দেশপ্রেমের স্বরলিপি...

Submitted by WatchDog on Sunday, May 28, 2023

নিউ ইয়র্কেই শুরু হয়েছিল শেষটার। জ্যাক্সন হাইটসের বাঙ্গালী দোকান হতে কেনা ইলিশ মাছের পেট হতে যেদিন পাথর প্রসব করল সেদিনই নিজকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম দেশপ্রেম বলতে আসলে কিছু নেই। সবাই আমরা ধান্ধাবাজ। একেক জন একেক পথে ধান্ধা করছি। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ধান্ধাকে কাজে লাগাচ্ছি। দেশপ্রেম হচ্ছে ধান্ধাবাজি বাণিজ্যের অন্যতম মালমসলা।

ইলিশ মাছ কোটি কোটি বাংলাদেশির মত আমারও প্রিয় মাছ। সুযোগ পেলেই ঘটা করে আয়োজন করি ইলিশ ভক্ষণের।
মাছের পেটে পাথর ঢুকিয়ে ওজন বাড়ানো যায় এবং ঐ পাথর ইলিশের দামে আমার মত আবালদের গছিয়ে দেয়া যায় এমন উপসংহারে আসতে নিজকে বোকচোদ আবুল খায়ের বিন আবদুল্লাহ বলে মনে হল। ঐ ঘটনার পর গুনে আড়াই বছর ইলিশের বাজারে পা রাখিনি।

বাংলাদেশ নিয়ে আমার কোন দুর্বলতা নেই। আমি জানি আমার মত অনেক প্রবাসী এখনো বুকে হাত রেখে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গেলে আবেগে উত্তেজনায় থর থর করে কেঁপে উঠেন। দেশপ্রেমের জিয়নকাঠি শরীরের সবকটা লোমে ঘা মেরে দণ্ডমুণ্ডের মত দাঁড় করিয়ে দেয়।
দুঃখিত, এমন সব দেশপ্রেম হতে আমি সম্পূর্ণ মুক্ত। নিজের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পয়সা নিয়ে দেশ যখন জুচ্চুরি করে প্রেম তখন বাষ্প হয়ে আগুনের উত্তাপ ছড়াতে শুরু করে।

বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি, এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। স্বভাবতই দেশ ভাল করলে আর দশজন প্রবাসীর মত আমারও ভাল লাগে। হোক তা রাজনীতির মাঠের সুশাসন, অর্থনীতির দৌড়ে এগিয়ে যাওয়ায় অথবা খেলার মাঠে।

একটা সময় ছিল যখন পরিধানের বস্ত্র কেনাকাটায় গেলে ম্যানুফেক্টারিং ট্যাগটা চেক করা ছিল বাধ্যতামূলক। নিজ অথবা পরিবারের অন্যদের পছন্দের জিনিসটা যখন দেখি বাংলাদেশে তৈরি কিছুটা হলেও গর্ব হতো। একই কাজ দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু, কলোম্বিয়া ও বলিভিয়ায় গিয়েও করেছি। যখন দেখেছি এসব এদেশে বাংলাদেশি পোশাক ওয়েভ এখনো পৌঁছায়নি। মনে মনে হিসাব কষেছি পৃথিবীর অনেক বাজার এখনো উন্মুক্ত, যা আবিষ্কার করলে বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের চেহারা।

বাংলাদেশি পোশাকের উপর দুর্বলতায় ধাক্কাটা লেগেছে গেল বছর দেশ হতে আসার পর। আসার সময় বৌ-বাচ্চাদের জন্যে বেশকিছু জামা-কাপড় এনেছিলাম। বিক্রেতার তালিকায় অনেক নামি-দামী প্রতিষ্ঠানও ছিল।
কিন্তু হায়, তালিকার অনেক পোশাক প্রথম ধোয়ায় লিলিপুটের সাইজ ধারণ করায় আশাহত হলাম। এক টি-শার্ট হতে রঙ গলে সাথের সাদা বেশকটা টি-শার্টের রঙ বদলে দিল। বৌ-বাচ্চারা তুবড়ি মেরে উড়িয়ে দিল পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজকে বুঝালাম, এটা সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ! এখানে কোন কিছুই অস্বাভাবিক না।

মার্কিন পোশাক বাজারে বাংলাদেশের প্রভাব দিন দিন খাটো হচ্ছে। দোকানে গেলে তা অনুভব করা যায়। ধাই ধাই করে এগিয়ে আসছে এক কালের মার্কিনীদের চরম শত্রু ভিয়েতনাম। মার্কিন কর্পোরেট ক্রেতারা নিজেরা বিনিয়োগ করছে ঐ দেশে। গড়ে তুলছে এ খাতের সাথে জড়িত বিভিন্ন শিল্প কারখানা। ভিয়েতনামে তৈরি পোশাকের গুনগত মান নিয়ে প্রশ্ন করার মত উপলক্ষ আমার মত সাধারণ ক্রেতারও হয়নি। তাই এখন আর বাজারে গিয়ে বাংলাদেশি পোশাকের সন্ধান করিনা।

এই লেখাটার একটা উপলক্ষ আছে এবং তা একেবারে ফ্রেশ। দু'দিন আগে আমাদের শহরের একমাত্র ভারতীয় গ্রোসারী ষ্টোরে গিয়েছিলাম কেনাকাটির জন্যে। তৈরি ঘি পরোটা দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। প্রোডাক্টের প্রেজেন্টেশনও ছিল সুন্দর।

সমস্যা দেখা দিল পরদিন ব্রেকফাস্টে। প্যাকেট খুলে পরোটা বের করে আনতে দেখি খুব সযত্নে প্রতিটা পরোটা আলাদা করে প্লাস্টিকে মোড়ানো আছে। পরোটার শরীর হতে প্লাস্টিক সরানোর সময় কাঁচা পরোটা হুরমুর করে ভেঙ্গে পরল। ভাবলাম সমস্যা হয়ত কেবল এক পরোটায়। কিন্তু না, প্রতিটা পরোটার নিয়তি একই পথে গড়াল। জোড়াতালি দিয়ে পরোটা ভেজে কোন রকমে মুখ রক্ষা করলাম।

অথচ একই পরোটা মালয়েশিয়া হতেও আসে। একই কায়দায় প্যাকেট করা পরোটা আলাদা করে ভাজি করতে কোন সমস্যা হয়না। সময়ও কম লাগে। পরের বার একই দোকান হতে বাংলাদেশি পরোটা আর কিনতে যাবনা তা প্রায় নিশ্চিত।

সমস্যা ছিল ক্রয় করা ফ্রোজেন মাছেও। চড়া মূল্যে কেনা রুই মাছের প্যাকেট ডি-ফ্রোস্ট করতেই দেখলাম ভয়াবহ এক দৃশ্য। রুই মাছের স্লাইস এতটাই পাতলা ভাল করে দেখলে মসলিন শাড়িকেও হার মানাবে। ফ্রাই পেন'এ উঠানোর সাথে ভেঙ্গে পরল। ভাজি শেষে মুড়িঘণ্ট হয়ে গেল রুই মাছ। ১২ ডলারের রুই মাছের অনেকটাই ঠাঁই পেল ডাস্টবিনে।

লুটপাটের টাকায় নয়, বরং ব্যবসা-বাণিজ্য দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক এমন কামনা হতে কোনদিন সরে আসিনি। কিন্তু কোথায় যেন এমন সমীকরণে কিছু ফাঁক থেকে যাচ্ছে। এই ফাঁকের ফল হয়ত আমরা এ মুহূর্তে দেখছিনা, কিন্তু এ ধারা অব্যাহত থাকলে একদিন নগ্ন হয়ে ১৭ কোটি মানুষের দেশকে তাড়া করবে এ নিয়ে অন্তত আমার কোন সন্দেহ নেই।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন