অফিস আদালত দেশ বিদেশে...

Submitted by WatchDog on Saturday, May 27, 2023

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।।জেফ্রি রড্রিগেস ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার। আমার ইমিডিয়েট বস। তাও লম্বা সময় ধরে। ডোনাল্ড ছিল ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর, অর্থাৎ বসের বস। ডোনাল্ড ও জেফ্রির আলাদা রুম থাকলেও আমার জন্যে নির্দিষ্ট ছিল সুসজ্জিত একটা কিউবিক। দুজনের রুম ও আমার কিউবিক পাশাপাশি হওয়ার কারণে অকারণে প্রায়ই আমাদের দেখা হয়ে যেত। মাঝে মধ্যে তাদের রুমে ঢুকে হরেক রকম বিষয় নিয়ে আলাপ করি। ওরাও আমার কিউবিকে আসে। দ্বিতীয় কো্ন চেয়ার না থাকায় আমার লো হাইটের ফাইল কেবিনেটে বসে অফিসিয়াল আন-অফিসিয়াল গল্প করে।

একে অপরের কর্মস্থলে ঢু মারা ছাড়াও লাঞ্চের সময় কিচেনে দেখা হয়। সবার মত ওরাও তাদের খাবার মাইক্রোওয়েভে গরম করে। দেখা হয় অফিসের কমন বাথরুমে। মাঝেমধ্যে পর পর তিন ইউরেনারিতে তিন জন দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করার সময় কুশল বিনিময় করি। আবহাওয়া নিয়ে কথা বলি।
বাকি দুজন আমার বস। স্যার বলা দূরে থাক তাদের কারও পুরো নাম ধরে কোনদিন ডাকিনি। শ্রফ জেফ্রি ও ডন (ডোনাল্ডের সংক্ষিপ্ত ভার্সন)।

এভাবেই চলে কর্পোরেট আমেরিকার অফিস আদালত। এখানে যোগ্যতার মূল্যায়ন হয়, চেয়ারের নয়। খুব জরুরি না হলে প্রাইভেট সেক্রেটারির অপশন থাকেনা। থাকলেও টেবিলে কোন কলিং বেল থাকেনা। দরজার বাইরে দারোয়ান জাতীয় কোন আদম স্যারের খেদমতের জন্যে অপেক্ষায় থাকেনা। থাকেনা কথিত বড় স্যারের চেয়ারে তেলচটা কোন তোয়ালে।

বাংলাদেশ...
স্থানঃ পাওয়ার ডেভেলাপমেন্ট বোর্ডের রাজশাহী অফিস। হেতেমখান না কি যেন একটা এলাকা।

ঐ অঞ্চলের বরেন্দ্র এলাকার একটা প্রকল্পের প্রকৌশলী হয়ে জয়েন করেছি। কর্মস্থল নঁওগা জেলার পত্নীতলা, বদলগাছি ও ধামইরহাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গভীর নলকূপ সমূহ। বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে হবে নলকূপে। প্রকল্পের মালিক বিএডিসি। তাদের হয়ে কাজ করছে পিডিবি, আর আমি কাজ করছি একটা প্রাইভেট কোম্পানীর হয়ে তাদের কারিগরী উপদেষ্টা হিসাবে।

প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটা বোর্ড মিটিং থাকে যেখানে প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সব পার্টির উঁচু লেভেলের প্রতিনিধির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। রিপোর্ট করতে হয় নিজেদের উন্নতি।

এভাবে মাস দুয়েক চলার পর আমার অফিস আমাকে ঢাকায় ডেকে পাঠালো। পিডিবির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অভিযোগ পাঠিয়েছে আমার বিরুদ্ধে। প্রথমত, এমন একজন জুনিয়র প্রকল্প প্রকৌশলী বোর্ড মিটিংয়ে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার রাখে না। প্রাইভেট কোম্পানী সমূহের সিনিয়র কারও থাকা বাধ্যতামূলক। এটা মেনে না চললে মিটিংয়ে বসা পিডিবির চীফ ইঞ্জিনিয়ার, সুপারেনটেন্ডেট ইঞ্জিনিয়ার সহ বাকিদের অপমান করা হয়। মাঝে মধ্যে মিটিংয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান হাজির থাকেন, অভিযোগটা নাকি ওনার মুখ হতে প্রথম উত্থাপিত হয়েছে।

উপসহকারী, সহকারী ও নির্বাহী প্রকৌশলী ছাড়া অন্য কারও রুম ঢুকা আমার জন্যে ছিল নিষিদ্ধ। তবে একবার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর রুমে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম নোংরা কাজ করতে। এনভেলাপে ভরে দুই লাখ টাকা নগদ ঘুষ হিসাবে দিতে হয়েছিল।
সবই ছিল ওখানে। ছিল সেক্রেটারী। কাঠের টুলে বসে থাকা পিয়ন। ছিল আলিশান একটা টেবিল ও চেয়ার। চেয়ার উপর ঝুলে থাকা গন্ধযুক্ত একটা তেলতেলা টাওয়েল।
জীবনে এই প্রথম ও শেষবার কাউকে স্যার বলতে হয়েছিল। কারণ আমার অফিস হতে তা করার কড়া নির্দেশ ছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়নঃ
আমার ছাত্র জীবনের শেষ বছর। মাস্টার ডিগ্রী শেষ করার শর্ত হিসাবে একটা পাওয়ার প্লান্টে কাজ করছি।
ইউরি স্তেপানোভিচ প্লান্টের চীফ ইঞ্জিনিয়ার। আমার রিসার্চ লীডার।
টেবিল হতে বেরিয়ে এসে বুকে টেনে স্বাগত জানালেন। প্লান্টের অনেক ডিপার্ট্মেন্টে নিয়ে গেলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন অনেকের সাথে।
কাজের শুরুতে তালিকা হাতে ধরিয়ে সময় নির্দিষ্ট করে দিলেন।
প্রতিদিন কাজের শেষে দেখা করি ইউরি স্তেপানোভিচের সাথে। কথা বলি কাজের অগ্রগতি নিয়ে। অগ্রগতি নিয়ে তিনি যে খুশি নন তা শারীরিক ভাষা হতেই বুঝতে পারি।
তিন দিনের মাথায় নিজের ধৈর্য ধরে রাখতে পারলেন না। কথার শুরুতে ফিরে গেলেন সোভিয়েত সংস্কৃতিতে...
'তো মায়রে *দি, এইসব ধোন-ফোন কাজ করার জন্যেই কি আমাদের রুটি খাচ্ছিস?
বাকি ইতিহাস ছিল সহজ সরল। এক পর্যায়ে ইউরি স্তেপানোভিচের জন্যে দুই বোতল স্তলিচনায়া ভদকা কিনে দিতে হয়েছিল। তেমনটা না করলে আমার রিপোর্ট ভাল হবেনা এমন একটা পরোক্ষ হুমকি দিয়েছিলেন।

বলে রাখা ভাল এই ইউরি স্তেপানোভিচ এক সময় ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নির্মান প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করেছিলেন। এ নিয়ে উনার গর্বের শেষ ছিলনা। একই প্রকল্পে বাংলাদেশি সহকর্মী ও বসদের কথা বলার সময় উনার চোখে মুখে এক ধরনের আভা খেলে যেতো। আমার কেবল একটা কথাই মনে হতো সে সময়...ভ্রমরে ভ্রমর চেনে!

ভালো লাগলে শেয়ার করুন