল তত্ত্ব চর্চা- বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের এসব ঐতিহ্যগত ধারা প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও এখনো সুদৃঢ়ভাবে ক্রিয়াশীল আছে।

ছাত্ররা সমাজেরই একটি অংশ। ছাত্র পরিচয়ের সামাজিক সত্তা হিসেবে তাদের আছে সাধারণ অনেক আশা-আকাক্ষা, চাওয়া-পাওয়ার বিষয়। এসব বিষয়কে অবলম্বন করেই পরিচালিত হওয়া উচিত ছাত্রদের নিজস্ব আন্দোলন ও সংগঠন। দলমত-আদর্শ ও ধর্ম-বর্ণ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে সংগঠন গড়ে তুলতে পারলেই তাদের আশা-আকাঙক্ষা বাস্তবায়ন সম্ভব। ক্লাসরুমের ভাঙা বেঞ্চ-ব্ল্যাকবোর্ড মেরামত, বই-কাগজ-কলমের দাম কমানো, পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষকের ব্যবস্থা ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়সহ গণমুখী প্রগতিশীল শিক্ষানীতি, শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ প্রভৃতি ছাত্র সমাজের প্রত্যক্ষ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে ভিত্তি করে ছাত্রসমাজের একতা ও ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়তে হবে। কিন্তু এসব ছাড়াও পরোক্ষ (অথবা প্রচ্ছন্নভাবে প্রত্যক্ষ) নানা বিষয়ও আছে। যেমন পড়াশুনায় পূর্ণ মনোনিবেশের স্বার্থে এবং গরিব বন্ধুকে অব্যাহতভাবে সহপাঠী হিসেবে পাওয়ার স্বার্থে দেশের সব পরিবারে দারিদ্র্য নিরসন, জ্ঞান অন্বেষণর জন্য মুক্তচিন্তার পরিবেশ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার নিশ্চয়তা ইত্যাদি। তাছাড়া শুধু বইয়ের পোকা হয়ে থাকাই নয়, তাদের মধ্যে প্রকৃত দেশপ্রেমিক, মানবিক মূল্যবোধ, মননশীলতা ও সৃজনশীল প্রতিভার জাগরণ ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের দেশ ও মানব সভ্যতা নির্মাণের কারিগররূপে গড়ে তোলা যে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য, সে কথাও মনে রাখা বাঞ্ছনীয়। তাই গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, শোষণমুক্তি, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের অবসান, দেশপ্রেম, উদার মানবিকতা, প্রগতিমুখীনতা, বিজ্ঞান মনস্কতা- ইত্যাদি বিষয়ও ছাত্রসমাজের সাধারণ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়। এসব বিষয়ের সাথে দেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক নীতি, রাষ্ট্র-ব্যবস্থা, সরকারি নীতি ইত্যাদি জড়িত। ছাত্রসমাজের শিক্ষা জীবনের নানাবিধ মৌলিক চাহিদাই এসব বিষয়ের সাথে ছাত্রদেরকে সরাসরি সম্পৃক্ত করে তোলে। এগুলোই ছাত্রসমাজের নিজস্ব আশা-আকাঙক্ষা ও চাওয়া-পাওয়ার সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ‘রাজনীতির’ বিষয়। তবে এগুলো ‘রাজনীতির বিষয়’ হলেও নিছক ‘দলীয় বিষয়’ মোটেই নয়। তাই, ‘দলবাজি’র বিষয়ও নয়। ছাত্র সমাজের প্রত্যক্ষ স্বার্থের সাথে জড়িত রাজনীতির বিষয়। ছাত্রসমাজের রাজনীতি করার অধিকার সে কারণেই তার স্বার্থ আদায়ের প্রশ্নের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। রাজনীতি করা আর দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা দুটো এক জিনিস নয়। ছাত্রদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা (যা বর্তমানের চরম রুগ্নতা ও অধঃপতনের উৎস হয়ে উঠেছে।) বন্ধ করা উচিত, কিন্তু তাদের রাজনীতি করাকে (যা অতীতের ঐতিহ্যের ধারায় তাদেরকে দেশপ্রেম ও আদর্শবোধে উদ্বুদ্ধ করে শিক্ষার প্রকৃত পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে) উৎসাহিত করা উচিত।

সবশেষে যে কথাটি তা হলো, ছাত্ররা বয়সে তরুণ। এই বয়সটা প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনের শ্রেষ্ঠ সময়। ছাত্র বয়সের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো নিজের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও তার প্রদর্শন। অপ্রতিরোধ্য এই বয়সের এই অপ্রতিরোধ্য প্রবণতা ও তাগিদকে কেউ অবদমিত করে রাখতে পারবে না। কিন্তু ব্যক্তিত্বের আত্মপ্রকাশ ঘটানোর পথের ক্ষেত্রে বিকল্প হলো দু’টো। হয় তার অভিপ্রকাশ সুস্থ পথে হবে, না হয় তা ঘটবে দুষ্ট পথে। রাজনীতির দরজা অবধারিত রাখতে পারলেই সুস্থ ধারায় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ও প্রদর্শনের পথ করা যাবে। সেই পথ রুদ্ধ করলেই আবির্ভাব ঘটবে অনাচার ও অপরাধমূলক প্রবণতার। কেবল শুদ্ধ রাজনীতির প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারলেই সম্ভব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান কলুষতা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা। প্রয়োজন, আরো কম রাজনীতি নয়- আরো বেশি রাজনীতি।

ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলকে দিয়ে সে কাজটি করা যাবে বলে একেবারেই মনে হচ্ছে না। ছাত্র ইউনিয়ন ও বামপন্থী সংগঠনগুলোই পারতে পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কলুষতা দূর করে দেশপ্রেম, আদর্শবাদ, ত্যাগ, সৃজনশীলতা, প্রগতিমুখীনতার সুবাতাস প্রবাহিত করতে। সেই কাজের মধ্য দিয়েই ছাত্র আন্দোলনের স্বর্ণময় অতীত, গৌরবের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে। তাই প্রয়োজন আরো কম রাজনীতি নয়- বরং আরো বেশি রাজনীতি।

পুনশ্চ: লেখাটি শেষ করে আনার পর জামায়াতের উস্কানি ও প্রত্যক্ষ সহায়তায় ইসলামী ছাত্র শিবিরের সশস্ত্র সাম্প্রদায়িক ঘাতক বাহিনী গত সোমবার রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে নৃশংস হামলা চালিয়ে ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেনকে হত্যা করে তার লাশ ম্যানহোলে নিক্ষেপ করেছে। হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়াসহ বহু ছাত্রকে মারাত্মকভাবে আহত করেছে। গত বছর ঢাকার পিলখানায় সেনা অফিসার হত্যা করে লাশ ম্যনহোলে ফেলে দেয়ার ঘটনার বিচারের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি সব মহল থেকে তোলা হয়েছে এবং সেই মোতাবেক যেভাবে কঠোরতার সাথে বিচার প্রক্রিয়া ও বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ চলছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকান্ডের বিচার ও ইসলামী ছাত্র শিবিরকে ডিসব্যান্ড (অবলুপ্ত) করার জন্য পদক্ষেপ কি একই যুক্তিতে অপরিহার্য নয়?

[মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি]

ভালো লাগলে শেয়ার করুন