শত্রুর শত্রু আমার মিত্র...রুশদের মুসলমান প্রীতি!

Submitted by WatchDog on Sunday, March 27, 2022

শত্রুর শত্রু আমার মিত্র, লজিকটা বহুল পরিচিত, বহুল ব্যবহৃত। পূর্ব ইউরোপের কনফ্লিক্টেও তা সামনে আসছে।
ইসরায়েলিদের নির্মম ও পৈশাচিক গাজা অভিযানের সময় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জালেনস্কি ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছিলেন। তাই তার দেশ যখন একই কায়দায় রুশদের ট্যাংকের নীচে দলিত মথিত হচ্ছে লজিক্যাল পছন্দে রাশিয়া হবে আমাদের মিত্র। জালেনস্কি, তুমি ইসলামের শত্রুদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছ তাই তোমার বিপদে আমরাও কথা বলবো তোমার শত্রুদের পক্ষ নিয়ে।

আমাদের বিচারে যুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষ নেয়ার ড্রাইভিং ফোর্স যদি ধর্ম হয় আসুন চোখ ফেরাই ইউক্রেইনের ধুলো মাটিতে জন্ম নেয়া আমাদের নব্য মিত্র রাশিয়ার দিকে। এটাই এখন আমাদের লজিক।

চেচনিয়া। অধুনা রাশিয়ার দক্ষিণ পশ্চিমে কাস্পিয়ান সাগরের কাছাকাছি একটি অঞ্চল। সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই অঞ্চলকে প্রকৃতি উজাড় করে দিয়েছে তার সবকিছু। দিগন্ত জুড়ে ককেশাস পাহাড়, ফসলের ক্ষেত, অতিথিপরায়ণ মানুষ, প্রথম দেখায় মনে হবে ঈশ্বর সৃষ্ট স্বর্গের ক্ষুদ্র সংস্করণ।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর চেচেন-ইঙ্গুস অটোনমাস সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক ভেঙ্গে তৈরি করা হয় রিপাবলিক অব ইঙ্গুসেটিয়া ও চেচেন রিপাবলিক।
মুসলমান অধ্যুষিত চেচেন রিপাবলিক একসময় নিজকে চেচেন রিপাবলিক অব ইচখেরিয়া হিসাবে ঘোষণা দেয়। এবং রাশিয়া হতে বেরিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

১৭,৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ও ১৪ লাখ মানুষ নিয়ে ঘোষিত স্বাধীন চেচেন রিপাবলিক অব ইচখেরিয়া রাষ্ট্র নিজেদের কব্জায় আনতে হামলে পরে রুশ বাহিনী। শুরু হয় চেচনিয়ার প্রথম যুদ্ধ। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে। স্বঘোষিত চেচেন রাষ্ট্রের রাজধানী গ্রোজনীকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় ফেডারেল রুশ বাহিনী। ২১ মাস স্থায়ী যুদ্ধে রুশদের হাতে প্রাণ হারায় ৫০ হাজার সাধারণ মানুষ। যার ৩০ হাজারই মারা যায় রাজধানী গ্রোজনীতে। এবং এদের সবাই ছিল মুসলমান।

ইউক্রেইন অভিযানের মতই পুতিনের পূর্বসূরি বরিস ইয়েলৎসিনের বাহিনী সুপার পাওয়ারের তকমা নিয়ে হামলে পরে চেচেনদের উপর। রাজধানী গ্রোজনীকে বানায় হরর মুভির মৃত্যুপুরীতে।
পাহাড় পর্বতে ঘেরা চেচেন ভূমি রুশদের জন্যে পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। চেচেন যোদ্ধাদের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে ইয়েলৎসিন যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হন। চেচনিয়ার পাহাড়ে পর্বতের বাঁকে বাঁকে ১৪,০০০ সৈনিকের লাশ ফেলে পিঠটান দেয় রুশ বাহিনী।

১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে চেচেন যোদ্ধাদের সহযোগিতায় প্রতিবেশী দাগিস্তানও স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। আবারও রাশিয়ার ফেডারেল বাহিনী অগ্রসর হয় চেচনিয়ার দিকে। শুরু হয় অল আউট এসাল্ট।
রাজধানী গ্রোজনীকে দ্বিতীয়বারের মত মিশিয়ে দেয়া হয় মাটিতে।

এ যাত্রায় স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় রুশ বাহিনী কঠোর-হস্তে দমন করে স্বাধীনতাকামী চেচেনদের। আরও একবার রক্তের ফোয়ারা বয়ে যায় ককেশাস পাহাড়ের পাদদেশে।

২০০৯ সালে রুশ বাহিনী চেচেনদের কফিনে শেষ পেরেক ঢুকিয়ে চিরতরে নির্মূল করে তাদের বিদ্রোহ। এক কালের চেচেন স্বাধীনতার সৈনিকরা পালিয়ে গিয়ে নাম লেখায় ইসলামী জেহাদে। যোগ দেয় আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের সন্ত্রাসী ক্যাম্পে। দেশে দেশে ভাড়াটে সৈনিক হিসাবে ভাড়া খাটতে শুরু করে।

বলাহয় দুই যুদ্ধে প্রায় ৩ লাখ সিভিলিয়ান চেচেন প্রাণ হারিয়েছিল রুশদের হাতে। যার ৪০% ছিল শিশু। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে অনেক তর্ক আছে।যুদ্ধে নিহত রুশ ফেডারেল বাহিনীর সৈন্যদের বাদ দিলে নিহতদের
বাকি সবাই ছিল মুসলমান।

চেচেনদের যুদ্ধ ছিল তাদের স্বাধীনতার জন্যে। যুগ যুগ ধরে বিজাতীয় রুশদের গ্রীপ হতে মুক্তি পাওয়ার জন্যে তারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। সে সংগ্রাম কোন বিচারে ধর্মীয় সংগ্রাম ছিলনা। তারা ইসলাম ধর্মের জন্যে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেনি। করেছিল নিজেদের সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার জন্যে। ধর্ম ছিল এই সংস্কৃতির অংশ মাত্র।

আজকের প্যালেস্টাইনও লড়ছে তাদের অস্তিত্বের জন্যে। স্বাধীন জাতি সত্ত্বা হিসাবে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকার জন্যে তারা প্রতিবাদ প্রতিরোধ করছে। তাদের এই বৈধ লড়াইয়ে ধর্মের স্থান কোথায় এ নিয়ে প্রশ্ন করা যেতে পারে।

স্বাধীনতা ও মুক্তির যুদ্ধকে ধর্মীয় যুদ্ধের সাথে গুলিয়ে ফেললে কি পরিণতি হয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ আজকের চেচনিয়া। প্যালেস্টাইনকেও আমরা এ পথে নিয়ে যাচ্ছি। এক সময় গোটা ইউরোপ ছিল প্যালেস্টাইনের বৈধ কোর্সের ঘোর সমর্থক। কিন্তু ওসামা বিন লাদেনের সৈন্যরা যেদিন লন্ডন, মাদ্রিদ, প্যারিস সহ বিভিন্ন জায়গায় বোমা মেরে সিভিলিয়ান খুন করা শুরু করল সেদিন হতে ইউরোপ মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করল প্যালেষ্টাইনিদের দিক হতে।

এই এক সত্য হজম করতে আমাদের অসুবিধা হয়, স্বাধীনতার যুদ্ধকে ধর্মীয় যুদ্ধের সাথে গুলিয়ে ফেললে সে যুদ্ধের পতন অনিবার্য। তা চেচনিয়ায় যেমন হয়েছে প্যালেস্টাইনেও হতে বাধ্য। প্যালেস্টাইনের অস্থায়ী রাজধানী রামাল্লা সহ পশ্চিম তীরের বিভিন্ন শহরের বাসিন্দাদের সাথে আলাপ করে এমন একজন পাইনি যার মতে তাদের কোর্স ইসলাম ধর্মের জন্যে।

ককেশাস পাহাড়ের পাদদেশে কান পাতলে এখনও শোনা যাবে অনেক মায়ের কান্না। বর্বর রুশদের নির্মমতার চিহ্ন রাজধানীর গ্রোজনীর ঘরে ঘরে। হাজার হাজার মা এখনও তার সন্তানের কবরে বসে চোখের পানি ফেলে।

পুরানো বর্বর রুশরা নতুন রূপে হাজির হয়েছে ইউক্রেইনে। একই রূপে তারা হামলা করেছিল প্রতিবেশী দেশ জর্জিয়ায়। সৈন্য পাঠিয়ে দমন করেছে গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার বেলারুশদের দাবি। কাজাকিস্তানে প্রদর্শন করেছে তাদের নোংরা চেহারা। তাই জেলেনস্কির ইসরায়েল প্রীতি দিয়ে ইউক্রেইনে পুতিন বাহিনীর অভিযানকে বৈধ করার আগে অনুরোধ করবো ইতিহাসের পাতা ঘাঁটতে।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন