হোয়াই চ্যাপেলের কলাপাতা...

Submitted by WatchDog on Monday, January 1, 2024

গেল সেপ্টেম্বরের ইউরোপ ভ্রমণ ছিল সারপ্রাইজে ভরপুর। বিশেষকরে দুই সন্তানের জন্যে। ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি তাদের একমাত্র মামু ও নানী পেরু হতে উড়ে এসে লন্ডনে দেখা করবে। গোটা ব্যপারটাই চেপে রাখা হয়েছিল। আরও সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল পেরুর রাজধানী লিমার হোরহে চাভেস এয়ারপোর্টে।

ওদের মামু, অর্থাৎ আমার শ্যালক তার মা'কে অর্থাৎ আমার শাশুড়িকে বিদায় জানাতে এসেছে এয়ারপোর্টে। সব আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্ত করে মা এগিয়ে চলছেন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইটের দিকে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করে লক্ষ্য করলেন তার সন্তানও পিছু পিছু আসছে। ভাবলেন নিশ্চয় মারাত্মক কিছু ঘটে গেছে।

মা'কে অবাক করে দিয়ে সন্তান জানালো মার সাথে সেও যাচ্ছে লন্ডন। টিকেট সহ বাকি সব আগেই ঠিক করা আছে। শুধু সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যে দ্বিতীয় কাউকে জানানো হয়নি।

হিথ্রু এয়ারপোর্টের ৩নং টার্মিনালে আমরা কেন অপেক্ষা করছি তার কোন কারণ সন্তানদের বুঝানো গেলনা। ওভার নাইট লম্বা ফ্লাইটের পর সবাই ক্লান্ত। ওদের বিশ্রাম দরকার, বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছিল না।
প্রায় ২ ঘণ্টা অপেক্ষার পর টার্মিনালের এক্সিট দরজায় দেখা গেল দুজনকে। আমার দুই সন্তানের মুখে কোন ভাষা নেই। ওদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে এমনটা কি করে সম্ভব!

আনন্দ উল্লাসের নহর বয়ে গেল এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে। একসাথে দুইজন, মামু ও নানী!
সারপ্রাইজের আরও কিছু বাকি ছিল।
এবার দৃশ্যপটে হাজির হল আমার বন্ধু হাসান। ৩৬ বছর পর দেখা। শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। এবং এই লন্ডনেই।

কুইন এলিজাবেথ লাইনটা বোধহয় নতুন। গেল শতাব্দীর শেষদিকে যখন এ দেশে শেষবার এসেছিলাম এমন একটা লাইনের নাম শুনিনি। হিথ্রু হতে পূর্ব লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল যেতে চাইলে ট্রেন বদল করার দরকার হয়না। একটু সময় লাগলেও জার্নিতে কোন অপ্রত্যাশিত ঝামেলা ছিলনা।

হোয়াইট চ্যাপেল রোডের উপর এয়ারবিএনবি'র ফ্লাটটা খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধা হলোনা। দুই রুমের ফ্লাটে যথেষ্ট জায়গা ছিল বন্ধু হাসান সহ ছয় জনের রাত্রি যাপনের জন্যে।

ফ্লাটে সবকিছু গুছিয়ে দ্রুত একটা সাওয়ার দিয়ে সবাই বেরিয়ে পরলাম দুপুরের খাবারের সন্ধানে। আকাশের অবস্থা খুব একটা ভাল ছিলনা। বৃষ্টির লক্ষণ চারদিকে।
হোয়াইট চ্যাপেল বাঙালি পাড়া। টিউব স্টেশনের নামও বাংলায় লেখা। চারদিকে বাঙালি গ্রোসারী, রেস্টুরেন্টের সমারোহ।
বন্ধু হাসান জানালো দুপুরের খাবারের জায়গা সে আগেই ঠিক করে রেখেছে।কলাপাতা নামের একটা রেস্টুরেন্টে তার পরিচিত কেউ আছে।

ভর দুপুর বেলা তাই রেস্টুরেন্ট অনেকটাই ফাঁকা।
মেনু নিয়ে সবার চোখে মুখে এক ধরণের উৎকণ্ঠা। বিশেষকরে পেরুভিয়ানদের।

বাকিদের বিশেষ কোন সুযোগ না দিয়ে আমিই অর্ডার করলাম। বেশিরভাগ তন্দুরি ডিশ। তন্দুরি প্লাটার, চিকেন তন্দুরি। নান ব্রেড। জেসমিন চালের সাদা ভাত। তারকা ডাল। আর আমার জন্যে সর্ষে ইলিশ।
শুরু হল লন্ডনের মাটিতে আমাদের প্রথম খাওয়া দাওয়া।

অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যাদের নিয়ে উৎকণ্ঠা ছিল তাদের সবাই চেটেপুটে খাচ্ছে আমাদের খাবার। একটা আইটেমও বাদ যাচ্ছেনা। এমনকি আমার সর্ষে ইলিশই খানিকটা ট্রাই করলো।

এবং এখানেই শুরু। বেশ রাত করে ঘরে ফিরতে গিন্নীই প্রস্তাব দিল যেহেতু বাংলাদেশি রেস্তোরা পাশেই তাই ওখানেও যাওয়া হোক ডিনারের জন্যে। এবারের ডেসটিনেশন আল বোরাকা নামের অন্য একটা বাংলাদেশি রেস্তোরা।

এবার আর আমার পছন্দ করার অবকাশ ছিলনা। ওদের অনেকেই বুঝে গেছে তন্দুরির মাধুর্য।
টেবিল তলিয়ে গেল বিভিন্ন খাবারে। এবং এবারও তন্দুরির প্রাধান্য। এ যাত্রায় আমার পছন্দ রূপচান্দা মাছ।
বিল পরিশোধ করে খাবার যা অবশিষ্ট ছিল তা প্যাকেট করে ঘরে ফিরে আসলাম।

যা আশা করেছিলাম অনেক রাত পর্যন্ত গল্প চলল। বিশেষকরে আমি ও আমার বন্ধু নিজেদের অতীত রোমন্থন করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম।
রান্নাঘরে গেলাম কফি বানাবো বলে। ওখানে বাচ্চাদের মামু ও নানীকে দেখে অবাক। ওরা রেস্টুরেন্টের অবশিষ্ট খাবার শেষ করছে।

এবং এরপর যতদিন লন্ডনে ছিলাম লাঞ্চ ও ডিনার দুটোই সারতে হয়েছে হয় কলাপাতা অথবা বোরাকা রেস্তোরায়।
সারারাত জার্নি করে প্যারিস হতে লন্ডন ফিরে আসা মাত্র আমার ইন-ল'রা জানালো দুপুরের খাবারের জন্যে ওরা কলাপাতায় যেতে চায়। আমি কেবল মুচকি হাসলাম!

ভালো লাগলে শেয়ার করুন