সাগর পাড়ের সেতুবন্ধন!

Submitted by WatchDog on Wednesday, October 4, 2023

কার্তাজেনা দ্যা ইন্ডিয়াস...কলোনিয়াল সময় হতে এ নামেই পরিচিত শহরটা। যদিও নামের দ্যা ইন্ডিয়াস অংশটা অনেকে ইচ্ছা করে উচ্চারণ করে না উপনিবেশবাদের গন্ধ আছে বলে। সান্তা মার্তা হতে যাত্রা করে বারাংকিয়া হয়ে এ বন্দর নগরীতে পৌছতে বেলা অনেকটাই গড়িয়ে গেল।

ব্যাক-প্যাকটা হোটেলে রেখে বাইরে পা রাখতেই বাতাসে নোনা পানির গন্ধ পেলাম। সামনে নিশ্চয় ক্যারিবিয়ান সাগর।

ক্ষুধায় ততক্ষণে পেট চো চো করছে। রেস্টুরেন্টের খোঁজে মিনিট পাঁচেক এলোমেলো হাঁটলাম। দূরে গম্বুজের মত কিছু একটার উপর আলিশান একটা ফ্ল্যাগ উড়ছে। ওটাকেই লাইট হাউস হিসাবে ধরে নিলাম। রাস্তা হারিয়ে হোটেলে ফিরতে অসুবিধা হলে ওটাই হবে আমার গাইডিং লাইট।
পকেটে ক্রেডিট কার্ট আর সাথে বৈধ কাগজপত্র থাকলে পৃথিবীর এসব অংশে হারিয়ে যাওয়ায় কোন অসুবিধা নেই। বরং তেমন কিছু হলে অতিরিক্ত কিছু এডভেঞ্চার ভ্রমণ ঝুলিতে যোগ হয়, যা বাকি জীবন হাতড়ে বেড়াতে ভাল লাগে।

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলোম্বিয়ার উত্তর পশ্চিমের বন্দর নগরী কার্তাজেনা। দেশটার পুরানো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মাইলস্টোন হিসাবে বিবেচিত হয় এ শহর। অতীতে জলদস্যুর দল বিনা বাধায় এ বন্দরে নোঙ্গর করতো তাদের নৌ বহর। ঘাটি গেড়ে অনেকে স্থায়ী হয়ে যেতো। শহরের প্রতিটা ইট ইতিহাসের সাক্ষী। টুরিস্ট গাইডরা গর্বভরে স্মরণ করে তাদের অতীত, হোক তা জলদস্যুদের।
আরও দক্ষিণে মেডিইন শহর। কলোম্বিয়ার ড্রাগ লর্ডদের অভয়ারণ্য। প্রথমবার যখন অস্ট্রেলিয়ান হয়ে দেশটায় আসি অনেকেই সাবধান করে দিয়েছিল নিজ দেশের পরিচয় নিয়ে যেন উচ্চবাচ্য না করি। বরং স্থানীয়দের মিছিলে নীরবে নিঃশব্দে মিশে গেলেই নাকি বেশি নিরাপদ। তাছাড়া আমার চেহারার মানুষদের অভাব নেই কলোম্বিয়ায়।

সপ্তাহ খানেকের মিশন নিয়ে এ শহরে এসেছি ক্যারিবিয়ান সাগরের নোনা পানিতে ডুবে থাকতে। এর তীর ঘেঁষে যে জীবন তাকে কাছ হতে দেখতে। প্রিয় লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস জীবনের একটা সময় কাটিয়ে গেছেন এ শহরে। বিখ্যাত উপন্যাস 'শত বর্ষের নীরবতা'র কিছু অংশ এ শহরে বসেই নাকি লিখে গেছেন। লেখকের বাসস্থান, এ শহরে কাটানো সময়ের বিভিন্ন স্মৃতি কাছ হতে দেখাও ছিল উদ্দেশ্যের তালিকায়।

সাগরের তীর ঘেঁষে অসংখ্য ফুড ট্রলি দাঁড়িয়ে আছে। ভেন্ডারদের হাঁকডাকে সরব হয়ে আছে ক্যারিবিয়ান সাগর পাড়। টুরিস্টদের ভিড় চোখে পরার মত। অনেকে খোলা আকাশের নীচে বার-ব্যি-কিউ করছে। ধোঁয়ার সাথে পোড়া মুরগীর মৌ মৌ গন্ধ মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে।
জায়গায় জায়গায় দলবেঁধে অনেকে আড্ডা দিচ্ছে। গীটার, ড্রাম সহ বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজর মনে করিয়ে দিচ্ছে জীবন এখানে অন্যরকম। নরনারীদের অনেকের শরীরে আদৌ পোশাক আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে কাছে যেতে হয়। শরীর ঢাকা নিয়ে কারও কোন বাড়াবাড়ি নেই। উপরের অংশ উদাম করে মেয়েদের অনেকেই উপভোগ করছে সূর্যস্নান। বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস আকাশে বাতাসে।

স্ট্রীট কার্ট হতেই সেরে নিলাম দুপুরের খাবার। পইয়ো ল্যা ব্রাসা..ধূমায়িত রোষ্ট চিকেন, সাথে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই।
বীচেই পরিচয় অন্য এক ভেন্ডারের সাথে। রাতের পার্টির টিকেট বিক্রি করছে। শহরে নতুন। কোথায় কি তা বুঝে নিতে সময় লাগবে। হাতে খুব একটা সময় নিয়ে এখানে আসিনি। তাই রাস্তার ফেরিওয়ালাদের বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় ছিলনা। রাতে বিছানায় নেয়ার জন্যে অনেকে যুবতীদেরও বিক্রি করছে।

চিভা পার্টি বাসের কথা আগেই শুনেছি। এখানে আসার আগে অনলাইন সার্চে বার বার শব্দটা সামনে আসছিল। কার্তাজেনা ভ্রমণে রাতের এ পার্টি যেন মিস না করি তার রিকমেন্ডেশন ছিল সর্বত্র।

খোলামেলা একটা বাস। লন্ডন সিডনির ট্যুর বাসের মত ছাদ খোলা না, বরং দু;দিক খোলা। যাত্রীদের এন্টারটেইন করার বিচিত্র সব আয়োজন। যাত্রীদের সবার হাতে স্থানীয় এক ধরণের বাদ্যযন্ত্র ধরিয়ে কয়েক মিনিটের ট্রেনিং দিল। মাথায় পরার জন্যে দিল এক ধরণের হ্যাট। এলকোহলের যথেষ্ট সরবরাহ নিশ্চিত করেই শুরু করল রাতের পার্টি।
পার্টি বলতে তেমন কিছু না। প্রায় সারারাত উঁচু-স্বরে মিউজিক চলবে। যারা চাইবে তারা বাসের সীমিত পরিসরে শরীর দোলাবে। প্রায় উলঙ্গ হোস্টদের অনেকে ঘনিষ্ঠ হয়ে তৃপ্তি দেয়ার চেষ্টা করবে। এবং সাথে চলবে বিরামহীন মদ্যপান।

প্রায় দশজনের মওত যাত্রী নিয়ে শুরু হল আমাদের যাত্রা। যাত্রীদের সবাই বহিরাগত। বেশিরভাগ প্রতিবেশী দেশ ভেনিজুয়েলার। অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপ আসা দু'টো পরিবারও যোগ দিল।

ঘটা করে সবাইকে নিজের পরিচয় দিতে বাধ্য করল সুন্দরী হোস্ট। আমার টার্ম এলে নিজের অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিচয় উন্মুক্ত করলাম। সবাই স্বাভাবিকভাবে নিলো। এবং এও বললাম আমার অরিজিন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ। এবং এখানেই ঘটল অলৌকিক কিছু।

লম্বা হাততালি দিয়ে স্বাগত জানালো আমার জন্মভূমির পরিচয়।
আমি হতচকিত, বিব্রত। পরিচয় পর্বের কোন অংশেই কাউকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানায়নি। আমাকে জানানো কারণ জানতে চাইলাম।
ভেনিজুয়েলার প্রায় সবাই একবাক্যে উত্তর দিল। মোহম্মদ ইউনুস!

ছবিঃ নেট হতে ধার করা।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন