১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা

দীর্ঘতম জবানবন্দি শাহাবের

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ১৬৪ ধারায় দীর্ঘতম এক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে রেকর্ড সৃষ্টি করলেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)’র সাবেক পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) শাহাব উদ্দিন। চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক ঘটনায় দায়েরকৃত চোরাচালান মামলায় এনএসআই’র গ্রেপ্তারকৃত এ সাবেক পরিচালক গতকাল চট্টগ্রাম মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবর রহমানের কাছে প্রায় সোয়া ১০ ঘণ্টা স্থায়ী জবানবন্দি দিয়ে ফৌজদারি মামলায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ইতিহাসে ব্যতিক্রমী এক নজির স্থাপন করেন। সিআইডি সূত্র জানান, ম্যাজিস্ট্রেটের খাস কামরায় শনিবার বিকাল সোয়া ৪ টা থেকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে শুরু করেন শাহাবউদ্দিন। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে রাত ২টা ৩৫ মিনিটে শেষ হয় জবানবন্দি রেকর্ড করা। এর মধ্যে অবশ্য ক্লান্তিজনিত বিরতি ও চা বিরতি নেয়া হয় কয়েকবার। আদালত সূত্র জানান, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট ফরমেট যুক্ত কাগজপত্র শেষ করে শাহাবের জবানবন্দি রেকর্ড করতে আরও ৩১ পৃষ্ঠা কাগজ লাগে। ফৌজদারি মামলায় দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞ একজন প্রবীণ আইনজীবী বলেন, এত দীর্ঘ সময় ধরে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়ার কোন ঘটনা তার জানা নেই। তিনি বলেন, এটিই হয়তো হবে সাম্প্রতিক সময়ের দীর্ঘকালব্যাপী ও দীর্ঘতম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। উল্লেখ্য, এটি হচ্ছে উইং কমান্ডার শাহাবের ১৬৪ ধারায় দ্বিতীয় দফা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। শনিবার তিনি যে মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সেটি হচ্ছে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক ঘটনায় দায়েরকৃত দু’টি মামলার একটি অস্ত্র চোরাচালান মামলা। এ মামলায় চার দিনের রিমান্ড শেষে শনিবার অপরাহ্নে তাকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার জন্য মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবর রহমানের চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়া, না দেয়ার সিদ্ধান্ত ভেবে দেখার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়মমাফিক তাকে ৩ ঘণ্টা সময় দেন। পরে বিকাল সোয়া ৪টার দিকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে শুরু হয় তার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান। জবানবন্দি শেষে রাত ২টা ৩৫ মিনিটের দিকে এনএসআই’র সাবেক পরিচালক উইং কমান্ডার শাহাবউদ্দিন ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন। সিআইডির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)’র সাবেক উইং কমান্ডার শাহাবউদ্দিন জবানবন্দিতে ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার ও চোরাচালান ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেন। এ সময় তিনি এ ঘটনার সঙ্গে সরাসরি তার সম্পৃক্ততা স্বীকার না করলেও জবানবন্দিতে আগের জবানবন্দির মতো এবারও বারবার তিনি উল্লেখ করেন, যা কিছুই করেছি বা করতে হয়েছে, তার সবকিছুই, অধঃস্তন হিসেবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ও পরামর্শে করেছি। পালন করেছি সরকার অর্পিত দায়িত্ব। অতএব, এসবের দায় সরকারের নীতি নির্ধারক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। তিনি জানান, ১০ ট্রাক অস্ত্র দেশে আসার ব্যাপারে তৎকালীন সরকারে বেশ কয়েকজন নীতিনির্ধারক এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)’র সাবেক দুই মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, সাবেক উপ-পরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেনও সব জানতেন। তারা এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে তিনি উল্লেখ করেন। এরা এ ঘটনার অনেক কিছুই জানেন বলে শাহাব বারবার দৃঢ়তার সঙ্গে জানান। শাহাব তার জবানবন্দিতে এ ব্যাপারে তাদের সম্পৃক্ততার বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। ১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনার ব্যাপারে তার জানা সব বিষয়ের অনুপঙ্খ বর্ণনা তিনি তার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন বলেই জবানবন্দি রেকর্ডে এত বেশি সময় লাগে বলে সিআইডি সূত্র জানান। জবানবন্দিতে এছাড়াও তিনি ঘটনার ব্যাপারে আরও বেশ ক’জন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করেন বলে জানা যায়। নিজেকে অনুগত একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে উল্লেখ করে শাহাব বলেন সরকারি কর্মচারী হিসেবে তিনি ঊর্ধ্বতনের আদেশ মানতে বাধ্য ছিলেন। তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে এ ঘটনার কোন কিছুর সঙ্গেই সম্পৃক্ত নন বলে জানান। এ সময় তিনি সরকারের কয়েকজন নীতিনির্ধারকের কথা বললেও তাদের কারও নাম সরাসরি উল্লেখ করেননি। বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন কিনা এ ব্যাপারেও তিনি সরাসরি নাম উল্লেখ করে কোন কথা বলেননি বলে জানান সিআইডি সূত্র। সূত্র মতে, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)’র সাবেক পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) শাহাব উদ্দিন দীর্ঘ সময় ধরে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও এতে তেমন নতুন কিছু পাওয়া যায়নি। এর আগে দেয়া তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও তিনি এসব কথার বেশির ভাগই বলেছেন। তবে এবারের জবানবন্দিতে অনেক ঘটনার বিশদ বয়ান রয়েছে। কিন্তু যা কিছুই তিনি বলেছেন তা বলেন নিজের গা বাঁচিয়ে। এর আগে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের অপর এক মামলায়ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)’র এ সাবেক পরিচালক শাহাবউদ্দিন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে অবশ্য তিনি আদালতে তার এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেন। আবেদনে তিনি বলেন, তার ওপর বলপ্রয়োগ করে এ জবানবন্দি আদায় করা হয়। এরপর আবার গত শনিবার তিনি ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক এ জবানবন্দি দিলেন। উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ১লা এপ্রিল সরকারি মালিকানাধীন চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল)’র সংরক্ষিত জেটিতে নোঙর করা ট্রলার থেকে খালাস করার সময় ১০ ট্রাক অস্ত্রের বৃহত্তম চালান আটক করে পুলিশ। এ নিয়ে দেশে বিদেশে তোলপাড় হয়। মামলা হয় দু’টি। সে সময় এ নিয়ে বেশ ক’দিন তোলপাড় চললেও রহস্যময় কারণে মামালা দু’টির কার্যক্রম তেমন আর এগোয়নি। আটককৃতরাও অনেকে জামিনে বেরিয়ে যায় জেল থেকে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার নতুন করে গতি পায় ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনা। এরপর এনএসআই’র ২ সাবেক মহাপরিচালক ও পরিচালক শাহাবসহ একে একে এনএসআই’র ৫ কর্মকর্তা এ ব্যাপারে গ্রেপ্তার হন।