প্যালেষ্টাইন ও কিছু দীর্ঘশ্বাস...।

Submitted by WatchDog on Sunday, January 29, 2023

উত্তপ্ত হয়ে উঠছে প্যালেস্টাইন। একদিকে গাজা অন্যদিকে পশ্চিম তীর। জেরুজালেমও বাদ যাচ্ছেনা। প্রতিদিন ঘটছে খুনাখুনির ঘটনা। অবস্থাদৃষ্টে মন হচ্ছে আরও একটা ফুলস্কেল ইসরায়েলি অফেন্সিভের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে পশ্চিম তীর ও গাজা।

এমনটা যে অপ্রত্যাশিত ছিল তা নয়। বেঞ্জামিন নেতনিয়াহু ও তার কট্টর ডানপন্থী জোট ক্ষমতায় ফিরে আসার প্রেক্ষাপটে ধারণা করা গিয়েছিল অস্থিতিশীল হতে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ঐ অঞ্চল। প্যালেষ্টাইনিদের জন্যে কোন ছাড় নয়, নির্বাচনে এমনটাই ছিল নেতনিয়াহু ও তার ডানপন্থী কোয়ালিশনের প্রতিশ্রুতি। এবং দেশটার জনগণ হার্ড-লাইনের পক্ষে রায় দিয়েছে।

এক কালের প্রধানমন্ত্রী ইসসহাক রবিন, ইয়াহুদ বারাকদের লেবার পার্টি রাজনীতি হতে এখন অনেকটাই নির্বাসিত। ১২০ আসনের Knesset (পার্লামেন্টে)'এ মাত্র ৪টা আসন নিয়ে অস্তিত্বের জন্যে লড়ছে এই দল। অথচ সময় ছিল যখন আরিয়েল শেরন ও নেতনেয়াহুদের লিকুদ পার্টির একমাত্র প্রতিদন্ধি ছিল লেবার পার্টি। ক্ষমতার উত্থান পতন সীমাবদ্ধ ছিল এই দুই দলের ভেতর। সামনের কোন নির্বাচনে লেবার পার্টির ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। তাই ঐ অঞ্চলে দুই দেশের সমাধান নিয়ে যে আলোচনা চলছিল তা ইতিহাসে ঠাঁই নিচ্ছে ধীরে ধীরে।

দেশ হিসাবে ইসরায়েলের অস্তিত্ব এখন একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। এ হতে সড়ে আসার সম্ভাবনা অনেকটাই দিবা স্বপ্ন। পৃথিবীর মাটি হতে ইসরায়েলের অস্তিত্ব চিরদিনের জন্যে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, ইরান ও তার সহযোগী হামাস ও হেজবুল্লার এই দাবি এখন বাগড়ম্বতা বৈ অন্যকিছু মনে হয়না।

অথচ সুযোগ এসেছিল স্বাধীন সার্বভৌম প্যালেস্টাইন প্রতিষ্ঠা করার। ২০০০ সালে বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের ক্যাম্পডেভিড অবকাশ কেন্দ্রে আলোচনায় বসেছিলেন ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইয়াহুদ বারাক ও প্যালেস্টাইনের নেতা ইয়াসির আরাফাত।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ রাজী ছিল ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি মোতাবেক যে গ্রিন লাইন নির্ধারণ করা হয়েছিল তার বর্ধিত করতে। গোটা পশ্চিম তীরের শতকরা ৭৩ ভাগ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাবে রাজি ছিলেন ইয়াহুদ বারাক। গাজাকে ১০০ ভাগ মুক্তি দিতে রাজি হয়েছিল ইসিরায়েল। কথা ছিল চুক্তির ২০-২৫ বছরের ভেতর প্যালেষ্টাইনিরা আরও ১৯ ভাগ অর্থাৎ শতকরা ৯৩ ভাগ পশ্চিম তীরের দখল নেবে। ঐ অঞ্চলে ইতিমধ্যে গেড়ে বসা সেটলারদের সরিয়ে নেবে ইসরায়েল। কেবল যে সব এলাকায় সেটেলমেন্টের আকৃতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে তেমন কয়েকটার উপর ইসরায়েল তার দাবি ছাড়বে না। ডেড সী'তে নিজেদের প্রবেশ নিশ্চিত করার জন্যে ইসরায়েল প্যালেস্টাইনের বুক চিড়ে রাস্তা তৈরি করবে যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে তাদের হাতে। তবে নিশ্চিত করা থাকবে প্যালেষ্টাইনিদের অবাধ চলাফেরা।

ক্যাম্প ডেভিড আলোচনা ও চুক্তির মূল অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় জেরুজালেম। গোটা জেরুজালেম দূরে থাক প্যালেস্টাইনের ভবিষ্যৎ রাজধানী পূর্ব জেরুজালেমের উপর নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে অস্বীকার করে ইসরায়েল।

আলোচনার এক পর্যায়ে মন হয়েছিল চুক্তি স্বাক্ষর সময়ের ব্যপার মাত্র। কিছু খুঁটিনাটি সমস্যা সমাধানের পর দুই পক্ষ সমাধানে আসবে।
চুক্তি স্বাক্ষরের অন্তিম লগ্নে বেঁকে বসেন প্যালেষ্টাইনিদের নেতা ইয়াসির আরাফাত। তিনি ঘোষণা দেন এমন চুক্তি স্বাক্ষর করলে তার রাজনৈতিক মৃত্যু হবে এবং দেশে ফিরলে দেশবাসীর জনরোষের মুখোমুখি হতে হবে। প্রয়োজনের মুহূর্তে ইয়াসির আরাফাত দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন এবং প্যালেষ্টাইনিদের ভাগ্য পরিবর্তনের ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া করেন।

ওসলো চুক্তি স্বাক্ষরের জন্যে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইয়াৎসাক রবিনকে কট্টর ডানপন্থীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ভয় ছিল ইয়াহুদ বারাকেরও। আলোচনার শেষ পর্যায়ে এসে বেঁকে বসেন বারাক। বিরক্ত হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ইতি টানেন আলোচনার।

ওটাই ছিল প্যালেষ্টাইনিদের শেষ সুযোগ। কিন্তু একদিকে হামাস, অন্যদিকে ইসলামি জিহাদ এবং নিজ দলের ডানপন্থীদের কাছে জিম্মি হয়ে হার মানেন আরাফাত। এবং ফিরে যান ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগে সীমানা ফিরে পাওয়ার দাবিতে। এ দাবিতে রসদ যোগায় ইরান ও লেবাননে তার সহযোগী হেজবুল্লাহ।

ইতিমধ্যে অনেক পানি গড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে। স্বৈরতান্ত্রিক রাজা বাদশাহর দেশগুলো নিজেদের সিংহাসন পোক্ত করা ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার লক্ষ্যে হাত মিলিয়েছে ইসরায়েলের হাতে। নীরবে নিঃশব্দে মেনে নিয়েছে প্যালেষ্টাইনিদের প্রতি দেশটার নির্মম অত্যাচার।

ইসরায়েলের লেবার পার্টি ও ইয়াহুদ বারাকদের অস্তিত্ব এখন ইতিহাস। পৃথিবীর অনেক দেশের মত ইসরায়েলেও ঘটেছে রক্ষণশীলদের উত্থান।
প্রতিপক্ষকে নির্মমভাবে নির্মূল করার ভেতর লুকিয়ে থাকে রাজনৈতিক ক্ষমতার চাবিকাঠি, এ কঠিন ও নির্মম সত্য প্রথমে সামনে আনে ভারতের বিজেপি ও তার নেতা নরেন্দ্র মোদী। গুজরাটের কসাই খ্যাত এই নেতার সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে চলেছিল মুসলিম নিধন। এই পৈশাচিক নিধনে বিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ ভারতে জন্ম দিয়েছিল ধর্মীয় উন্মাদনা। এই উন্মাদনাই মোদীকে এনেছে রাজনৈতিক ক্ষমতায়।

ধর্মীয় অথবা উগ্র জাতীয়তাবাদের হাত ধরে পৃথিবীর দেশে দেশে একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারের দল ক্ষমতায় বসছে। আজকের ইসরায়েল ভারতেরই কার্বন কপি। যে দল প্যালেষ্টাইনিদের প্রতি যত নির্মম হবে তারাই ক্ষমতায় বসবে, এ দুঃখজনক বাস্তবতা হতে বেরিয়ে আসার আপাত কোন সম্ভাবনা নেই।

পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যপাকভাবে হ্রাস পেয়েছে স্বাধীন প্যালেস্টাইনের সমর্থন। এর পেছনে কাছ করছে ইসলামী জঙ্গিবাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১, অন্যদিকে লন্ডন মাদ্রিদ সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বোমা হামলা বদলে দিয়েছে প্যালেষ্টাইনিদের প্রতি ইসরায়েলিদের নির্মমতার স্বরলিপি।

নতুন করে শুরু হওয়া সংঘাত ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্যে খুবই স্পর্শকাতর কিছু বিষয়। ২০১৯ সালে জেরুজালেম হয়ে পশ্চিম তীরের রামাল্লা, জেরিকো, বেথেলহেম সহ ছোট বড় আরও অনেক শহর ভ্রমণ দিয়েছে প্যালেষ্টাইনিদের জীবনকে খুব কাছ হতে জানতে। নিজ দেশে উদ্বাস্তু হয়ে বাঁচার যে নির্মম চিত্র তা দূরে বসে ধারণা করা কঠিন। প্যালেস্টাইনকে জানতে আপনাকে পা দিতে হবে তাদের জুতায়। হাঁটতে হবে উদ্বাস্তু শিবির গুলোতে। মুখোমুখি হতে হবে ভিন দেশ হতে উড়ে এসে জুড়ে বসা অভিবাসীদের স্যাটেলেমেন্টে।

পশ্চিম তীর তথা প্যালেস্টাইনে জীবন নেই। আছে জীবন নিয়ে কিছু দীর্ঘশ্বাস। আছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের বুকভরা আশা নিয়ে বেড়ে উঠা। আশা এক সময় হতাশার জন্ম দেয়। এবং হতাশার জরায়ুতে জন্ম নেয় প্রতিশোধ স্পৃহা। জেরুজালেমের রাস্তায় একজন ১৩ বছর বয়সী প্যালেষ্টাইনি অস্ত্র হাতে নির্বিচারে গুলি চালায় তা বুঝতে দেশটার জলপাই বাগানের ছায়াতলে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও থামতে হবে।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন