তাসমান পাড়ের গল্প।

Submitted by WatchDog on Wednesday, January 19, 2022

ইউরোপের ব্যস্ত জীবন ছেড়ে চলুন এবার তাসমান পাড়ের গতিহীন জীবনে ঘুরে আসি। জীবন সেখানে আসলেই অচল। ছবির মত সুন্দর, হিজল তমাল দিঘীর মত শান্ত ও উঁচু উঁচু পাহাড়ের মত নিশ্চুপ ও স্থবির। ইউরোপের কোলাহলময় জীবন অনেক ব্যস্ত। ওখানে গাড়ি ঘোড়া বাস ট্রেনে চড়ে একদেশ হতে অন্য দেশে যেতে অতিরিক্ত কিছুর দরকার হয়না। চাই কেবল ইচ্ছা ও সময়। কিন্তু তাসমান পাড়ের দুই দেশে আসা যাওয়ার একটাই মাধ্যম, সাগরের উপর ভাসমান মেঘমালার বুক-চিড়ে যাওয়া। চলুন সেটাই করি।

টাইম মেশিনে চড়ে চলুন ফিরে যাই ২২ বছর আগে। ২০০০ সাল। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি অলিম্পিকের জন্যে তৈরি হচ্ছে। চারদিকে সাজ সাজ রব। সবার মত আমিও কাঁপছি সে উত্তেজনায়। ১৯৮০ সালে মস্কোতে যে সুযোগ মিস করেছি এ যাত্রায় তা না করতে ছিলাম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

কিন্তু হায়, আমি ও আমার দোতারার দুই সুরের গান আবারও অলিম্পিক মিস করা নিশ্চিত করে দিল। সেপ্টেম্বরের শুরুতে অলিম্পিক আর আমাকে আমেরিকায় ঢুকতে হবে একই মাসের ১৫ তারিখের ভেতর। তারিখের হেরফের হলে দেশটায় আমার মাইগ্রেশন প্রসেস ইনভেলিড হয়ে যাবে।

১৯৯৯ সালের নভেম্বরের শেষদিকে কাগজপত্র চূড়ান্ত করে অপেক্ষা করছি মাত্র শুরু হওয়া অস্ট্রেলিয়া জীবনের ইতি টানার। আমার জীবনের যা কিছু ঘটে সবই ঘটে এই সেপ্টেম্বর মাসে। ১৯৯৫ সালের একই মাসে জীবন যুদ্ধের শেষ অধ্যায় লেখার জন্যে হাজির হয়েছিলাম এই দ্বীপে।

অচেনা দেশ। প্রাথমিক সাহায্য পাওয়ার মত কেউ ছিলনা। লাগেজ নিয়ে কোথায় উঠবো তারও কোন ঠিক ছিলনা। অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়াতে যাচ্ছি সিডনি কিংসফোর্ড স্মিথ এয়ারপোর্টে পা রেখেই তা বুঝতে পেরেছিলাম। তবে এ নিয়ে আমি বিশেষ যে চিন্তিত ছিলাম তা নয়।

অতীতে বহুবার এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি। অপরিচিত দেশ, অজানা ভাষার মত বাধা কাটিয়ে ইতিমধ্যে পৃথিবীর অনেক প্রান্ত ঘুরে এসেছি। অস্ট্রেলিয়ায় এসেছি সরকারী স্পন্সরে। স্কিল মাইগ্রেশনের বৈধ কাগজপত্র হাতে। তাই দ্বিধা থাকলেও ভয় ছিলনা। তাছাড়া পকেটে ছিল খরচ করার মত দুই হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড স্টালিং।

মার্টিন প্যালেসের কাছে জর্জ স্ট্রীটের উপর সস্তা এক হোটেলে উঠেছিলাম বাধ্য হয়ে। দুদিন পর ভোজবাজির মত বদলে গেল সবকিছু। আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধুর সন্ধান পাওয়ার একদিনের মাথায় দেশটার সোশ্যাল সিকিউরিটিতে নাম লিখিয়ে অন্তত প্রাথমিক খরচের কিছু অংক নিশ্চিত করতে সক্ষম হই। আরও একদিন পর মেডিকেয়ার/মেডিকেইডে তালিকাভুক্ত হয়ে নিশ্চিত করি চিকিৎসা পর্ব। শহরের পুবদিকে প্রথমে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে রেন্ডউইক, পরে ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলেসের পাশে কেনসিংটনে এলাকার দিনগুলো ভালই কাটছিল।

চার বছর কেটে যায় সিডনি শহরে। শহরকে নিজের শহর ও দেশকে নিজের দেশ ভাবতে শুরু করছি কেবল। দু'বছরের মাথায় নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট পাওয়ায় নিশ্চিত হয়ে যাই এই শহর এ দেশই হতে যাচ্ছে আমার শেষ ঠিকানা।

গোলমাল বাধে অন্য জায়গায়। মারুবার এনজাক পেরেডের উপর একটা ফ্লাটে থাকি। ফ্লাট-মেট হিসাবে বন্ধু পাভেল যোগ দিয়েছে কেবল। ইংল্যান্ডে এমবিএ করা পাভেল নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিতে কম্পিউটার সাইন্সে কি একটা কোর্স করতে দেশ হতে এসেছে কেবল। আমার মত অনেক ঘাটে পোড় খাওয়া পাভেলের সাথে সম্পর্কটা ফ্ল্যাট-মেট হতে বন্ধুত্বে রূপ নিতে সময় লাগেনি। দুজন দুদিকে কাজ করি। পাশাপাশি ইউনিতে দৌড়ায় পাভেল। দুজনের জীবন বয়ে চলছে অনেকটা নদীর মত।

আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে এসেছি। পাভেল এসেছে স্টুডেন্ট ভিসায়। কোর্সের শেষদিকে এসে চিন্তাটা তাকে চেপে ধরল। দেশে ফেরার ইচ্ছা ছিলনা তার।

ক্লাস হতে ফিরে খাবার টেবিলে বসে সংবাদটা দিল। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারের দেশ আমেরিকা তার দেশে প্রতিবছরের মত এবারও ডিভি লটারি অফার করছে। পাভেল ইউনির লাইব্রেরি হতে প্রিন্ট করে এনেছে দুটো ফর্ম। একটা তার ও অন্যটা আমার জন্যে। নিজে পূরণ করে কেবল আমার সই নিয়ে নিজেই পোস্টে পাঠিয়ে দেয় ডিভি দরখাস্ত। খুব দ্রুতই ভুলে যাই এমন একটা কাজ আমরা করেছিলাম।

কোর্স শেষ করে পাভেল দেশে ফিরে যায়। আমিও মন দেই আমার কাজে। ইতিমধ্যে বেশকিছু স্বদেশীর সাথে পরিচয় হওয়ায় জীবন আরও সহজ হয়ে যায়। মাছে-ভাতের একজন বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়ান হওয়ার লড়াই শুরু করি সর্বশক্তি দিয়ে।

হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস হতে একটা খাম পেয়ে অবাক হয়ে যাই। কারণ ততদিনে স্মৃতি হতে মুছে গেলে ডিভি পর্ব।
খাম খুলে হতভম্ব! আই এম আ উইনার।

১৯৯৯ সালের শেষদিকেই সব চূড়ান্ত হয়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ভিসার প্যাকেট হাতে পেয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলাম অস্ট্রেলিয়ার থাকা হচ্ছেনা আমার। এ নিয়ে তেমন কোন হায় হুতাশ ছিলনা। প্রথমত, এখানে আপনজন অথবা ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে তেমন কেউ ছিলনা। দ্বিতীয়ত, ভাল একটা চাকরির জন্যে তখনও ষ্ট্রাগল করছিলাম।

একদম শেষমুহুর্তে আমেরিকায় প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় গুনে দেখলাম হাতে এখনও নয়টা মাস সময় আছে। অস্ট্রেলিয়ায় ইতিমধ্যে মন উঠে গেছে। সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে ফিরে যাব। কটা মাস মা'র সাথে কাটিয়ে ফিরে এসে পাড়ি দেব আমেরিকার দিকে।

শাফিউল আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। সেন্ট পিটার্সবার্গে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় রুম শেয়ার করেছি। বছরের পর বছর ধরে এক হাড়ি হতে ভাত খেয়েছি। বাংলাদেশে ফিরে এসে একই কোম্পানিতে চাকরি করেছি।

হঠাৎ করেই শফিউল আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে চলে যায় চাকরি নিয়ে। এবং তারপর দেখা দূরে থাক, কোন রকম যোগাযোগও ছিলনা।
সেই শফিউল হঠাৎ করে নিউজিল্যান্ডে হাজির। সপরিবারে মাইগ্রেট করেছে। তাসমানের দুই তীরে দুজন থাকলেও দেখা হয়নি এতদিন। যাই যাই করেও আমার যাওয়া হয়নি। আমেরিকা চলে যাচ্ছি শুনে শফিউল ওর ওখানে ঘুরে যাওয়ার জন্যে শেষবারের মত অনুরোধ করল।

কোথাও বেরিয়ে পরার ওটাই ছিল আমার মোক্ষম সময়। পৃথিবীর এ প্রান্ত একবার ছেড়ে গেলে দ্বিতীয়বার আসা হবে কি-না সন্দেহ ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ঘুরে আসব নিউজিল্যান্ড। হাতে সময় নিয়ে টিকেট কাটলাম যাতে ফিরে এসে চলে যেতে পারি বাংলাদেশে।

১৯৯৯ সালের ২৫শে ডিসেম্বর। ক্যালেন্ডারের হিসাবে খ্রিষ্টানদের বড়দিন। চারদিকে উৎসবের আমেজ। বন্ধু শফিউলেরও ছুটি। আমাকে সময় দেয়ার মত যথেষ্ট সময় থাকবে হাতে।

সিডনি হতে অকল্যান্ড। তিন ঘণ্টার ফ্লাইট। সাথে দুই ঘণ্টার সময় পার্থক্য। ঘড়ির হিসাবে ওরা এগিয়ে। বড়দিন তাই আসছিলো এয়ার নিউজিল্যান্ড হয়ত বিশেষ সার্ভিসের ব্যবস্থা করবে। থাকবে হরেক রকম খাবার ও আপ্যায়ন।
তেমন কিছুই ছিলনা ফ্লাইটে। কেবল পাইলটের অভিনন্দন'এর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে বিশেষ দিনের বিশেষ আয়োজন। প্রায় ৯০% ফাঁকা সীটের ফ্লাইটে আগে কোনদিন ফ্লাই করেছি কিনা মনে করতে পারলাম না।

নির্ধারিত সময়ের দশমিনিট আগেই ল্যান্ড করল আমাদের ফ্লাইট।
অকল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চেহারা দেখে একটু অবাক ও বিমোহিত হলাম। এয়ারপোর্টের প্রায় সব দায়িত্বে দেশটার আদিবাসী মাউরিরা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ টোংগা, সামোয়া, ভানোয়াতুর নাগরিকদের মত চেহারার মাউরিদের চিনতে অসুবিধা হয়না। গায়ে গতরে খুবই শক্তিশালী মাউরিরা হাজার বছর আগে তাদের মিথিক্যাল পলিনেশিয়ান হোমল্যান্ড হাওয়াইকি হতে এখানে এসেছিল। গোটা নিউজিল্যান্ড জুড়ে এদের বাস। দেশটার জনসংখ্যার শতকরা ১৪ ভাগ হলেও এয়ারপোর্টে তাদের উপস্থিতি দেখে তা মনে হলোনা।

প্লেনের দরজা হতে বেরুতেই চোখ পরল শফিউলের উপস্থিতি। সপরিবারের অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। বন্ধুর স্ত্রী ইউক্রেইনের নাগরিক। চিনি সেই কৈশোরকাল হতে।

আমরা দুজনেই আবেগী নই। তাই ভেতরের অনুভূতি বাইরে না এনেও অনেক কথা বিনিময় হয়ে গেল। আমরা অনেকদিন অপেক্ষায় ছিলাম এমন একটা মুহূর্তের।

ডিসেম্বরের শেষদিকে নিউজিল্যান্ড যাওয়ার আরও একটা কারণ ছিল আমার জন্যে। মিলেনিয়াম অথবা Y2K বাগের জ্বরে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। কম্পিউটার সফটওয়্যার ২০০০ সালের শেষ দুটা শূন্যের জন্যে প্রোগ্রাম করা না থাকায় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে মানব সভ্যতায়, এমন আশংকা করছিল অনেকে। অনেকে অতিরিক্ত খাদ্য, পানি মজুত করে তৈরি হচ্ছিল আপদকালিন সময়ের জন্যে। এ নিয়ে মিডিয়াতেও ছিল প্রচুর হৈ চৈ। ২০০০ সাল ধরণীতে প্রথম পা রাখবে নিউজিল্যান্ড সহ পলেনেশিয়ার বাকি দ্বীপগুলোতে। বিপর্যয় যদি ঘটে তার শুরুটাও হবে ওসব দেশ হতেই। ইচ্ছা ছিল মানব সভ্যতা ভেঙ্গে পরার ঊষালগ্নের সাক্ষী হওয়ার। তাই ইচ্ছা করেই বছরের শেষদিকে পাড়ি জমাই তাসমানের ওপারে।

সে রাতে আমাদের কারও চোখে আসবেনা জানা ছিল। শেয়ার করার মত গল্পের পাহাড় জমে ছিল দুজনের ভেতর। সাথে ছিল ফেলা আসা স্মৃতি রোমন্থন। যে স্মৃতি আমাদের নিয়ে গিয়েছিল ইউক্রেইনের ছোট এক শিল্প শহর হতে রুশ জার-তন্ত্রের রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গে। সে তালিকায় আরও ছিল বাংলাদেশের নওগাঁর পত্নীতলা, বদলগাছি ও ধামুইরহাটের অনেক পথ-ঘাট।

বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে BBQ আর পানের আসরে যোগ দিয়েছিল আরও কটা পরিবার। শফিউলের বাড়িটা খোলামেলা জায়গায় হওয়ায় মাঝরাতে গলা খুলে গান ধরতেও কোন বাধা ছিলনা। বন্ধু নিশ্চিত করেছিল সম্ভাব্য শব্দ দূষণের আওতায় আসতে পারে এমন সব বাড়িওয়ালাদের সবাইকে আগাম নোটিশ দেয়া আছে। কেউ মাইন্ড করবেনা।

বড়দিন হতে নিউ ইয়ার, গুনলে এক সপ্তাহের ব্যবধান। এই এক সপ্তাহ চষে বেড়ালাম অকল্যান্ডের সব কোনায়। সফরের দ্বিতীয় রাতে বন্ধুকে নিয়ে গেলাম স্থানীয় কাসিনোতে। কাসিনোর সাথে শফিউলের পরিচয় নেই। ওখানে জুয়া খেলার ব্যাপারে তার সামান্যতম ধারণা ছিলনা।

রুলেট টেবিলে আধাঘণ্টায় ৮০০ ডলার লাভ করে নীরবে বেরিয়ে আসলাম। নিউজিল্যান্ড আসা-যাওয়া সহ সব খরচ এক নিমিষে উঠে এলো। বন্ধু ও তার স্ত্রী হতভম্ব! বুঝতেই পারলোনা কি হতে কি হয়ে গেল। চিপস হাতে নিয়ে বিভিন্ন নাম্বারে বসাচ্ছি...রুলেটের চাকা ঘুরছে...আমি আরও চিপস হাতে পাচ্ছি এবং একসময় চিপসগুলো কাউন্টারে জমা দিয়ে কিইউ ডলার হাতে নিয়ে বেরিয়ে পরা, বন্ধু ও বন্ধু-পত্নী দুজনের জন্যেই ছিল দুর্বোধ্য।

এবং শেষমেশ হাজির হল সে মাহেন্দ্রক্ষণ! নতুন সহস্রাব্দির ঊষালগ্নে আমরা। টেবিলে খাবার ও পানীয় নিয়ে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি বড় ধরণের বিপর্যয়ের। ঘড়ির কাটায় বারটা বাজার শেষ ঘণ্টাটা বাজতে দলবেঁধে রাস্তায় নেমে এলাম। রাস্তায় মানুষের ঢল। সবাই সাক্ষী হতে চাইছে ইতিহাসের।

না, কোথাও কিছু ঘটেনি সে রাতে। মানব সভ্যতার একটা চুলেও হাত দিতে পারেনি মিলেনিয়াম বাগ। পৃথিবী যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেল সে রাতে। ভয় ভীতি আর উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে শেষরাতে দিকে ঘুমাতে গেলাম সবাই।

সূর্য উঠার সাথে সাথে কলিং বেলের তীব্র আর্তনাদে ভেঙ্গে গেল কাঁচা ঘুম। আমি ড্রয়িং রুমে তাই আমাকেই খুলতে হল বাসার মুল দরজা।
একদল বাংলাদেশি। সবার মাথায় টুপি ও মুখে দাঁড়ি। বন্ধু শফিউলের সাথে দেখা করতে এসেছে। তার জন্যে তবলীগ জামাতের দাওয়াত নিয়ে এসেছে।

মাঝে মধ্যেই চিন্তাটা মাথায় আসে। মগজের গভীরে ঢুকে কিলবিল করে। কল্পনায় চমকিত হই। আবেগ আপ্লূত হই। কেমন হত যদি ঘুরে বেড়ানোর মুহূর্তগুলোতে পাশে কেউ থাকতো। খুবই আপন কেউ। ভালবাসার কেউ! এমন কিছু নিয়ে মাঝে মধ্যে যে ভাবিনি তা নয়।

মেঘে মেঘে বেলা পেরিয়ে যাচ্ছে, এক বন্দর হতে অন্য বন্দরে নাও নোঙর করছি অথচ কোথায় যেন কি একটা নেই। হিসাবের শেষে কিছু একটা গোলমাল থেকে যাচ্ছে। বন্ধু শফিউল ও তার স্ত্রী বার বার সেদিকেই ইঙ্গিত করছিল।

নিউজিল্যান্ডে প্রথম দুদিন ঘরে বসে স্মৃতি রোমন্থন করেই কাটিয়ে দিলাম। পৃথিবীর এ প্রান্তে এ সময় গ্রীষ্মকাল। মধ্য গগনে সূর্যের দাপটে কোন কার্পণ্য নেই। তবে নেই প্রখরতা, সবকিছুতে কেমন যেন কোমলতার ছোঁয়া। উপভোগ করার মত ভালোলাগা।

তিনদিনের মাথায় রওয়ানা দিলাম আরও দক্ষিণে। ২২৭ কিলোমিটার দূরে রটোরোয়া নামের এক শহরে। ড্রাইভিং সময় প্রায় ৩ ঘণ্টা। নেইমসেক লেকের পাড়ের এ শহর তার জিও-থার্মাল এক্টিভিটির জন্যে বিখ্যাত। দেখার মত অনেক কিছু আছে এখানে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে টুরিস্টদের ভিড় লেগেই থাকে।

মাঝপথে হ্যামিলটন নামের বড় একটা শহর। ওখানে দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পরলাম শহর দেখতে। বেশ বড় শহর। একপাশ দিয়ে বয়ে গেছে ওয়াকাটো নদী। মানুষ আর প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এ শহরে। মাঝ নদীতে গলফ খেলার ব্যবস্থা আছে। ওখানে কিছুটা সময় ব্যায় করে আবারও নেমে পরলাম রাস্তায়।

অদ্ভুত দেশ এই নিউজিল্যান্ড। চারদিকে থমথমে চেহারার জঙ্গল। মাইলের পর মাইল জনবসতির কোন চিহ্ন নেই। ঝকঝকে রাস্তাঘাট। ভাল করে তাকালে মনে হবে কেউ দিনের পর দিন যত্ন করে আগলে রাখছে সবকিছু। এতকিছু ছাপিয়ে যে ছবি মগজে আঘাত হানে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্ত। রাস্তা পারা হতে গিয়ে চলমান গাড়ির নীচে চাপা পরে মারা যাচ্ছে বনের পশু। রক্ত শুকিয়ে শক্ত হয়ে যাচ্ছে। চলমান গাড়ির চাকার নীচে চাপা পরে যাচ্ছে প্রকৃতি ও মানুষের এই বৈরী সম্পর্ক।

হোটেল আগেই বুক করা ছিল। আহামরি তেমন কিছু না। তবে আধুনিক সভ্যতায় বাস করতে যা লাগে তার কোন অভাব ছিলনা।
হোটেলের বাইরে প্রথম পা রাখতে চোখে পরল অবিস্মরণীয় এসব দৃশ্য। মাটি ফুঁড়ে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে বাষ্প। কাঠি দিয়ে মাটিতে খোঁচা দিলে সেখান হতেও বেরিয়ে আসছে।

রাতের খাবার ভারতীয় এক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে মোকাবেলা করতে হল অন্য এক অভিজ্ঞতা। রেস্টুরেন্টের মহিলা মালিক আমার পাশের চেয়ারটায় বসে অনেকক্ষণ আলাপ করলেন। এবং সবশেষে প্রস্তাব দিলেন তার রেস্টুরেন্টে কাজ করার জন্যে। রেস্টুরেন্ট চালু রাখার মত লোকবল পাওয়া যাচ্ছেনা এদিকটায়। যে দুজন মাওরি কাজ করে করে তাদের মন-মর্জির কোন ঠিক ঠিকানা থাকেনা। একদিন আসে তো দুদিন দেখা দেয়না। অথচ ব্যবসা নাকি এখানে খারাপ না।

চমৎকার একটা হাসি দিয়ে এক কিশোরী এসে পাশে বসলো। মালিকের কন্যা প্রমা। স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করছে। লোক না থাকায় প্রায়ই এখানে আসতে বাধ্য হয় মাকে সাহায্য করার জন্যে।
আমি সিডনির বাসিন্দা এবং ক'মাস পর চলে যাচ্ছি পৃথিবীর আরেক প্রান্তে শুনে বোধহয় কষ্ট পেলেন মহিলা। সামনে আরও একদিন আছি এখানে শুনে প্রমা প্রস্তাব দিল শহর ঘুরে দেখানোর। আমার বন্ধু ও তার স্ত্রীর চোখে অন্যরকম ইঙ্গিত।

পরদিন হোটেল হতে আমাকে উঠিয়ে নীল প্রমা। বাকি কেউ ইচ্ছা করেই যেতে ছিলোনা। আমি মনে মনে হাসলাম এবং কোন কিছু জটিল না করে উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম কুড়িয়ে পাওয়া বাস্তবতা।

প্রথম দেখায় মনে হবে হলিউডের ক্যামেরায় আটকে রাখা কোন সিনেমার দৃশ্য। যতদূর চোখ যায় ধোয়া আর ধোয়া। থার্মাল স্পার্ক মাটি ফুঁড়ে রকেট গতিতে আকাশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রমাই নিয়ে গেল হ্যালিপ্যাডের দিকে। ওখানে চাইলেই হেলিকপ্টার ভাড়ায় পাওয়া যায়। মাস-খানেক আগে নাকি এক দুর্ঘটনায় দুজন প্রাণ হারিয়েছে। ধন্যবাদ জানিয়ে হেলিকপ্টারে আমার সহযাত্রী হতে অস্বীকার করলো প্রমা। দুর্ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইলাম না। পৃথিবীর এদিকটায় কোনদিন ফিরে আসবোনা, তাই যা দেখার যা ছোঁয়ার সবকিছু উপভোগ করতে চাইলাম।

১৫ মিনিটের জন্যে উড়ে গেলাম রটোরোয়ার আকাশে। পাশে পাইলট কাম ট্যুর গাইড। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। নীচের দিকে তাকালে মনে হবে হাজার বছর আগের অন্য এক সভ্যতায় ফিরে গেছি আমি। চারদিকে ঘন বন, বাষ্পের ধোয়ায় ছেয়ে আছে সবকিছু। চোখ বুজলে মনে হবে নিশ্চয় জুরাসিক পার্কের উপর দিয়ে উড়ছি আমি। নীচে ভালকরে তাকালেই দেখা মিলবে অতিকায় সব ডায়নাসোরদের।

রাতে হোটেলের পাশে একটা খালি জায়গায় BBQ'র আয়োজন হল। আগুন জ্বালিয়ে রাত ২টা পর্যন্ত কাটিয়ে দিলাম ওখানে। পাশেই চমৎকার একটা লেক। রাত হলেও ওখানে মানুষের কমতি ছিলনা। অনেক কপোত কপোতী তাদের ভালবাসা প্রকাশ্যে আনতে কার্পণ্য করছেনা।
রাতটা ছিল খুবই শান্ত। চারদিকে জ্যোৎস্নার প্লাবন। আমরা কোন কথা বলিনি সে রাতে। চুপ হয়ে যার যার মত ফিরে যাচ্ছিল ফেলে আসা অতীতে।

ফেরার পথে হেমিলটনে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। এখানেও অনেক কিছু দেখা হয়নি। বন্ধু শফিউল ইতিমধ্যে ঘুরে গেছে এ শহর। হাতে সময় ছিল সীমিত। তাই অস্থির হয়ে ছুটতে হয়েছিল এক জায়গা হতে অন্য জায়গায়।

অকল্যান্ড ফিরে দেখতে গিয়েছিলাম গলফ অব হাওরাকিতে চলমান আমেরিকা'স কাপ ইয়ট রেস দেখতে। বন্ধু শফিউলের আরও কজন বন্ধু দাওয়াত দিতে এসেছিল। তার এক রুশ বন্ধুর দাওয়াত অস্বীকার করার উপায় ছিলনা।

এভাবেই কেটে গেল বাকি সময়। এখান হতে ওখানে, এদিক হতে ওদিকে। শেষরাতে আমাদের আড্ডায় তৃতীয় কেউ যোগ দেয়নি। হয়ত ইচ্ছা করেই। পরিবারের বাকি সবাই চাইছিল আমরা দুই বন্ধু নিজেদের জমানো কথা জমানো স্মৃতি কেবল দুজনেই রোমন্থন করি।

অকল্যান্ড এয়ারপোর্টে বন্ধুর সাথে আলাদা হতে গিয়ে নিশ্চিত ছিলাম সহসাই দেখা হচ্ছেনা আমাদের। অন্তত পৃথিবীর এ প্রান্তে।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন