বিকেলে ভোরের গল্প…

Submitted by WatchDog on Saturday, January 8, 2022

ওটাই ছিল আমার শেষ বিলাত যাত্রা। অনেক স্মৃতি, অনেক কাহিনী, অনেক গল্পের শেষ হবে এ গ্রীষ্মের পর। ১৯৭৬ সালে শুরু হওয়া জার্নির ইতি টানবো এ যাত্রায়। মাঝখানে বাল্টিক সাগরের পানি অনেকদূর গড়িয়ে যাবে। দুই পৃথিবীর দুই জীবন খুব কাছ হতে দেখার সুযোগ হবে। দেখা হবে অনেক দেশ। পরিচয় হবে হরেক রকম মানুষের সাথ। কৈশোর অধ্যায়ের ইতি টেনে পা রাখবো যৌবনে। প্রেম, ভালবাসা, বিরহ, সেক্স অনেক কিছুর সাথে দেখা হবে প্রথমবারের মত। সে জীবন হবে স্বপ্নিল প্রতিশ্রুতিতে ভরা বিশাল ক্যানভাসের এক কাহিনী।

প্রতিবছর জুনের শেষদিকে শুরু হয় আমাদের গ্রীষ্মের ছুটি। ক্যাম্পাস জীবন দু'মাসের জন্যে থমকে যায়। রুশ ছাত্ররা চলে যায় নিজ নিজ শহরে। অনেকের ঠিকানা হয়য় লেবার ক্যাম্পে। সাইবেরিয়ার গহীন অরণ্যে তৈরি হচ্ছে রেললাইন। শ্রমিক সমস্যা মাথায় রেখে দেশটার কম্যুনিস্ট সরকার উৎসাহ দেয় ছাত্রদের। সারা বছর আর্থিক সমস্যায় ভোগা রুশ ছাত্ররা নাম লেখায় নির্মাণ ব্রিগেডে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে ওরা যখন ফিরে আসে পকেটে থাকে খরচ করার মত বেশকিছু রুবেল। আমি নিজেও একবার নাম লিখিয়েছিলাম এমন এক ব্রিগেডে। দু'মাসের কায়িক পরিশ্রমের সে কঠিনতম অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে শেয়ার করেছি পাঠকদের সাথে। ঐ বছরের গ্রীষ্মের ছুটিটা বাদ দিলে বাকি সবকটা ছুটি কাটাতে ছুটে গেছি আরও পশ্চিমে।

১৯৭৬ সালের জুলাই মাসের কোন এক পূর্ণিমা রাতে নেদারল্যান্ডের হোক ভ্যান হল্যান্ড হতে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে চেপে বসি নৈশ ফেরীতে। লম্বা জার্নির এ ছিল শেষ ঠিকানা। শুরুটা ছিল মস্কো হতে ট্রেনে চেপে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ। ওরারশ হতে পাশের দেশ পূর্ব জার্মানির রাজধানী পূর্ব বার্লিন। প্রথমবারের মত বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করে পশ্চিম বার্লিন। এবং ওখানে ট্রেন বদল করে পশ্চিম জার্মানির হ্যানোভার। হ্যানোভারে আরও একবার ট্রেন বদল। এবং সবশেষে নেদারল্যান্ডের রটোড্রাম হয়ে বন্দর শহর হোক ভ্যান হল্যান্ড।

ওভার-নাইট ফেরী জার্নিতেই প্রথম পরিচয় হয় পশ্চিম ইউরোপের খোলামেলা জীবনের সাথে। বিস্মিত না হলেও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক লৌহ বলয়ের সাথে পার্থক্যটা ধরতে খুব একটা সময় লাগেনি। যতটা ভালবাসা নিয়ে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় পা রেখেছিলাম ততটা দ্রুতই এ ভালবাসা উবে গিয়েছিল। সমাজতন্ত্রের নামে ১০০ জাতি ও ভাষার একটা দেশকে কি করে কম্যুনিস্ট রেজিম নিজেদের গিনিপিগ বানিয়ে রেখেছিল তা ধরতে অনেকের অনেক সময় লাগলেও আমার খুব একটা লাগেনি। কারণ আমি খুব দ্রুত সমাজের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কথা বলেছিলাম মানুষের সাথে। ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির একজন আর্মেনিয়ান কেন রুশদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিজেদের করে নেবে এ প্রশ্নের উত্তর খোদ আর্মেনিয়ানদের কাছেও ছিলনা। ওদের সাথে কথা বললে বেরিয়ে আসে ভেতরের চাপা ক্ষোভ ও বলশেভিকদের প্রতি জমে থাকা ঘৃণা।

এসব নিয়ে লিখতে গেলে লেখা যাবে বিশাল ক্যানভাসের এক কাহিনী। যার শুরু থাকলেও হয়ত আমার মত কাঁচা হাতের লেখক টেনেটুনে শেষ করতে পারবেনা। তাই উঠিয়ে রাখছি এ গল্প। আপাতত চলুন তল্পি-তল্পা গুটিয়ে রওয়ানা দেই লন্ডনের দিকে। ওখানে জমা আছে অনেক গল্প। এ যাত্রায় আমাকে আর ব্রিটিশ ভিসার জন্যে মস্কো যেতে হবেনা। ইতিমধ্যে এর বিকল্প আবিষ্কার করে নিয়েছি। রওয়ানা দেবো সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে। প্রথম স্টপেজ লিথুনিয়ার রাজধানী ভিলনিউস।

ভিলনিউস। পূর্ব ইউরোপ হতে যাত্রা করে পশ্চিম ইউরোপে যাওয়ার পথে প্রথম বিরতি। সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে প্রায় ৭২৫ কিলোমিটার পথ। দু'দিন দু'রাত্রির বিরামহীন ট্রেন জার্নির প্রথম পর্বে সাধারণত কোন বৈচিত্র্য থাকেনা। জানালার বাইরে তাকালে শুধু মাইলের পর মাইল সোভিয়েত জনপদ। কোথাও শূন্য, কোথাও আবার বিচ্ছিন্ন দু'একটা পরিবারের নির্জনতায় বেঁচে থাকার লড়াই। বছরের প্রায় ন'মাস এদিকটায় তুষারপাত হয়। বরফের আচ্ছাদনে মুখ লুকায় বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা সহ গোটা শহর। এর আগেও বেশ ক'বার এসেছি লিথুনিয়ায়। প্রথম আসা ক্লাসমেটদের সাথে শীতের ছুটিতে। দ্বিতীয়বার লন্ডন যাওয়ার পথে অনেকটা বাধ্য হয়ে।

সে বছরের তুষারপাত অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছিল। জনজীবনে নেমে এসেছিল নজিরবিহীন স্থবিরতা। একই পথে লন্ডন যেতে কোন অসুবিধা হয়নি। ভারি তুষারপাতের কারণে ট্রেনের গতি ছিল মন্থর, ছিল অতিরিক্ত সতর্কতা। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল ফেরার পথে। বার্লিন দেয়াল পেরিয়ে পশ্চিম হতে পূর্ব বার্লিনে পা রাখা মাত্র অনুভব করতে পারলাম পার্থক্যটা। তাপমাত্রা হিমাংকের নীচে প্রায় ৩০ ডিগ্রী। সাথে তীব্র হিমেল বাতাস। ট্রেন সোভিয়েত দেশে ঢুকবে কিনা এ নিয়ে দোটানায় ছিল কর্তৃপক্ষ। পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ'তে অতিরিক্ত সময় বসে থাকতে বাধ্য করল। সার্ভিস ট্রেন লাইন পরিষ্কার করছে। গ্রিন সিগন্যাল পেলেই কেবল সামনে বাড়বে। টেনেটুনে ভিলনিউস পর্যন্ত আসতেই পথচলা একেবারে থেমে গেলো।

আগাথা কৃষ্টির রহস্য উপন্যাস Murder On Orient Express যাদের পড়া আছে অথবা মুভি দেখা হয়েছে তাদের বুঝতে সুবিধা হবে। ইস্তাম্বুল হতে ছেড়ে আসা ট্রেন বেলগ্রেডের কাছাকাছি কোথাও থামতে বাধ্য হয় তুষারপাতের কারণে। এবং সে রাতে ট্রেনে সংগঠিত হয় একটি খুন। ঐ খুন ও ট্রেনে উপস্থিত ডিটেকটিভ হেরকুল প্যুয়ারোকে ঘিরে প্রসারিত হয়েছে আগাথা কৃষ্টির উপন্যাস। আমার বেলায় কোন খুন না হলেও গোটা একটা দিন কাটাতে হয়েছিল ভিলনিউসে। পৃথিবীর রঙ এতটা শুভ্র হতে পারে শহরে সময়টা না কাটালে বুঝতে পারতাম না। ট্রেন ষ্টেশনের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে বসে সময় হত্যা ছিল আমার জন্যে নতুন অভিজ্ঞতা। মাথার উপর ঝুলছিল ঘরে না ফেরার চরম অনিশ্চয়তা। রেলের লাইন বরফের এতটা নীচেই ডুব ছিল যা পরিষ্কার করার গাড়িগুলো কুলিয়ে উঠতে পারছিলনা। ট্রেনের হিটার বন্ধ করে দেয়ায় ওখানে অপেক্ষা করাও সম্ভব ছিলনা। এমন অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকে যখন হাবুডুবু খাচ্ছি তখনই পরিচয় হয় মেয়েটার সাথে।

মারিয়া তিশেভিচ। লম্বায় প্রায় ৬ ফুট। পায়ে হাই-হীল বুট। গায়ে ফারের কোট ও মাথায় শীতের টুপি। সবকিছু মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দরী এক মহিলা। ক্যাফেটেরিয়ার টেবিলে বসে কফি খাচ্ছি। ভীরের কারণ জায়গা না পেয়ে মারিয়াও যোগ দিল আমার টেবিলে। প্রথম দেখার হাসিটাই বলে দিল আলাপে অপরিচিতার কোন আপত্তি নেই। প্রতিবেশী অঙ্গরাজ্য লাটভিয়ার রাজধানী রিগার ট্রেনের অপেক্ষায় আছে সে। আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম কোন বাস্কেটবল ম্যাচে অংশ নিতে যাচ্ছে নাকি। দেখতে অনেকটা বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের মতই দেখাচ্ছিল। উত্তরে জানালো, আমার মতই শীতের ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত দুজনের আর ছাড়াছাড়ি হয়নি। ঠিকানা ও ফোন নাম্বার বিনিময়ের মধ্যদিয়ে সমাপ্ত হয়েছিল পরিচয় পর্ব। ততক্ষণে জীবন হতে কেটে গেছে প্রায় ২০ ঘণ্টা। মারিয়ার সাথে আবারও দেখা হবে। তবে সেটা ভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে।

এ যাত্রায় নির্ধারিত ৩০ মিনিটের এক মিনিটও বেশী অপেক্ষা করতে হয়নি। অনেক স্মৃতির এ শহরটায় কেবল ট্রেন ষ্টেশনে কাটাতে একটু কষ্টই হয়েছিল। ভিলনিউসের পুরানো শহর দেখতে তখনো ইউরোপ হতে শত শত পর্যটক ভিড় জমাতো। একসময় এ শহরকে বলা হতো ইউরোপের সাংস্কৃতিক রাজধানী। শহর বাসিন্দাদের অধিকাংশই ছিল ইহুদি। নেপোলিয়ন বলতেন, জেরুজালেম অব দ্যা নর্থ। সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হলেও শহর ও অঙ্গরাজ্যের সবকিছুতে ছিল স্ক্যান্ডিনেভিয়ান প্রভাব। ওদের ভাষায়ও ছিল প্রতিবেশী ফিনিশদের সুর। এস্তোনিয়া, লিথুনিয়া ও লাটভিয়া নিয়ে সোভিয়েত প্রি-বাল্টিক অঞ্চলে রুশরা নিজেদের অবৈধ দখল কোনদিনও শক্ত করতে পারেনি বিভিন্ন কারণে। ওদের সাথে আপন হয়ে মিশলে বিষয়টা সহজেই পরিষ্কার হয়ে যায়।

ট্রেন চলছে তো চলছেই। চার সীটের রুমটায় আরামের কোন ঘাটতি ছিলনা। প্রতি ওয়াগনে একজন করে কন্ডাকটর। ধবধবে সাদা বিছানা ও সাথে গরম চায়ের ব্যবস্থা এক সময় এসব রীতিমত নেশা ধরিয়ে দেয়। সহযাত্রীদেরও কাছে নিয়ে আসে। এ পথে বহুবার জার্নি করেছি। হরেক রকম মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। একে অন্যের জীবন শেয়ার করেছি। প্রথম দিকের উত্তেজনা ততদিনে থিতু হয়ে আসায় সে যাত্রায় ট্রেনের করিডোরে দাঁড়িয়ে বাইরের পৃথিবীকে দেখতে যাইনি। শুধু সময় গুনেছি কখন পৌঁছবো পরিবর্তী ঠিকানায়।
বেলারুশের এক সীমান্ত দিয়ে ঢুকে অন্য সীমান্ত গ্রদনি ক্রস করলেই পা রাখবো পোল্যান্ডের সীমান্ত শহর বেলাওস্তাকে। ওখানে বদল হবে ট্রেনের চাকা। ব্রডগেজ আর মিটার গেজের মিলন হয় এ সীমান্ত শহরে। ভারী ভারী ক্রেন এক লহমায় উপরে তুলে নেয় ট্রেনের বগী গুলো। বসানো হয় নতুন চাকা। এবং ঘণ্টা খানেকের ভেতর তৈরি হয় নতুন চলা।
একবার এক সহযাত্রী সোভিয়েত জেনারেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওয়ারশ জোটভুক্ত দেশগুলোর মাঝে এ তারতম্যের কারণ। উত্তরে ভদ্রলোক বলেছিলেন, এ সোভিয়েত ওয়ার ষ্ট্রাটেজির আরেকটা অংশ। ভবিষ্যতে যাতে নতুন কোন হিটলার এক দৌড়ে সীমান্ত অতিক্রম করে সোভিয়েত দেশে ঢুকতে না পারে তা নিশ্চিত করতে এই ব্যবস্থা।
ট্রেন লিথুনিয়ার বুক চিড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে সবুজের সমাহার। অনেকক্ষণ বাইরে তাকালে তন্দ্রা এসে যায়। বসন্তের শেষ ও গ্রীষ্মের শুরুতে পৃথিবীর এ অঞ্চলের মানুষ খোলস হতে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। বদলে যায় শরীরের পোশাক। বিশেষ করে তরুণীরা অপেক্ষায় থাকে নিজেদের অপ্রকাশিত যৌবন প্রকাশের জন্যে।
পরবর্তী স্টপেজ সোভিয়েত সীমান্ত শহর বেলারুশের গ্রদনী।

গল্প আমাকে দিয়ে হয়না। তাই যদি হতো তাহলে পৃথিবীর যত গলিতে পা রেখেছি, যত মানুষের সাথে মিশেছি তাদের সবাইকে নিয়ে লিখতে গেলে জমজমাট গল্প লেখা যেতো। এসব গল্পের প্রেক্ষাপট ছিল। ছিল পার্শ্ব চরিত্র। স্মৃতির গলি হাতড়ালে খুঁজে পাওয়া যাবে নায়িকাদেরও। মাঝেমধ্যে লিখতে ইচ্ছে করে। পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে করে জীবন নদীর গল্প। সব গল্প যদি কবরে নিয়ে যাই কষ্ট থেকে যাবে। আর আমার মত ভ্রমণ পিপাসীদের বঞ্চিত করা হবে কিছু কাব্যময় মুহূর্ত হতে। গল্প লিখতে প্রতিভা লাগে। এ প্রতিভা চর্চার ফসল হতে পারেনা। বরং মহা-বিস্ময়ের মহাকালের কোন এক গলিতে ঈশ্বর বলতে কেউ একজন থেকে থাকলে এটা তারই দান। এ যাত্রায় পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ'তেও ঘটবে এমন একটা ঘটনা যা নিয়ে অনেকেই উপন্যাস লিখতে পারতো। সে গল্প একটু পরের। আমি এখনো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতর। ট্রেনের জানালায় বসে বাইরের পৃথিবী দেখছি। তন্ময় হয়ে দেখছি বাইরের জীবন। এ যেন সেলুলয়েডের ফিতায় ধরা বিশাল এক মুভি।

লিথুনিয়ার রাজধানী ভিলনিউস ছাড়ার পর আর কোথাও থামার মত ষ্টেশন নেই। মাঝে মধ্যে ট্রেনের গতি শ্লথ হয়ে আসে। কখনো আবার সময় কভার করার জন্যে ঝড়ো গতিতে ছুটে চলে। এ অঞ্চলে শীতের প্রভাব অন্য যেকোনো এলাকার চাইতে একটু বেশী এবং দীর্ঘস্থায়ী। ভাল করে তাকালে উঁচু গাছগুলোতে বরফের অবশিষ্ট দেখা যায়। গ্রীষ্মের স্থায়িত্ব এখানে খুব ছোট। জুনের শেষদিকে মধ্যরাতেও সূর্যের দাপট থাকে। আবার মধ্য জানুয়ারিতে চব্বিশ ঘণ্টাই থাকে অন্ধকারের রাজত্ব। বেলারুশ সীমান্ত পার হয়ে কখন প্রিবাল্টিক এলাকা ত্যাগ করেছি বুঝার উপায় থাকেনা। কারণ আজকের মত সে সময় লিথুনিয়া, লাটভিয়া অথবা এস্তোনিয়া আলাদা কোন দেশ ছিলনা। ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের জগাখিচুড়ির একটা দেশ।

বেলারুশ সীমান্তের শেষ শহর গ্রদনো। ওটাই আমার গন্তব্য। ওখানেই মোকাবেলা করতে হবে সমাজতন্ত্র নামের স্বৈরশাসনের উত্তাপ। এ সীমান্ত শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সমীকরণটা খুব একটা সহজ নয় এ সীমান্তে। রুশরা এ সীমান্তের বর্ণনা দিতে গেলে অনেকটাই আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে। কারণ এ সীমান্ত দিয়েও প্রবেশ করেছিল দখলদার হিটলার বাহিনী। ছোট এ শহরের প্রতিটা ইট সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার। অনেক জায়গায় অক্ষত রাখা আছে হিটলার বাহিনীর পৈশাচিকতা। আমরা যারা এ পথে ভ্রমণ করি তাদের অবশ্য এসব দেখার খুব একটা সময় থাকেনা। ট্রেন থামে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পার হওয়ার জন্যে।

নিয়ম অনুযায়ী নেমে পরলাম ট্রেন হতে। অপেক্ষা করার জন্যে নির্দিষ্ট একটা জায়গা আছে। কাস্টম অফিসার ও তাদের ট্রেইনড কুকুরগুলো ট্রেনের প্রতিটা ওয়াগন চেক করবে। এমনকি ট্রেনের তলায় পাঠাবো অভিজ্ঞ কুকুরদের। অনেক সময় হোস পাইপ দিয়ে গরম পানি ছুড়ে নিশ্চিত করবে ওখানটায় কেউ লুকিয়ে নেই। অনেক বার বার্লিন ওয়াল অতিক্রম করার সময় দেখেছি একই চিত্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন হতে এক ডলার বাইরে নেয়ারও অনুমতি নেই। অথচ দুই দিন তিন রাতের এ লম্বা জার্নিতে বেঁচে থাকার জন্যেই চাই নগদ অর্থ। সীমান্ত শহর গ্রদনোই হচ্ছে সোভিয়েত অর্থ রুবেল ব্যবহারের শেষ ঠিকানা। সীমান্ত অতিক্রম করে পোল্যান্ডে ঢুকলে বাস্তবতা অন্যরকম। ডলারই একমাত্র বিনিময় মাধ্যম। সোভিয়েতদের জন্যে সমস্যাটা এখানেই। সীমান্ত বাহিনীর মূল কাজ হচ্ছে আমার মত বিদেশীদের বৈদেশিক মুদ্রার উৎস খোঁজা ।

হরেক উপায়ে মানুষ মুদ্রা পাচার করতে বাধ্য হয় এ পথে। বিশেষকরে যারা বিরাট অংকের ডলার নিয়ে বাইরে যায়। আমি কোন বারই ২০০/৩০০ ডলারের বেশী নিয়ে যাইনি। এ যাত্রায় আমার পুঁজি ছিল ৩০০ ডলার। পকেটের এক কোনায় লুকিয়ে দিব্যি ভাল মানুষের আচরণ করে পার পেয়ে যাই। মনুষ্য ও কুকুর পর্ব শেষ হওয়ার পর আমাদের আমন্ত্রণ জানালো নিজ নিজ ওয়াগনে ফিরে যাওয়ার। ষ্টেশনের ক্যাফেটেরিয়া হতে যথেষ্ট পানি ও ফলমূল কিনে ফিরে গেলাম নিজ সীটে। ফিরে যা দেখি তাতে কোনদিনও অবাক হইনা। কারণ জানতাম এমনটা হবে। অনেক সময় বালিশ পর্যন্ত কেটে কুটে চেক করে। লণ্ডভণ্ড থাকে বিছানা। ওরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেরায় লুকানো গুপ্তধন। আফ্রিকান ছাত্রদের বেলায় কাস্টমস থাকে মার্সিলেস নির্মম। অনেক সময় এখানেই শেষ হয় তাদের ভ্রমণ পর্ব। কারণ একটাই, মুদ্রা পাচার।

ঘণ্টা তিনেক পর গ্রদনো হতে রওয়ানা দিল সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে ছেড়ে আসা ট্রেন। মিনিট দশেক পর হাজির পোলিশ কাস্টম ও সীমান্ত পুলিশ। একটা দেশের ইমিগ্রেশন পুলিশের কাজ যদি হয়ে তার সীমান্ত অক্ষত রাখা, পোল্যান্ড সীমান্তের এ অংশে এলে সে ধারণা পালটে যেতে বাধ্য। তরুণ, বৃদ্ধ, সুন্দরী যে পুলিশই আসুক না কেন, তাদের প্রথম প্রশ্ন, তোমার কাছে কি বিনিময় করার মত ডলার আছে? প্রশ্নটা সরকারীভাবে বিনিময়ের জন্যে নয়, বরং ব্যক্তিগত পর্যায়ের লেনাদেনা। সমাজতন্ত্র মানুষকে কতটা নষ্ট করতে পারে পৃথিবীর এ অংশে না এলে বুঝতে পারতাম না।

আমার কাছে যে ৩০০ ডলার ছিল তার সবটাই এখন বৈধ! পোল্যান্ডে তা বদল করার মত বোকামি করতে গেলাম না। আমাকে এখনো অনেকদূর যেতে হবে। সামনে বেলাওস্তক। ট্রেনের চাকা বদলের জায়গা। সবকিছু প্ল্যান মাফিক শেষ হলে মধ্যরাতে হাজির হবো দেশটার রাজধানী ওয়ারশতে। চলুন কিছুটা বিশ্রাম নেই। কারণ অনেক ঘটনা ঘটবে পরের দিন। ভিসার জন্যে আমাকে দৌড়াতে হবে বার্লিনস্থ ব্রিটিশ এমবাসিতে। ভিসা পাওয়ার পর লোকাল ট্রেন ধরে যেতে হবে নেদারল্যান্ড এম্বেসিতে বেনেলাক্সের ভিসা নিতে (BENELUX - Belgium, Nederland & Luxembourg).

প্রকৃতির পরিবর্তন কত দ্রুত ঘটতে পারে পূর্ব ইউরোপের ঐ অংশে বাস না করলে হয়ত বুঝতে পারতাম না। শীতের রাজত্ব এ অঞ্চলে প্রশ্নাতীত। সেই যে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তুষারপাত শুরু হয় তার শেষ কবে কেউ জানেনা। ডিসেম্বরের শুরুতে বরফ এসে জায়গা করে নেয় তুষারপাতের। জমজমাট শক্ত বরফ এতটাই শক্ত হয় নদীর পানি জমে যায়। সে নদীতে সাদা সাদা পাল তোলা নৌকার বদলে চলে যন্ত্রচালিত ট্রাক। মৎস্য শিকারির দল নদীর উপর তাঁবু গেড়ে রাতের পর রাত কাটিয়ে দেয় শিকারের আশায়। আর আমার মত যারা পৃথিবীর অপর প্রান্ত হতে এ অঞ্চলে পাড়ি জমায় তারা ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে প্রহর গোনে বসন্তের। অনেক সময় বসন্তও কথা রাখেনা। মুষলধারার তুষারপাতের নীচে চাপা পরে যায় অপেক্ষার পালা।

মে মাসের নয় তারিখেও তুষারপাতের মোকাবেলা করতে হয়েছিল এক বসন্তে। শীতে তাপমাত্রা মাঝে মধ্যে হিমাংকের নীচে ৪০ ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যায়। স্থবির হয়ে যায় জনজীবন। বরফ ডিঙ্গিয়ে স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয়না বাচ্চাদের। অঘোষিত ছুটিতে যেতে হয় তাদের। সাইবেরিয়ার দিকে অবস্থা আরও কঠিন, আরও কষ্টের। সোভিয়েত লৌহ শাসনের গোঁড়ার দিকে যারা বিরুদ্ধচারন তাদের অনেককেই নির্বাসনে পাঠাতো সাইবেরিয়ার কঠিন প্রকৃতির সাথে লড়াই করতে। ঐ দিকটায় শীতের দিকে যাওয়া আমার মত এশিয়ান কারও পক্ষে যাওয়া মানে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ানো। কোন এক গ্রীষ্মে ঘটনাচক্রে সৌভাগ্য হয়েছিল রুশ দেশের তুন্দ্রা অঞ্চলে ঘুরে আসার। মনুষ্য জীবন ওখানে কঠিন। বেঁচে থাকতে প্রতিদিন প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করতে হয়। এসব নিয়ে ঐ অঞ্চলের মানুষের খুব যে একটা অভিযোগ আছে তা নয়। বরং খাপ খাইয়ে নিয়েছে প্রকৃতির এসব রুদ্রমূর্তির সাথে।

বসন্ত হঠাৎ করেই চলে আসে। ছাদ হতে বরফের বিশাল সব চাই মাটিতে আছড়ে পরে। ডর্মের রুমটায় বসে সে আওয়াজ শুনলে মন হাল্কা হয়ে যায়। আমরা বুঝতে পারি বসন্ত আসছে। বরফ গলতে শুরু করে। রাস্তা-ঘাট পানি আর কাঁদায় ভরে যায়। তারপর একদিন সূর্য পূব দিগন্তে মুখ তুলে জানায় আগমনী বার্তা। কদিন একনাগাড়ে উত্তাপ ছড়ালে রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার হয়ে যায়। গাছে গাছে সবুজের সমারোহ কখন যে জায়গা করে নেয় টেরই পাওয়া যায়না।

পোল্যান্ড সীমান্ত ঢুকে গেছি অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। বেলাওয়াস্তকে ট্রেনের চাকা বদলানোর সময় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস হাজির হয়। ওদের চেক করার বিশেষ কিছু থাকেনা। কারণ দেশটায় আমার মত যাত্রীরা থাকতে আসেনা। ট্রানজিট ভিসা নিয়ে পাড়ি জমায় পশ্চিমের দিকে। যদিও ষ্ট্যুরিষ্টদের আকর্ষণ করতে সরকারী চেষ্টার অন্ত থাকেনা।

অদ্ভুত এক দেশ এই পোল্যান্ড। সোভিয়েত বলয়ের অন্যতম প্রধান দেশ। ওয়ারশ সামরিক প্যাক্টকে ঘিরে পল্লবিত হয়েছে সোভিয়েত সামরিক শক্তি। অথচ দেশটার সীমান্তে পা রাখলেই চোখে পরে এর দৈন্যতা। চারদিকের বাড়ি-ঘরে ক্ষয়ের চিহ্ন। চোখে পরার মত কোন জৌলুষ নেই। একজন ইমিগ্রেশন অফিসার এসে যখন জিজ্ঞেস করে এক্সচেঞ্জের জন্য ডলার-পাউন্ড আছে কিনা, এক লহমায় ধরে নেয়া যায় দেশটার অর্থনৈতিক ভিত্তি।

ঘটনা আরও কয়েক বছর আগে। সে বছর গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটিয়ে লন্ডন হতে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে যাচ্ছি। ওয়ারশতে আমার ট্রানজিট। ট্রেন বদলাতে হবে। ইউরোপের আর দশটা দেশ মনে করে কাউন্টারে হাজির হয়ে আমার ফিরতি জার্নির টিকেট দেখাই। রাতে ঘুমানোর মত একটা সীট দরকার আমার। কাউন্টারে মধ্যবয়সী এক মহিলা ম্যাগাজিন উলটে সাজগোজের কিছু একটা দেখছিল। আমাকে দেখে মুখ কুচকে ফেললো। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি চাই। পূর্ব ইউরোপের মানুষদের গায়ের রঙ নিয়ে এলার্জিতে ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই অবাক না হয়ে বিনয়ের সাথে একটা রাতের ট্রেনের একটা সীট চাইলাম। মহিলা কোনোদিক না তাকিয়ে নিমিষের মধ্যা আমাকে জানিয়ে দিল আগামী ৭ দিনের জন্যে কোন সীট নেই। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আগামী ২৪ ঘণ্টায় আমাকে সোভিয়েত সীমান্তে পা রাখতেই হবে। নইলে কোনদিনই ঢুকতে পারবোনা দেশটায়। কঠিন আইনের দেশ এই সোভিয়েত ইউনিয়ন।

মন খারাপ করে প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে আছি। সম্ভাব্য সব সিনারিও বিশ্লেষণ করছি। পাশে কেউ একজন বসেছে টের পেলাম। কালো আফ্রিকান একজন। হাতের পোটলা পুটলি দেখে বুঝতে পারলাম সে-ও আমার মত সোভিয়েত ইউনিয়নে যাচ্ছে। পার্থক্য হচ্ছে, ওর মুখে হাসি এবং প্রাণ খুলে মনের আনন্দে গান গাইছে। আমার সমস্যা তুলে ধরতে সে হো হো করে হেসে উঠলো। মিনিটের ভেতর সমাধান দিল। কারণ সেও একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। বুক পকেটে একটা পাঁচ পাউন্ডের নোট রেখে আবারও গেলাম কাউন্টারে। একই মহিলা। আমার মুখ দেখার আগে দেখল আমার বুক পকেট। লম্বা একটা হাসি দিয়ে আবারও জানতে চাইলো আমার প্রয়োজন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার করার পর জানতে চাইলো মূল্য পরিশোধ করবো কোন কারেন্সিতে। সদ্য পরিচিত আফ্রিকান বন্ধুর উপদেশ মত আঙ্গুল তুলে বুক পকেটের দিকে ইশারা দিলাম। মন্ত্রের মত কাজ দিলো। তোতা পাখির মত উত্তর দিল, রাতের জন্যে অপেক্ষা করতে না চাইলে আধাঘণ্টার ভেতর একটা ট্রেন আসবে। গাদানক্স ঘুরে গ্রদনোর দিকে যাবে। রাতের সীটেই ফয়সালা করলাম। মূল্য ৫ পাউন্ড। সমাজতন্ত্র পৃথিবীর এ অঞ্চলের মানুষকে কতটা কলুষিত করেছিল তার চমৎকার একটা ডিসপ্লে এই ট্রেন জার্নি।

ঘণ্টা দেড়েক পর রাজধানী ওয়ারশ এসে থেমে গেলো আমার ট্রেন। এখানে লম্বা একটা বিরতি। রিফ্রেশমেন্টের জন্য সবাই ট্রেন হতে নেমে পরে। এই নেমে পরায়ও অনেক রকম বিপদ থাকে। এই যেমন পোলিশ মহিলাদের খপ্পর। ভুলিয়ে বালিয়ে নিজেদের আস্তানায় নিয়ে সব কিছু রেখে উলঙ্গ করে ছেড়ে দেয়ার কাহিনীও শুনেছি অনেকের মুখে। এ পথে এতবার জার্নি করেছি সবকিছু আমার মুখস্থ। কারও চেহারা দেখে বলে দিতে পারি তার উদ্দেশ্য। ষ্টেশনে নেমে কিছু কেনাকাটি করলাম। এখানে সোভিয়েত মুদ্রা রুবেলেও কেনাকাটি করা যায়। পকেটে বেশকিছু রুবেল ছিল, যতটা সম্ভব খরচ করে অতিরিক্ত কিছু খাবার ও পানি কিনে ফিরে গেলাম ট্রেনে।

এবার লম্বা একটা ঘুমের পালা। খুব ভোরে ট্রেন সীমান্ত শহর ফ্রাঙ্কফুর্ট-আন-ডের-ওডের দিয়ে পূর্ব জার্মানিতে ঢুকবে। অবশ্য মাঝখানে পোলিশ শহর পজনানে কিছুক্ষণের জন্যে ট্রেন থামবে যা আমি টের পাবোনা। আমাকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঢুকতে হবে সমাজতন্ত্রের ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার পূর্ব জার্মানিতে। শেষ রাতের দিকে জার্মান সীমান্ত রক্ষীদের কর্কশ ডাকে ঘুম ভাঙ্গবে।

পোল্যান্ড হতে রওয়ানা দিয়ে ট্রেনে খুব একটা ঘুমাতে পেরেছি তা নয়। চার বিছানার কম্পার্টমেন্টে দুটোই ছিল খালি। একমাত্র সহযাত্রী ওয়ারশ হতে যোগ দিয়েছে। প্রয়োজনীয় কিছু কথা ছাড়া তেমন কোন বাক্যালাপ হয়নি। উঠার সাথে সাথে ব্যাগ হতে ভদকার বোতল নামিয়ে বসে গেছে নিজ কাজে। পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশে এ আজব সংস্কৃতি। ট্রেনে ওভার-নাইট জার্নি ও ভদকার সাথে তাদের সম্পর্কটা যেন অবিচ্ছেদ্য। ওরা এ কাজটা করবেই। ট্রেনে উঠা মাত্র পরনের কাপড় ছেড়ে রাতের পোশাক পরে বের করবে ভদকার বোতল। এবং তা চলতে থাকবে স্টক না ফুরানো পর্যন্ত। মাতলামির চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পরবে। এবং শুরু করবে নসিকা্র মাল্টি ডিরেকশনাল মিউজিক। এ যাত্রায় আমাকেও যোগ দেয়ার অনুরোধ করেছিল সহযাত্রী। ধন্যবাদ জানিয়ে আমার লম্বা জার্নির কথা জানাতে আর বেশী জোরাজুরি করেনি।

খুব ভোরে জার্মান পুলিশের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ডাকের তীব্রতা এতটাই রুক্ষ যাদের হার্টে সমস্যা তাদের বেলায় তা হয়ত চরম কোন পরিণতি ডেকে আনতে বাধ্য। আমি অবশ্য এসবের সাথে ইতিমধ্যে আপোষ করে নিয়েছি। মেনে নিয়েছি জার্মানরা এমনই। ঢাকার সদরঘাটে দেখা ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের মত গলায় একধরণের ট্রে ঝুলিয়ে পঙ্গপালের মত ওরা ঢুকে পরে ট্রেনের বগিতে। চোখেমুখে মনুষ্যত্বের কোন ছায়া থাকেনা। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে সাইন্স ফিকশনের একদল রোবট। আন্তর্জাতিক সীমান্তের রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে জার্মান ভাষাকে ব্যবহার করে ইমিগ্রেশন ভাষা হিসাবে। এবং তা ভয়াবহ কর্কশ।

মুখের ভাষা যে খুব একটা লম্বা হয় তা নয়। খুব সীমিত ও সংক্ষিপ্ত শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাপ্ত হয় ইমিগ্রেশন পর্ব। পাসপোর্ট চাইবে। হাতে নিয়ে দ্রুত পাতা উল্টাবে এবং ছবির পৃষ্ঠায় এসে থেমে যাবে। এক মিনিটের জন্যে স্থির হয়ে যাবে তাদের শরীর। পলক না ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে সামনের মানুষটির দিকে। দু'একবার তাকাবে পাসপোর্টের ছবির দিকে। এবং এসব শেষ হওয়ার পর খটাস করে সিল মারবে পাসপোর্টে। ভালমন্দ কিছু না বলে চলে যাবে পরের জনের কাছে।

চব্বিশ ঘণ্টার ট্রানজিট ভিসা সেন্ট পিটার্সবার্গ হতেই নেয়া ছিল। তাই বর্ডার পুলিশের হরেক রকম সাইকোলজিক্যাল কেরামতিতে বিভ্রান্ত হওয়ার কোন কারণ ছিলনা। পাসপোর্টে ওরা যে সীলটা মারে তার শব্দও ছিল সীমিত; পূর্ব জার্মানির সংক্ষিপ্ত নাম DDR (Deutsche Demokratische Republik) ও তারিখ। আমার বাংলাদেশি পাসপোর্টের মোটা আকৃতির মূল কারণ ছিল পূর্ব জার্মান সীমান্তের এই সিল।

অদ্ভুত দেশ এই পূর্ব জার্মানি। আরও অদ্ভুত ছিল দেশটার রাজধানী পূর্ব বার্লিন। অনেকের মতে ডি ফ্যাক্টও সিটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে মিত্র বাহিনী চারভাগে ভাগ করে নেয়। একভাগের নিয়ন্ত্রণ নেয় পূবদিক হতে আসা সোভিয়েত বাহিনী, যা পরিবর্তীতে পূর্ব জার্মানি নামে আত্মপ্রকাশ করে। বাকি জার্মানির নিয়ন্ত্রণ নেয় মিত্রবাহিনীর বাকি দেশগুলো, যা পশ্চিম জার্মানি হয়ে টিকে থাকে। পূর্ব জার্মানির রাজধানী পূর্ব বার্লিনের জন্মও এই কনফ্লিক্টের মাঝে। বার্লিন শহরকেও একই কায়দায় নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় মিত্রবাহিনী। পকেট শহর হিসাবে পশ্চিম বার্লিনের অস্তিত্ব অনেকটাই ছিল দুই পরাশক্তির আভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফসল।

পোলিশ সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব জার্মানিতে পা রাখলে এরাইভেল সিল মেরে স্বাগত জানায় দেশটার ইমিগ্রেশন পুলিশ। রাজধানী পূর্ব বার্লিন পৌঁছে বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করার সময় এক্সিট ভিসা দিয়ে বিদায় দেয় পূর্ব জার্মানি। আরও পশ্চিমে যেতে যাইলে পশ্চিম বার্লিন সীমান্ত অতিক্রম করে আবারও ঢুকতে হয় পূর্ব জার্মানিতে। এবং আবারও এরাইভেল সিল। পাশের দেশ পশ্চিম জার্মানিতে ঢুকার সময় এক্সিট সিল দিয়ে বিদায় জানায় পূর্ব জার্মানি। ইতিমধ্যে কম করেও হলেও ত্রিশ বার এ পথ পাড়ি দিয়েছি আমি। একমাত্র পূর্ব জার্মান ইমিগ্রেশন সীলের কারণে আমার পাসপোর্ট ৪ বার নবায়ন করতে হয়েছিল। একসাথে ষ্ট্যাপলার করা পাসপোর্টগুলো দেখলে যে কারও মনে সন্দেহ জাগার যথেষ্ট কারণ ছিল। এ নিয়ে আমার ভোগান্তির ইতিহাসও কম ছিলনা।

খুব ভোরে পূর্ব বার্লিন ষ্টেশনে এসে ট্রেন থামল। বাইরের পৃথিবী তখনো জেগে উঠেনি। শহরের উঁচু উঁচু দালানগুলোর মাথা ডুবে ছিল কুয়াশার চাদরে। বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের শুরুতেও শীতের প্রকোপ মুছে যায়না পৃথিবীর এ প্রান্তে। বিশেষকরে সকালের দিকে। অবশ্য চারদিকের গাছপালার দিকে তাকালে প্রকৃতির পরিবর্তন সহজেই চোখে পরে। এত সকালে কোথাও যাওয়ার তাগাদা থাকেনা, তাই ট্রেন ষ্টেশনে বসেই কাটাতে হয় কয়েক ঘণ্টা। ৯টায় ব্রিটিশ এম্বেসির ভিসা সেকশন খুলবে। ওটাই আমার প্রথম গন্তব্য। সময় মত ভিসা পাওয়া গেলে দৌড়াতে হবে নেদারল্যান্ড দূতাবাসে। সকালের ব্যস্ততা শেষ করতে দুপুর গড়াবে। এবং তারপরই অতিক্রম করতে যাবো বার্লিন দেয়াল।
সকাল ৬টার ভেতর ষ্টেশনের পাশে কফি শপটা তাদের দরজা খুলে দেয় গ্রাহকদের জন্যে। দোকানের বাইরে বেশকটা চেয়ার টেবিল বসিয়ে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়। প্রতি গ্রীষ্মে এক কাপ কফি নিয়ে অনেকক্ষণ উপভোগ করি পূর্ব বার্লিনের সকাল। এ যাত্রায়ও বাদ দিলাম না।

দরজা খুলে কাউন্টারের বৃদ্ধাকে guten morgen সম্বোধন করতেই এক ঝিলিক হাসি দিয়ে বসতে অনুরোধ করলো। পূর্ব ইউরোপে এ ধরণের হাসি খুবই বিরল। বিশেষকরে গ্রাহক-সেবায়। মনটা হাল্কা হয়ে গেল। রাতের ক্লান্তিও যেন কিছুটা দূর হলো। কফির মৌ মৌ গন্ধ সুবাসিত হয়ে উঠলো চারদিক।

ইউরোপ তুলনামূলক ছোট মহাদেশ। দেশ অনেক, কিন্তু একদেশ হতে অন্যদেশ আকাশ পথে রওয়না দিলে ভ্রমণ খুব একটা দীর্ঘ হয়না। ট্রেন জার্নির অবস্থাও একই রকম। ঘাটে ঘাটে সীমান্ত অতিক্রম করার ঝামেলা না থাকলে এক কোনা হতে অন্য কোনায় যেতে খুব একটা সময় লাগার কথা না। প্রতিবারের মত এ যাত্রায় আমি রওয়ান দিয়েছি পূর্ব ইউরোপের সেই সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে। পোল্যান্ড হয়ে পূর্ব জার্মানির রাজধানী পূর্ব বার্লিন পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে গোটা একটা দিন ও দুটো রাত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যায় হয়েছে বিভিন্ন সীমান্তে। একদিকে ইমিগ্রেশন অন্যদিকে কাস্টমস। তার উপর পোলিশ সীমান্তে ট্রেনের চাকা বদল। এসব বাধা না থাকলে দ্রুত গতির ট্রেনে সময় নিশ্চয় কমে আসতো। তবে এ নিয়ে আমার কোন অভিযোগ ছিলনা। গ্রীষ্মের এ সময়টা গোটা ইউরোপ নতুন সাজে সজ্জিত হয়। কেবল প্রকৃতিই নয়, মানুষগুলোও শীতের খোলস হতে বেরিয়ে নিজেদের তুলে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পরে। বিশেষকরে মেয়েরা। পরিবর্তনটা প্রথম চোখ লাগে তাদের পোশাকে। উপভোগ করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি এসব দৃশ্য।

এ পথে অনেকবার ট্রেন ধরে ইংল্যান্ড গেছি। কখনো হল্যান্ড হয়ে, কখনো আবার বেলজিয়াম হয়ে। প্রতিটা জার্নি ছিল ইউনিক। হরেক রকম মানুষের সাথে দেখা হয় লম্বা এ পথে। ভাষার বৈচিত্র্য এতটাই বেশী মাঝে মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলতে হয় ট্রেনের কোঅর্ডিনেশন নিয়ে। বার্লিন হতে একবার নেদারল্যান্ডের হোক ভ্যান হল্যান্ড গামী ট্রেনে চেপে বসেছি। বরাবরের মত সীটে বসে বাইরের পৃথিবী দেখছি। লম্বা এসব জার্নিতে জানালার পাশে বসলে এমনিতেই তন্দ্রা এসে যায়। পশ্চিম জার্মান শহর হ্যানোভারে ট্রেন ভাগ হয়ে যায়। কিছু বগি আলাদা করে জোরা লাগানো হয় বেলজিয়াম-গামী ট্রেনের সাথে। আমি ভুল ওয়াগনে বসে আছি তা বুঝতে পারিনি।

পূর্ব বার্লিনের কফি শপটায় বসে অলস কিছু সময় কাটাতে বাধ্য হলাম। প্রতিবারই তাই করি। এ শহরে দেখার মত তেমন কিছু নেই। যা দেখার তা দেখতে গেলে মন খারাপ হয়ে যায়। শহরের সবকিছুতে যুদ্ধের স্মৃতি। শহরের প্রতিটা দেয়াল, রাস্তা-ঘাটের নিজস্ব কিছু কথা আছে। আছে ধ্বংস ও মৃত্যুর কাহিনী। দেশটার কম্যুনিস্ট সরকার সযত্নে লালন করে চলছে এসব কথা। নতুন প্রজন্মের জন্যে সৃষ্টি করে রেখেছে মগজ ধোলাই কারখানা। এসব কথা বাইরে আসেনা। রাস্তায় হাঁটলে বুঝা যাবেনা। কিন্তু বাতাসে কান পাতলে এখনো শোনা যাবে ১৯৪৫ সালের মে মাসের তাণ্ডব। শোনা যাবে পূব দিক হতে আসা সোভিয়েত ট্যাংক বহরের ভারী আওয়াজ। পূর্ব বার্লিনে প্রথম বার পা রেখেই এর অলিগলি হেটে নিয়েছি। Brandenburg Gate, Reichstag Building'র মত ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও অনুভব করার চেষ্টা করেছি ইতিহাসের স্পন্দন।

সকাল সাড়ে নয়টায় ব্রিটিশ এম্বেসি তার ভিসা কার্যক্রম শুরু করে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকাতেই ওদিকটায় রওয়ানা দেয়ার তাগাদা অনুভব করলাম। খোলার সাথে সাথে ঢুকতে পারলে তালিকায় প্রথম হওয়া যায়। এবং ঘণ্টা খানেকের ভেতর ভিসা প্রক্রিয়া শেষ করে বাকি কাজ করার যথেষ্ট সময় হাতে থাকে। অবশ্য আমার মত পূর্ব ইউরোপের অন্য দেশ হতে ভিসা প্রার্থীর সংখ্যা এখানে একেবারে হাতে গোনা। মূলত যারা আসে তারা বয়স্ক পূর্ব জার্মান। নির্দিষ্ট একটা বয়সের পর পূর্ব জার্মানদের পশ্চিম ইউরোপের যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। তাও এক লম্বা প্রক্রিয়ার পর। বাইরের জানালা গলে ভেতরে চোখ বুলাতে মন হালকা হয়ে গেল। ভিসা সেকশনে তেমন কেউ নেই।
এম্বেসির মূল ফটকে চুল হতে মাথা পর্যন্ত পরখ করার পর পাসপোর্ট পরীক্ষা করলো। এর আগেও এখান হতে ভিসা সংগ্রহ করেছি। ওটাই ছিল আমার ক্লিয়ারেন্স। ভেতরে ঢুকে চেনা পথ গলে হাজির হলাম ভিসা সেকশনে। যান্ত্রিক একটা হাসি দিয়ে এক সেট ফর্ম চাইলাম। পালটা কোন হাসি না পেলেও ফর্ম পেতে দেরী হলোনা। লম্বা ফর্ম। প্রশ্ন অনেক। তবে এসবের উত্তর আমার মুখস্থ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। অনেকটা যান্ত্রিক কায়দায় পূরণ করে দ্রুত জমা দিলাম কাউন্টারে। সাথে ফী। মিনিট দশেক পর কাউন্টারে ডাক পরলো। তাদের প্রশ্ন একটাই; মস্কো হতে ভিসা না নিয়ে কেন এখানে এসেছি? উত্তর আমার মুখস্থ ছিল। সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে মস্কো প্রায় ৮/৯ ঘণ্টার ট্রেন জার্নি, এবং তা উলটো দিকে। তাছাড়া মস্কো যেতে আমার মত বিদেশীদের ভিসা লাগে। ওখানে হোটেলে থাকতে গেলে ইন্টারনাল ভিসা দেখানো বাধ্যতামূলক। মস্কোস্থ ব্রিটিশ দূতাবাসে ভিসার জন্যে লম্বা লাইন দিতে হয়। এবং তার জন্যে সকাল ৭টার ভেতর ওখানে হাজির হতে হয়। ব্রিটিশদের কনভিন্স ক
রার জন্যে আমার কারণ গুলো যথেষ্ট ছিল। প্রথম বার ভিসা নেয়ার সময়ই তা বুঝে নিয়েছিলাম। নিশ্চিত না হয়ে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এখানে ভিসা নিতে আসতাম না।
ব্রিটিশ দূতাবাস হতে ভিসা নিয়ে বের হতে ১১টা বেজে গেল। ইতিমধ্যে পূর্ব বার্লিন শহর জেগে উঠেছে। চারদিকের ব্যস্ততা চোখে পরতে বাধ্য। তবে এসব ব্যস্ততা কোন অর্থেই পশ্চিম ইউরোপের ব্যস্ত কোন শহরের মত না। শ্রীহীন সোভিয়েত গাড়ি, চাকচিক্যহীন ধীরগতির ট্রাম্প, লম্বা ট্রলি-বাস ও সাথে বিক্ষিপ্ত জনমানুষের চলাচল কোনভাবেই পাশের পশ্চিম বার্লিনের চেহারার সাথে মেলানো যাবেনা। একই মহাদেশে যেন ভিন্ন দুই পৃথিবী। রাস্তায় দেখা মানুষের চেহারা ও পোশাকেও পার্থক্য ধরা পরতে বাধ্য। এখানের সবকিছুই কেমন মলিন এবং অনেকটা স্থবির।

ইতিহাস ভূগোল ভেবে নষ্ট করার মত সময় ছিলনা আমার হাতে। বেশকিছুটা হাঁটতে হবে শহরের রাস্তা ধরে। তারপর উঁচু একটা দালানের লিফট ধরে উঠতে হবে বেশকিছুটা উপরে। গন্তব্য, নেদারল্যান্ড দূতাবাস। ওখানেও ভিসা নিতে হবে।

বার্লিন দেয়াল। দেশ, মহাদেশ, এমনকি সংসার বিভক্তির দেয়াল দেখেছি। সময়ের প্রবাহে সবই মেনে নিয়েছি। অভ্যস্ত হয়ে গেছি এসব বিবর্তনে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাসের সাক্ষী এই বার্লিন দেয়ালের সামনে যতবার দাঁড়িয়েছি ততবার শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে গেছে অদ্ভুত একটা শীতল শিহরণ। মেনে নিতে কষ্ট হয় কেবল একজন মানুষের কারণে প্রাণ হারিয়ে ছিল কোটি কোটি মানুষ। দেয়ালের সামনে দাঁড়ালে সেলুলয়েডের ফিতার মত চোখের সামনে ভেসে উঠে ১৯৪৫ সাল। যুদ্ধের পূর্ব ফ্রন্ট হতে রুশদের বার্লিন অভিযানের কাহিনী কেবল সিনেমায় দেখিনি, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক সৈনিকের মুখ হতে শুনেছি এর ভয়াবহতা। আমার ইতিহাস শিক্ষক আনাতোলি স্তেপানভিচ তার যুদ্ধাভিযান শেষ করেছিলেন এই বার্লিন শহরে। আহত হয়েছিলেন। যুদ্ধের শেষ প্রহরে ট্যাংকে চড়ে ঘুরে বেরিয়েছিলেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বার্লিন শহরে। এ দৃশ্য বর্ণনা আবেগে থর থর করে কাঁপছিলেন। দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছিল অশ্রুধারা। একটা ডকুমেন্টারিও দেখিয়েছিলেন ক্লাসে। সেখানে তিনি ছিলেন। শত শত তরুণ সৈনিকদের মাঝে হ্যান্ড-সাম একজন। হাতে বেয়নেট সহ রাইফেল।

আমাদের ডর্মের গার্ড তাতিয়ানা আলেক্সেয়েভনার স্বামী প্রাণ হারিয়েছিলেন বার্লিন যুদ্ধে। তিনি নিজেও ছিলেন বার্লিনের দোরগোড়ায়। নার্স হিসাবে সেবা করেছিলেন যুদ্ধাহত সৈনিকদের। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনলে রক্ত হিম হয়ে আসে। ব্যাটল ফর বার্লিন মিশনে পশ্চিম হতে আসা মিত্র বাহিনীর বাকি দেশের সৈন্যরা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে দখল নেয় শহরে এক অংশ। এই অংশই তখন পশ্চিম বার্লিন হিসাবে পরিচিত ছিল। বার্লিনের পূর্ব অংশের দখল চলে যায় সোভিয়েতদের হাতে। পূব ও পশ্চিম বার্লিনের বিভক্তি নিশ্চিত হয় মিত্র বাহিনীর নিজেদের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে।

এর আগে কম করে হলেও ত্রিশ বার অতিক্রম করেছি বার্লিন দেয়াল। হয় চলন্ত ট্রেনে, অথবা পায়ে হেঁটে। ট্রেনের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর না হওয়ায় সাধারণত হেঁটেই মোকাবেলা করেছি একই শহরে দুই রাজার শাসন। দেয়ালের দুই পাশে দুই ধরণের জীবন। পূবের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় সমাজতান্ত্রিক শাসনের কঠিন যাঁতাকলে। পশ্চিমে পুঁজিবাদের বাজার ভিত্তিক খোলা অর্থনীতি। পার্থক্যটা চোখে পরতে বাধ্য। পশ্চিম বার্লিনে পা রাখা মাত্র চোখ পরবে এর চাকচিক্য। চারদিকে আলোর ঝলকানি। হরেক রকম গাড়ির মিছিল। পাশাপাশি দারিদ্রের অবস্থানও চোখে পরতে বাধ্য। গৃহহীনরাও হাঁটছে পাশাপাশি। ওদের কোন গন্তব্য নেই। এলোমেলো হেটে বেড়ানো মানুষরা মনে করিয়ে ঝলমলে আলোর অন্য-পীঠেই বাস করে অন্ধকার এক জীবন।

শহরের Zoologischer Garten ষ্টেশনের প্লাটফর্মে মাতাল গৃহহীনদের দেখলে একটা সন্দেহ দানা বাধতে বাধ্য; ওরা আসলেই কি বাজার অর্থনীতির বাই-প্রোডাক্ট, না-কি জীবন হতে পালিয়ে বেড়ানো একদল ব্যর্থ মানুষের সেলফ আইসোলেশন।

বার্লিনের পূর্ব অংশেই যত পুলিশ ও ইমিগ্রেশন ঝামেলা। পশ্চিমে এর নাম গন্ধ নেই। দেয়াল সীমান্তে পূর্ব জার্মান পুলিশদের দেখলে মনে হবে দম দেয়া একদল হায়েনা। হায় হ্যালো বলার সংস্কৃতি নেই। চেহারায় সব সময় একটা বিরক্তির ভাব। চোয়াল থাকে শক্ত। বরাবরের মত এ যাত্রায়ও পূর্ব জার্মান পুলিশের হাতে পাসপোর্ট হস্তান্তর করা মাত্র জমে গেল। পাসপোর্ট পাতার ছবির পৃষ্ঠা খুলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। কম করে হলেও দশবার টার্গেট বদল করল। একবার আমার দিকে, আবার পাসপোর্টের দিকে। এসব দৃশ্যের সাথে আমার অনেকদিনের পরিচয়। তাই অবাক হলাম না। ভিসা নিয়েই দেশটায় পা রেখেছি। তাছাড়া পূর্ব জার্মানিতে অবৈধ অভিবাসীদের কোন চাপ ছিলনা। এ দেশে বাইরের পৃথিবী হতে কেউ থাকতে আসেনা। পুলিশের চোখের তেলেসমাতিতে তাই ভীত হওয়ার কোন কারণ ছিলনা আমার। আমি জানি এভাবেই ওদের ট্রেনিং দেওয়া হয়।

এই দেয়াল এক অর্থে দুই পরাশক্তির ফোর ফ্রন্ট। তাই সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে এ নিয়ে সন্দেহ ছিলনা। ট্রেনে করে বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করতে গেলে নিরাপত্তার অংশ হিসাবে হোস পাইপ দিয়ে গরম পানি ঝড় বইয়ে দেয়া হয় ট্রেনের তলায়। এভাবেই নিশ্চিত করা হয় পূর্ব জার্মানদের কেউ লুকিয়ে পশ্চিমে যাচ্ছেনা। কম করে হলেও পাঁচ মিনিট সময় নেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। কোন প্রশ্ন থাকলে তা খাঁটি জার্মান ভাষায় ছুড়ে দেয়। সমস্যা দেখা দিলে এসকর্ট করে নিয়ে যায় গোপন কুঠুরিতে।
না, এ যাত্রায়ও আমার কোন সমস্যা হলোনা। খটাস করে এক্সিট সিল মেরে ফিরিয়ে দিল পাসপোর্ট। তিন চার কদম হাঁটলেই পা রাখা হয় পশ্চিম বার্লিনে। অনেকদিন পর আবারও পশ্চিম বার্লিনে। সকাল প্রায় ১১টা। জীবন ততক্ষণে ফুল স্কেলে এগিয়ে চলছে।

চারদিকে গাড়ির মিছিল। বিপণি বিতানগুলোতেও মানুষ গিজ গিজ করছে। পীপ শো গুলোতেও ভিড়। ওখানে কাউন্টারে জার্মান মার্ক ঢাললে ছোট একটা জানালা খুলে যায়। মেয়েদের কাপড় খোলা দেখার বিনোদনের জায়গা। কাছেই অনেক হার্ড-কোর পর্ণের মুভি থিয়েটার। বার্লিনের পূব পাশে এসব অকল্পনীয়। অনেক ক্ষেত্রে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুই সমাজ ব্যবস্থার পার্থক্য বাস্তবতা উপলদ্বি করার পারফেক্ট প্রেক্ষাপট। দুইটার দিকে আমাকে নেদারল্যান্ড গামী ট্রেন ধরতে হবে। ব্যায় করার মত কিছুটা সময় আছে হাতে। দেশে ফোন করতে হবে। মার সাথে কথা বলা হয়না অনেকদিন।

প্রতিবার পশ্চিম বার্লিনে পা রেখে প্রথম যে কাজটা করি তাহলো ফোন করে বাড়ির সবাইকে অবাক করে দেয়া। পূর্ব ইউরোপের কোন দেশ হতেই এমনটা সম্ভব ছিলনা। ফোন করতে গেলে আগ বাড়িয়ে পোষ্ট অফিসে বুক করে আসতে হয়। ওরা ফোন করে সময় সীমিত করে দেয়। আমার ১২ বছরের সোভিয়েত জীবন কেবল দুইবার সক্ষম হয়েছিলাম দেশে কথা বলতে। তাও কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে। এমনটাই ছিল সমাজতান্ত্রিক রীতিনীতি।

পশ্চিম বার্লিনে ওটাই ছিল আমার শেষ আসা। কোথায় যেন একটা লুকানো কষ্ট বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল কেবল জার্মানি নয়, বরং ইউরোপকে বিদায় জানানোর সময় হয়েছে। মস্কো অথবা সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে ট্রেনে করে লন্ডন যাত্রার পথে পোল্যান্ড, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি, বেলজিয়াম অথবা নেদারল্যান্ডের পথেঘাটে অনেক স্মৃতি, অনেক না-বলা কথা যা হয়ত জীবনের অন্তিম বেলায় হাতড়াতে গেলে কষ্ট লাগবে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসবে।

১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে প্রথম আসা পশ্চিম বার্লিনে। বার্লিন দেয়ালের ঝামেলা আর পূর্ব জার্মান ইমিগ্রেশনের লৌহবলয় পার হয়ে এ শহরে পা রাখতেই মনেহল জীবন এখানে অন্যরকম। পূর্ব ইউরোপের তুলনায় বাতাস এখানে অনেক হাল্কা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়না। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার মত পদে পদে এখানে কেউ কাউকে নজরদারি করেনা। দুই পরাশক্তির ফোরফ্রণ্ট এ শহরে প্রথমবারের অভিজ্ঞতাটাও ছিল মনে রাখার মত।

মস্কো হতে পূর্ব জার্মান ও নেদারল্যান্ডের ভিসা নেয়ায় যে যাত্রায় পূর্ব বার্লিনে তেমন কিছু করার ছিলনা। সকাল সকাল বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করে বসে আছি Zoologischer Garten রেল ষ্টেশনে। নেদারল্যান্ডের হোক ভ্যান হল্যান্ড-গামী ট্রেন দুপুরের দিকে। নষ্ট করার মত হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। সাথে বন্ধু রহমান। ও ইতিমধ্যে ঘুরে গেছে এ পথে, তাই অনেক কিছু ছিল তার পরিচিত। কিছু দোকানপাট ইতিমধ্যে খুলে গেছে। শূন্য রাস্তাঘাটেও বাড়ছে গাড়ির ভিড়। ষ্টেশনের পাশেই একটা কফি শপ। ওখান হতে গরম এক কাপ কফি কিনে হাঁটতে শুরু করলাম উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে।

পাশাপাশি বেশকটা ইলেকট্রনিক্সের দোকান। এসব দোকানের মূল ক্রেতা আমার মত পূর্ব ইউরোপ হতে আসা পরিব্রাজকের দল। খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নে পশ্চিমা ইলেকট্রনিক্সের ব্যাপক চাহিদা। বিশেষকরে উন্নত মানের মিউজিক সেন্টার গুলো। দোকানদার আমাদের চেহারা দেখেই বুঝতে পারল আমরা সোভিয়েত দেশের মানুষ। উষ্ণ অভ্যর্থনায় স্বাগত জানালো হরেক রকম পণ্যে সাজানো স্টোরগুলোতে। অলস সময় কাটানোর মোক্ষম জায়গা। এলপি রেকর্ডের বিশাল ভাণ্ডারে চাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানো যায় বাজারে আসা নতুন নতুন গান শুনে।

হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন ফিস ফিস শব্দে বাংলা বলছে। এদিক ওদিক তাকাতে চোখে পরল স্টক-রুমের স্লাইডিং ডোর খুলে কেউ একজন আমাকে ডাকছে। এবং তা বাংলায়। উৎসুক হয়ে ওদিকে পা বাড়ালাম।

বাংলাদেশি সোহেল আহমেদের সাথে পরিচয়টা ওখানেই। গলার স্বর অনেকটা নীচে নামিয়ে ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল পুলিশের ক্যাডাবরা কুকুর আমাকে তাড়া করেছিল কিনা। একটু অবাক হলাম। কারণ আমার জানা ছিল পশ্চিম ইউরোপের পথেঘাটে পুলিশ তাদের ক্যাডাবরা কুকুর টুরিস্টদের লাগেজের পেছনে লেলিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য, ড্রাগের সন্ধান!

আমি টুরিস্ট এবং ২৪ ঘণ্টার ট্রানজিট ভিসায় এখানে এসেছি শুনে অবাক হল সদ্য পরিচিত বাংলাদেশি সোহেল আহমেদ। উনার কাছেই পেলাম দলে দলে বাংলাদেশিদের এখানে আসার অনেক অজানা তথ্য। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশিদের জন্য দুই জার্মানির একটাতেও ভিসার প্রয়োজন হয়না। সুযোগ নিয়ে সোভিয়েত ক্যারিয়ার এরোফ্লট গাদা গাদা বাংলাদেশিদের নিয়ে আসছে পূর্ব জার্মানিতে। ওখান হতে বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করে সবাই ভিড় জমাচ্ছে পশ্চিম বার্লিনে। যাদের একটু ইংরেজি জানা আছে তারা ছড়িয়ে পরছে পশ্চিম জার্মানির বিভিন্ন শহরে।

আমি এখানে থাকতে আসিনি শুনে আকাশ হতে পরলেন সোহেল সাহেব। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম ওনার বাড়ি ঢাকার রূপগঞ্জে। এবং ঐ এলাকার বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব গোলবক্স ভূঁইয়া সম্পর্কে উনার চাচা। গোলবক্স ভূঁইয়া ছিলেন আমার আব্বার বন্ধু। সব খুলে বলতে সোহেল সাহেব খুব আপন করে নিলেন আমাকে। সময় থাকলে তার বাসায় ঘুরে আসারও দাওয়াত দিলেন। এক রুমের বাসায় আরও দশজন বাংলাদেশির বাস। খুঁজলে পরিচিত আরও অনেককে পাওয়া যাবে বলে আশ্বাস দিলেন।
ইলেকট্রনিক্স ষ্টোরের স্টক-রুম লুকিয়ে লোড-আনলোডের কাজ করেন তিনি। সময় অসময় পুলিশ এসে হানা দেয় অবৈধ অভিবাসীদের খোঁজে, তাই সবসময় নিজকে লুকিয়ে রাখেন স্টক-রুমে।

দেশে গেলে পরিবারের সাথে দেখা করার আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে এলাম দোকান হতে। কোথায় যেন একটা কষ্ট দাঁনাবাধতে শুরু করে প্রবাসে এসব বাংলাদেশিদের কথা শুনলে।

বেলা গড়াচ্ছিল তাই পশ্চিম বার্লিনে যা কিছু করার তা শেষকরার তাগাদা অনুভব করলাম। দুপুর ২টার দিকে প্রথম ট্রেন। ওটা ধরতে পারলে হোক ভ্যান হল্যান্ড হতে রাতের ফেরী ধরা যাবে। এবং ইংল্যান্ডের হারউইচ পোর্টে পৌঁছানো যাবে খুব সকালে।

বন্ধু আসাদকে ফোন করলাম। কথা ছিল নেমেই ফোন করে জানাব আমার অবস্থান। এবং দুজনের সময় মিলে গেলে দেখা করবো কোথাও। আসাদ চৌধুরী আমার সোভিয়েত জীবনের বন্ধু। একই ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছি। একবছর আগে কোর্স শেষ করে ও চলে এসেছে জার্মানিতে। পশ্চিম বার্লিনের স্থানীয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু একটা পড়ছে। ফোনের অপর প্রান্তে ওর গলা শুনে মনেহল আমি ওর ঘুম ভাঙ্গিয়েছি। আমি জানি ও রাতে কাজ করে। এবং বাসায় ফিরে অনেক রাত করে। ক্ষমা চাইলাম অসময়ে ঘুম ভাঙ্গানোর জন্যে। এ যাত্রায় দেখা না হলেও ফেরার পথে একরাত তার অতিথি হওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে ফোন রেখে দিলাম।
দুপুরের খাবার স্থানীয় এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রওয়ানা দিলাম ওদিকে। সকাল ১১টায় খুলে দুপুর ৩টায় বন্ধ করে শহরের একমাত্র ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্ট হলেও কোন জৌলুষ নেই ওখানে। নেই প্রয়োজনীয় গ্রাহক সার্ভিস। নড়বড়ে ২/৩টা টেবিল সাথে বাঁশের তৈরি টুল। হাতে সময় থাকলে প্রতিবার এখানেই দুপুরের খাবার সেরে নেই।

প্রতিবারের মত এবারও গ্রাহকদের কমতি দেখলাম না। জায়গা না পেয়ে অনেকে দাঁড়িয়েও খাচ্ছে। টেবিলের অপেক্ষায় থাকলে ট্রেন মিস করার সম্ভাবনা আছে, তাই লাইন ধরে অন্যদের সাথে দাঁড়িয়ে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে ভারতীয় মালিক তা করতে দিলেন না। খাবার হাতে নিতে রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। ওখানে বসার জায়গা ছিল। রেস্টুরেন্টের স্টাফদের সাথে অনেকদিনের পরিচয়। এখানটায় আসলে বেশ-ভাল খাতির করে সবাই। খুটিয়ে খুটিয়ে জানতে চায় এ শহরে আগমনের হেতু। এ যাত্রায়ও ব্যতিক্রম হলনা।

রেল স্টেশন ততক্ষণে গিজগিজ করছে যাত্রীদের ভিড়ে। লোকাল ট্রেনগুলো হতে দলে দলে যাত্রীরা নামছে এবং আন্তঃ ইউরোপীয় ট্রেনের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক প্ল্যাটফর্ম হতে অন্য প্লাটফর্মে।

রেল স্টেশন ততক্ষণে গিজগিজ করছে যাত্রীদের ভিড়ে। লোকাল ট্রেনগুলো হতে দলে দলে যাত্রীরা নামছে এবং আন্তঃ ইউরোপীয় ট্রেনের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক প্ল্যাটফর্ম হতে অন্য প্লাটফর্মে। আমার ট্রেনের সময়সূচী ভাল করে যাচাই বাছাই করে প্লাটফর্ম চেঞ্জ করলাম। পশ্চিম জার্মান শহর হ্যানোভার ও নেদারল্যান্ডের রটোরড্রাম হয়ে হোক ভ্যান হল্যান্ড পোর্ট পর্যন্ত পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।

পূর্ব ইউরোপ হতে আসলে পশ্চিম ইউরোপের এ ট্রেন-জার্নি উপভোগ না করে উপায় নেই। মাইলের পর মাইল গ্রাম গঞ্জ শহর বন্দরের বুক চিড়ে ছুটে চলে দ্রুত গতির এ ট্রেন। হরেক রকম মানুষ, বিচিত্র সব ভাষা, সাথে বিভিন্ন দেশের সীমান্ত অতিক্রমের বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা, সব মিলিয়ে বিশাল ক্যানভাসের এ জার্নি সহজে ভুলার নয়।
টিকেটের সাথে বগির নাম্বার মিলিয়ে উঠে পরলাম ট্রেনটায়।

পূর্ব ইউরোপ হতে আসা ট্রেনগুলোর মত এসব ট্রেনে ঘুমের ব্যবস্থা নেই। বসার জন্যে আরামদায়ক চেয়ারই একমাত্র সম্বল। প্রায় সাত ঘণ্টার জার্নি। লম্বা সময় বসে থাকলে ক্লান্তি এসে ভর করে। সেলুলয়েডের ফিতার মত বাইরের দৃশ্য দেখতে গেলে তন্দ্রা এসে যায়। তখন অজান্তেই সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে ছেড়ে আসা ট্রেনগুলোকে মিস করি। ওখানে আর কিছু না থাক অন্তত রাতে ঘুমের ভাল ব্যবস্থা থাকে। পরিষ্কার ধবধবে বিছানা, গরম কম্বল, সাথে অন দ্যা হাউস গরম চা, সবকিছু মিলে অন্তত শারীরিক ক্লান্তিটাকে ঠেকিয়ে রাখে।

পশ্চিম বার্লিন হতে ছেড়ে আসা কোন ট্রেনই এক রুটে এক শহরের জন্যে নির্ধারিত থাকেনা। জায়গায় জাগায় থামে এবং এক লকোমোটিভ হতে বগি আলাদা করে অন্য লকোমোটিভে লাগিয়ে দেয়। ভাল করে যাচাই বাছাই না করে বগিতে বসলে বড় ধরণের ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়।

এক গ্রীষ্মে বেলজিয়াম হয়ে লন্ডন যাচ্ছি। বেশ ক'বার যাতায়াতের কারণে ধরে নিয়েছিলাম এ রাস্তার সবকিছু আমার জানা। কোথাও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সে যাত্রায় ভুল হয়েছিল। এবং তা ছিল বড় ধরণের ভুল। ট্রেনের সাইনে বেলজিয়ামের পোর্ট অব আন্টওয়ার্পের সাইন দেখে ধরেই নিয়েছিলাম গোটা ট্রেনটাই ওদিকে যাচ্ছে। খালি মত বগি দেখে ওখানেই আরাম করে বসে পরি। ভুলটা ধরতে বেশকিছু সময় লেগে যায়।

আমার গন্তব্য ব্রিটেনের ডোভার। আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার ট্রেন ওদিকেই যাচ্ছে। কিন্তু বেলজিয়াম অতিক্রম করে নতুন এক সীমান্তে আসতেই টনক নড়ল। ট্রেন সীমান্তে দিয়ে ফ্রান্সে ঢুকার অপেক্ষা করছে। হুরমুর করে ইমিগ্রেশন পুলিশ উঠে পরল ট্রেনে। ওদের মুখে ফ্রেঞ্চ ভাষা শুনে পৃথিবী টলে উঠল। এ সীমান্ত হতে টিকেট কেটে ব্রাসেলস ফিরে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট অর্থ নেই পকেটে। সিদ্ধান্ত নেয়ার মত হাতে যথেষ্ট সময়ও ছিলনা। এসব সীমান্তে ট্রেন পনের বিশ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করেনা।
ফ্রেঞ্চ পুলিশ এসে আমার পাসপোর্ট চাইতে সব খুলে বললাম। আমার পাসপোর্টে ফ্রান্সের ভিসা নেই। চাইলেও সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবোনা। আবার ব্রাসেলস ফিরে যাওয়ার মত অর্থও নেই পকেটে। পুলিশ তড়িৎ গতিতে ট্রেন হতে নামিয়ে তাকে অনুসরণ করতে বলল। সীমান্ত চৌকিতে গিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে কেনা লন্ডন-গামী ট্রেনের টিকেটটা চেক করলো। পাশের প্লাটফর্মেই দাঁড়ানো ছিল ব্রাসেলস-গামী রিটার্ন ট্রেনটা। ঐ ট্রেনের গার্ডের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে সংক্ষেপে জানিয়ে দিল আমার অবস্থা। গার্ড জানাল সোভিয়েত টিকেটই আমাকে সাহায্য করবে ব্রাসেলস ফিরে যেতে। ওখান হতে নতুন একটা ট্রেন ধরতে হবে। টিকেটের সাথে সাদা কাগজে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কিছু একটা লিখে ষ্টেপলার মেরে আটকে দিল। ঝামেলা ওখানেই চুকে গিয়েছিল।

এরপর যতবার এ পথে জার্নি করেছি আগ বাড়িয়ে নিশ্চিত করেছি ট্রেনের কোন বগি কোন দেশের কোন বন্দরের দিকে যাচ্ছে। এ যাত্রায়ও কোন ভুল করিনি।
বার্লিন হতে নেদারল্যান্ডস’এর Hook Van Holland’ পোর্টের ড্রাইভিং দূরত্ব প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার। গাড়ি চালিয়ে গেলে ৮ ঘণ্টার পথ। কিন্তু ট্রেন চলে তার নিজ পথে, নিজস্ব গতিতে। দূরত্ব যাই হোক, সময় লেগে যায় অনেক। চলার পথে পশ্চিম জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস’এর অনেক স্টেশনে থামে। ব্যস্ত কোন শহরে ট্রেনের বগি কেটে তা ভিন্ন রুটের লকোমটিভে লাগাতেও সময় লেগে যায়।

এ যাত্রায় আমার পথ পশ্চিম জার্মানির Barnswick, Hanovar ও নেদারল্যান্ডস’এর Rotterdam হয়ে দেশটার বন্দর শহর Hook Van Holland। ওখান হতে ওভারনাইট ফেরীতে করে পাড়ি দিতে হবে নর্থ সী। সবকিছু ঠিক থাকলে পরদিন খুব ভোরে পৌঁছে যাব বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জের বন্দর Harwichএ।

ঝামেলা পিছনে ফেলে Hook Van Holland গামী ট্রেনটায় চেপে বসতে মাথা হতে পাহাড় সমান কিছু একটা নেমে গেল যেন। নিঃস্বাসে অক্সিজেনের মাত্রাও যে বেড়ে গেছে তা টের পেতে অসুবিধা হলোনা।

লন্ডন পর্যন্ত জার্নিতে আমার আর কোন বাধা নেইঁ। উপলদ্বিটা স্বস্তির আবেশ ছড়িয়ে দিল গোটা শরীরে। যদিও হারউইচ পোর্টে চাইলে বিনা কারণে বৃটিশরা আমাকে আটকে দিতে পারে। তবে গেল ১১ বছরে তারা এমনটা করেনি। এ যাত্রায় তেমন কিছু করার কারণ ছিলনা।

সব দেশের মত বৃটিশ ইমিগ্রেশনেরও লক্ষ্য থাকে ট্যুরিষ্ট ভিসায় কেউ বৃটেনে ঢুকে ফিউজেটিভ হয়ে যায় কিনা। আমার পাসপোর্ট স্বাক্ষী দেবে এ ব্যপারে আমার স্বচ্ছতা। পশ্চিম জার্মানী ও বেনেলাক্সের ২৪ ঘণ্টার ট্রানজিট ভিসা পৃথিবীর এ অঞ্চলে স্বাধীনভাবে চলাফেরার নিশ্চয়তাও ছিল স্বস্তিদায়ক। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশি পাসপোর্ট অনেক দেশে এন্ট্রি ভিসা পাওয়া যেত। কিন্তু অবৈধ অভিবাসীদের বিরামহীন ইনফ্লাক্স ততদিনে বদলে দিয়েছে অনেক সমীকরণ।

পূর্ব জার্মানীর ভিসা অনেকদিন পর্যন্ত ছিল সহজলভ্য (অন এরাইভেল)। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে স্বদেশিদের অনেকে পূর্ব বার্লিন হয়ে পাড়ি জমিয়েছিল পশ্চিম জার্মানীর অনেক শহরে। বাংলাদেশি পাসপোর্ট বেশ কবছর ধরেই কালো তালিকাভুক্তির প্রথম দিকে স্থান করে নিয়েছিল ইউরোপের অনেক দেশে। এ নিয়ে অনেক দেশের মিডিয়া ডকুমেন্টারি তৈরী করে তুলে দিয়েছিল পশ্চিমাদের শয়নকক্ষে। স্বভাবতই জন্ম নিয়েছিল ভয় ও এক ধরণের ঘৃণা।

বগিটায় ৩/৪ জন যাত্রী ছাড়া বাকি সব আসন ছিল শূণ্য। তবে অবস্থা যে এমনটা থাকবেনা তা পরবর্তী ষ্টেশনে থামলেই নিশ্চিত হয়ে যাবে। গ্রীষ্মের এ সময়টা গোটা পশ্চিম ইউরোপ হুমড়ি খেয়ে পরে একটুখানি স্বস্তির সন্ধানে। স্কুল কলেজ ছুটি থাকার সুবাদে মা-বাবাও বেরিয়ে পরে তাদের বার্ষিক ছুটিতে। চারদিকে থাকে উৎসবের আমেজ। এ আমেজের ছোঁয়া পাওয়া যায় তাদের কথায়, কাজে, চলাফেরায় এমনকি পোশাকে পর্যন্ত।

খুবই আরামদায়ক একটা চেয়ারে বসে নিজকে গুছিয়ে নিলাম লম্বা জার্নির জন্যে। জানালার পাশের সীটে না বসলে সময় সহজে কাটতে চায়না। মন্থর হয়ে যায় ট্রেনের গতির সাথে জীবনের গতি। একটা সময় ভয় এসে মগজে বাসা বাধে; মনেহয় এ পথ জীবনেও ফুরাবেনা।

মাইলের পর মাইল পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের ট্রেন। এদিক সেদিক অনেক জায়গায় থামছে। দলবেধে যাত্রীরা উঠছে। অনেকে নেমে যাচ্ছে। কেবল জার্মান ভাষাই নয়, পৃথিবীর হরেক রকম ভাষায় মুখরিত হয়ে উঠছে ট্রেনের বগি। সবাই কোথাও না কোথাও যাচ্ছে। আন্দাজ করতে অসুবিধা হয়না ওরা শীতের খোলাস হতে বেরিয়ে আলোর সন্ধানে ছুটছে। প্রকৃতিও যেন দুবাহু বাড়িয়ে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সবুজের সমারোহ চারদিকে। পাতায় পাতায় পল্লবিত গাছপালা। সূর্যের আলো আছড়ে পরছে পরতে পরতে।

ট্রেনের গতির সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ি ঘর, গাছপালা, মানুষ, পশু পাখি মিলিয়ে যাচ্ছে সেলুলয়েডের ফিতায়। ট্রনের জানালা এ মুহূর্তে বিরাট ক্যানভাসের কোন ছায়াছবির প্রেক্ষাপটকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

পশ্চিম বার্লিন পার হয়ে ট্রেন আবারও প্রবেশ করল পূর্ব জার্মানীতে। আবারও ছায়া কায়াহীন মূর্তির মত হাজির হল পূর্ব জার্মান পুলিশ। ওরা কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ঠাঁয় হয়ে তাকিয়ে থাকে চোখের দিকে। কিছু একটার সন্ধান করে নিজেদের প্রফেশনাল চোখ দিয়ে। চাহনির রশ্মি এতটাই প্রখর কারও ভেতর ইমিগ্রেশন অথবা কাস্টম জাতীয় দুর্বলতা থাকলে তা বেরিয়ে আসতে বাধ্য। সবকিছু ঘটে কয়েক সেকেন্ডের ভেতর। তারপর খটাস করে পাসপোর্টে এন্ট্রি অথবা এক্সিট ভিসার সীল বসিয়ে মিলিয়ে যায় সূক্ষ্ম বাতাসে।

পশ্চিম বার্লিনের একটা ইতিহাস আছে। বিভক্ত জার্মানির পতনের আগে রাজনৈতিক এনক্লেভ হিসাবে বিবেচিত জায়গাটার আইডেনটিটি দেশ অথবা শহর হিসাবে ছিলানা। ছিল হিটলারের তান্ডবে বিধ্বস্ত ইউরোপের শেষ ফ্রণ্টিয়ার। ১৯৪৫ সালের ৯ই মে মিত্র বাহিনীর কাছে হিটলারের পরাজয় অফিসিয়ালি লিপিবদ্ধ করা হয়। একই সালের ১৭ই জুলাই মিত্রপক্ষের চার শক্তি পরাজিত জার্মানির Postdam শহরে মিলিত হয় যুদ্ধ পরিবর্তী জার্মানির ভাগ্য নির্ধারনে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনষ্টন চার্চিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রোম্যন ও সোভিয়েত লৌহমানব জোসেফ স্টালিন Postdam বসেই সিদ্বান্ত নেন স্বাধীন সার্বভৌম জার্মানীর অভ্যুদয় না ঘটা পর্যন্ত চারভাগে বিভক্ত করে চার শক্তি নিয়ন্ত্রণ করবে এই দেশ।

উত্তর-পশ্চিম দিকের নিয়ন্ত্রণ নেয় বৃটিশরা। ফ্রান্সের ভাগে আসে দক্ষিণ পশ্চিম জার্মানী। মার্কিনিদের নিয়ন্ত্রণে আসে দেশটার দক্ষিণের অংশ। আর পূব দিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে জোসেফ স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন। বার্লিন শহরকে চারভাগে বিভক্ত করে একই অনুপাতে তুলে দেয়া হয় চার শক্তির হাতে। সোভিয়েতদের বশ্যতা মেনে নিয়ে জার্মানির পূর্বাংশে জন্ম নেয় পূর্ব জার্মানী। বাকি অংশ পরিচিত পায় পশ্চিম জার্মানি হিসাবে। পূর্ব জার্মানীর মাঝখানে বার্লিন শহর অনেকটা দ্বীপের মত অবস্থানে চলে যায়। শহরের পূর্বাংশের নামকরন করা হয় পূর্ব বার্লিন এবং পশ্চিমাংশ পশ্চিম বার্লিন। গণতান্ত্রিক বিশ্বে পশ্চিম বার্লিন পরিচিতি পায় আইল্যান্ড অব ফ্রীডম হিসাবে। ১৯৬১ সালে বার্লিনকে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করার লক্ষে পূর্ব জার্মানরা তৈরী করে ঐতিহাসিক বার্লিন দেয়াল।

এখানে বলে রাখা ভাল, অফিসিয়ালি পশ্চিম বার্লিন ফেডেরাল রিপাব্লিক অব জার্মানির (FRG) অংশ নাহলেও এর সমস্ত দায়-দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল এই দেশ। বাকি তিন শক্তি বোঝাপড়ার মাধ্যমে হস্তান্তর করেছিল নিজদের দায়িত্ব।

চলন্ত ট্রেনে বসে বাইরের দিকে তাকালে মনে হবে ট্রেন নয়, যেন বাইরের পৃথিবীটাই ছুটছে। বাড়িঘর, মাঠ ঘাট, গাছপালা সবকিছু ক্ষণিকের জন্যে উঁকি দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তরেখায়। পড়ন্ত বিকেলের দৃশ্যপট হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে বিশাল ক্যানভাসে আঁকা শিল্পীর নিপুণ কোন শিল্পকর্ম।

সূর্যের রক্তিম আভা আছড়ে পরছে ফসলের মাঠে। কৃষকরা ঘরে ফিরছে তাদের ট্রাক্টর নিয়ে। কাউবয়রা শেষবারের মত সেরে নিচ্ছে ক্যাটেল হেড কাউন্ট। প্রায় প্রতিটা বাড়ির সামনে থেমে আছে একাধিক গাড়ি। নিভু নিভু আলোতেও মাঠে ফুটবল খেলছে অনেকে। শিশু কিশোরের দল বাইক নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরছে। হয়ত ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির দল ফিরে যাচ্ছে তাদের কুলায়।

এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পরেছি টের পাইনি। হকার টাইপের কেউ একজনের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। শুকনা জাতীয় কিছু খাবার ও কোল্ড ড্রিংকস বিক্রির চেষ্টা করছে। আমার মত যারা বার্লিন হতে উঠে হ্যানোভার অথবা নেদারল্যান্ডস’এর রোটরড্রামে যাচ্ছে তাদের কেউ কেউ সাড়া দিচ্ছে হকারের ডাকে। লম্বা জার্নি। খাবার না কিনলেই নয়।

পূর্ব ইউরোপিয়ানদের সাথে পশ্চিম ইউরোপিয়ানদের এই পার্থক্যটা খুব প্রকট হয়ে ধরা পরে। বিশেষকরে ট্রেন অথবা বাসের লম্বা জার্নিতে। মহাদেশের পূবের দিকের মানুষ যেখানেই যাক ভ্রমণের সময় তারা ঘরে তৈরি নিজেদের খাবার বহন করবেই।
সোভিয়েত, পোলিশ অথবা চেকদের ভ্রমণ ব্যাগের অপরিহার্য অংশ শুকনো খাবার। রুটি, সালামি, শুকরের বেকন সাথে মাখন এবং সবশেষে পানীয় হিসাবে মগ ভর্তি গরম চা।

মা তার সন্তানকে অথবা স্ত্রী তার স্বামীকে যখন বিদায় দেয় সাথে দেয় জার্নির পুরোটা সময় চালিয়ে নেয়ার মত যথেষ্ট খাবার। ওরা নিজেদের খাবার সদ্য পরিচিত সহযাত্রীদের বিনা দ্বিধায় অফার করতে অভ্যস্ত।

পশ্চিম ইউরোপিয়ানরা তাদের পূব দিকের সগোত্রীয়দের এসব সংস্কৃতির ধারে কাছেও যায়না। ঘরে রান্নাকরা খাবার কেউ ট্রেনে খেয়েছে এমন দৃশ্য বিরল। বরং এক প্যাকেট চিপস খেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টায় কাটিয়ে দেয় এমন যাত্রীর সংখ্যাই বেশি। মাঝপথে কোথাও থামলে ষ্টেশন হতে একটা স্যান্ডউইচ ও এক বোতল পানিই তাদের শেষ সম্বল। এর অতিরিক্ত কিছু কিনলে যাত্রীর পশ্চিম ইউরোপীয় আইডেন্টিটি নিয়ে প্রশ্ন তুললে অন্যায় হবেনা।

হ্যানোভার। পশ্চিম জার্মানির বেশ বড় একটা শহর। রেল নেটওয়ার্কের বড়সড় একটা হাব। ১৫/২০ মিনিটের যাত্রা বিরতি এ শহরে। একই ট্রেন ধরে বিভিন্ন রুটে বিভিন্ন শহরে যাওয়ার শুরুটা হয় এখানেই। এ যেন বিমানের কানেক্টিং ফ্লাইটের মত। ইউরোপের বিভিন্ন কোনা হতে দলে দলে ট্রেন আসে। এক ট্রেনের বগি অন্য ট্রেনে লাগিয়ে চলে যায় নিজ নিজ গন্তব্যে।

পৃথিবীর আর দশটা ট্রেন ষ্টেশনের মতই হ্যানোভারের ব্যস্ততা। মিনিটে মিনিটে ট্রেন আসছে এবং পাশাপাশি ছেড়ে যাচ্ছে। যাত্রীদের ভিড়ে গিজ গিজ করছে প্লাটফর্ম। নিজদের ট্রেনের সন্ধানে যাত্রীরা এক প্লাটফর্ম হতে অন্য প্লাটফর্মে দৌড়চ্ছে। দম দেয়া পুতুলের মত ঝট করে উঠে পরছে ট্রেনে এবং তাৎক্ষণিক ভাবে মিশে যাচ্ছে যাত্রীদের মিছিলে। বিমানবন্দরের মতই ভারী গলায় দফায় দফায় ঘোষণা আসছে ট্রেনের এরাইভেল ও ডিপার্টচারের বিবরণ।

গ্রীষ্মকাল বলেই হয়ত ভিড়টা একটু বেশি। আমার মত লন্ডনের দিকে কারা যাচ্ছে তা হোক ভ্যান হল্যান্ড পর্যন্ত না গেলে বুঝার উপায় নেই। তবে আমার সহযাত্রী একদল স্প্যানিশ কিশোরীদের ভাবা-সাব দেখে মনে হল ওরা ওদিকে যাচ্ছে। গ্রীষ্মের ছুটিতে স্পেন হতে অনেকে কলেজ ইউনির ছাত্র ছাত্রী ব্রিটেনের দিকে যায় সামার যবের জন্যে। লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডের অনেক বার রেস্তোরায় ওদের কাজ করতে দেখেছি। দু'য়েক জনের সাথে পরিচয় হয়নি তাও নয়।

আসলে সবকিছুতেই কেমন যেন একটা ছুটির আমেজ। কি মানুষ কি প্রকৃতি কোন কিছু বাদ নেই। সাথে কোথায় যেন একটা প্রচ্ছন্ন সুখের ইঙ্গিত। দেশ, জাতি, ভাষা অথবা সংস্কৃতি কোন কিছুই বাধা হয়ে নেই সুখের এ মেঠো পথে। আপাদমস্তক শরীর ঢেকে আরব মহিলার পাশাপাশি শরীর উন্মুক্ত করার তীব্র প্রতিযোগিতায় মত্ত ললনারাও চলছে সুখের সন্ধানে। এক ষ্টেশনে উঠে পরের ষ্টেশনেই নেমে পরছে অনেকে। অনেকে আবার সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে দূর দূরান্তে।
পূর্ব বার্লিন হতে হতে কেনা কিছু শুকনো খাবার ছিল সাথে। সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে আনা ছোট ফ্লাক্সটাও ভর্তি করে নিয়েছিলাম কালো কফিতে। পেট চো চো করছিল ক্ষুধায়। হ্যানোভারের বিরতিতে গোগ্রাসে গিলে মগটা হাতে নিয়ে সামনে সীটে পা উঠিয়ে বেশ আয়েশ করেই প্রস্তুতি নিলাম জার্নির পরের অংশের।
মহাশয়, এই ট্রেনটা কি হোক ভ্যন হল্যান্ডের দিকে যাচ্ছে?’

জিনসের সংক্ষিপ্ত শর্টস পরা দুজন তরুণী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল আমার দিকে।
আমি নিশ্চয়তা দিলাম ওদিকেই যাচ্ছি আমরা।

ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে হ্যানোভারের আকাশ। শহরের বাতিগুলো জানান দিচ্ছে রাত নামছে পৃথিবীর এ প্রান্তে। গ্রীষ্মের রাত এদিকটায় এমনিতেই ছোট। নৈশ জীবনের সবটুকু নিংড়ে নিতে ভিড় জমছে শুঁড়িখানায়, ডিস্কো সহ বিনোদনের সবকটা ভেনুতে। ট্রেনের জানালায় বসে এসব দৃশ্যও চোখ এড়ায় না।

প্ল্যাটফর্মের মাইক্রোফোনে Hook Van Holland গামী ট্রেনের ডিপার্টাচার ঘোষণা আসতে ভাল করে দেখে নিলাম সহযাত্রীদের। অনেকটা সময় কাটাতে হবে ওদের সাথে। অস্বাভাবিক আচরণের কেউ থাকলে গোটা জার্নিটা হতে পারে নরক যাত্রার অভিজ্ঞতা।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যাত্রীদের চেহারায় তেমন কারও ছায়া পাওয়া গেলনা। সবাই মালামাল গুছিয়ে তৈরি হচ্ছে নিজেদের গন্তব্যের জন্যে।
সহযাত্রীদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সংক্ষিপ্ত দূরত্বের যাত্রীরা দিনের আলোতেই নিজেদের ভ্রমণ সেরে নেয়। কেবল আমার মত যারা শহরের পর শহর, দেশের পর দেশ পাড়ি দিয়ে অন্য এক দেশে পাড়ি জমায় তারাই চেপে বসে রাতের ট্রেনে।

দুটো সীট পরেই মাত্র পরিচয় হওয়া দুই তরুণীকে দেখলাম নিজেদের ব্যাক-প্যাক হতে বালিশ বের করে তৈরি হচ্ছে লম্বা জার্নির। সময় গড়ানোর সাথে দুই জনের পরিচয় আবিষ্কার করতে অসুবিধা হলোনা। ওরা সমকামী। একজনের চুল পুরুষদের মত ছোট করে কাটা। শরীর যতটুকু দেখা যায় তার সবটা ঢেকে আছে উল্কিতে। বাকি-জনও পিছিয়ে নেই। পোশাকের ব্যপারে দুজনের কারোই কোন রাখঢাক নেই। হিসাব করলে দেখা যাবে শরীরের ৭০ ভাগেই কোন পোশাক নেই। নিজেদের যৌন আচরণ বাইরে আনার জন্যে এতক্ষণ মুখিয়ে ছিল। ট্রেন ছাড়তেই একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল নিজেদের ভালবাসা সামনে আনতে।

চাইলেও এসব উপেক্ষা করা যায়না। বিশেষকরে আমার মত যারা পূর্ব ইউরোপের রক্ষণশীল সমাজ হতে এদিকটায় আসে। পৃথিবীর সব দেশে সবকালে সমকামীরা ছিল। শতাব্দীর শুরুতে নিজেদের পরিচয় গোপন করায় সামাজিক বাধ্য বাধকতা থাকলেও পৃথিবী এখন অনেক উন্মুক্ত। এসবের অস্তিত্ব এখন আমাদের চারদিকে।
অন্ধকারের চাদরে ঢেকে গেছে বাইরের পৃথিবী। সাথে হাল্কা কুয়াশা। চলমান বাতিগুলো ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়েনা ভেতর হতে। সাথে দু’তিনটা বই এনেছিলাম রাস্তায় পড়ব বলে। দস্তায়েভস্কির ‘преступление и наказание (ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট)’ বইটা আগেও পড়েছি। রুশ ভাষায় প্রথমবার পড়ার পর সেই যে প্রেমে পড়েছি আজও তা শেষ হয়নি। সময় কাটানোর হাতিয়ার হিসাবে বইটাকে মাঝে মধ্যে ব্যবহার করি।

পড়ার মত যথেষ্ট আলো ছিলনা ট্রেনে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠিয়ে রাখতে বাধ্য হলাম। খিদা লাগতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। ব্যাগে খাবার যা অবশিষ্ট ছিল তা খেয়ে আবারও বাইরের দিকে চোখ ফেরালাম। হঠাৎ মনে হল ট্রেনের গতি দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সামনে থামার মত ষ্টেশন না থাকলে গতি বেড়ে যায়, ব্যপারটা আগেও লক্ষ্য করেছি। সামনের সীটে কেউ না থাকায় পা উঠিয়ে আরাম করে বসে বসার সিদ্ধান্ত নিলাম। হঠাৎ মনে হল ঘুম আসছে আমার।
…… শতাধিক যাত্রীর অনেকে ঘুমাচ্ছে। নাক ডাকছে অনেকে। সহযাত্রীদের ঘুমের তোয়াক্কা না করে অনেকে কথা বলছে উঁচু স্বরে। দল বেঁধে কেউ কেউ তাস খেলছে। অনেকে নাকে নস্যি নিচ্ছে একটু পরপর। ফেরিওয়ালারা পণ্যের পসার সাজিয়ে দলে দলে হাঁক দিচ্ছে।

…… সাপের মত একে-বেঁকে এগিয়ে চলছে ট্রেন। থর থর করে কাঁপছে সবকিছু। ঘুমাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু ঘুম আসছে না। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি আগে কখনও মোকাবেলা করেছি মনে করতে পারলাম না। হাতের ব্যাগটা সীটের ডাণ্ডার সাথে তালা চেইন দিয়ে আটকেও নিশ্চিত হতে পারছিনা নিরাপত্তার। হাওড়া ষ্টেশনে এক ফেরিওয়ালা বাধ্য করেছিল এসব কিনতে। এ পথে জার্নি করতে গেলে এসব নাকি বাধ্যতামূলক। কোলকাতা হতে ওড়িশার পূরী যাচ্ছি। লম্বা অন্তহীন পথ। বরাবরের মত আমি একা। কথা বলার কেউ নেই। …শোয়ার ভান করে উপরের দিকে তাকিয়ে ট্রেনের ঝং ধরা ছাদ দেখছি কেবল। দেখছি আর প্রহর গুনছি কবে শেষ হবে এ নরক যাত্রা।
ব্রেকের কড় কড়া আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। স্বপ্ন দেখছিলাম আমি।

বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভেতরে যাত্রীদের প্রায় সবাই ঘুমাচ্ছে। বগির মূল বাতিটা নিভিয়ে দিয়েছে কেউ। কিছুটা চাঞ্চল্য লক্ষ করা গেল যাত্রীদের মাঝে। বাইরে ইমিগ্রেশন পুলিশদের আনাগোনা জানান দিল সীমান্ত অতিক্রম করতে যাচ্ছি আমরা। এ যাত্রায় পশ্চিম জার্মানি হতে নেদারল্যান্ড। পকেটে হাত দিয়ে আবারও পাসপোর্টের অস্বিত্বটা পরখ করে নিলাম।

ট্রানজিট ভিসা নিয়ে ভ্রমণের এই এক সুবিধা; ঝামেলা যত তা ইমিগ্রেশন পুলিশেই সীমাবদ্ধ থাকে। কাস্টম পুলিশদের বিশেষ কোন মাথাব্যথা দেখা যায়না। কারণ তারা জানে সাথে যাই থাকুক তা নিয়ে বেশিদূর যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ট্রেন জার্নির ট্রানজিট অবশ্য আকাশ পথের চাইতে একটু ভিন্ন। এমন ভিসায় ট্রেন হতে নেমে যতদূর চোখ যায় ততদূরই যাওয়া যায়। আকাশ পথের মত বিশেষ একটা জায়গায় আটকে রাখেনা। রেলপথের ট্রানজিট টাইম সেনসিটিভ। আমার বেলায় তা ছিল ২৪ ঘণ্টা।
পশ্চিম জার্মান-নেদারল্যান্ড সীমান্ত পারাপারে কোনদিনও কোন ঝামেলা হয়নি। ইমিগ্রেশন পুলিশ পাসপোর্ট হাতে নিয়ে খুব দ্রুত ভিসার পৃষ্ঠায় একটা সিল মেরে স্বাগত জানায় দেশটায়। ট্রেনের স্টপেজ টাইমও থাকে খুব সীমিত। কারও ইমিগ্রেশনে সমস্যা দেখা দিলে ট্রেন আটকে রাখেনা। বরং কাছের কোন ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আসলে ট্রেনে পুলিশ না উঠলে বুঝারই উপায় থাকেনা আমরা এক দেশ হতে অন্য দেশে প্রবেশ করছি।

সীমান্ত ঝামেলা শেষ হতে বাকি রাস্তা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়ার প্লান মরলাম। ক্ষুধায় পেট চো চো করেছে। এ পথে হকারদের আনাগোনা নেই যে কিছু কিনব। দিনের আলোতে মাঝে মধ্যে দেখা মিললেও রাতে ওরা আসেনা। সাথে খাবার, পানি সহ যা ছিল তা আগেই শেষ। পকেটে টাকা থাকলেও খাবার যোগার করার উপায় নেই। ফেরীতে উঠার আগে পেটে কিছু পরছে না এ ব্যপারে নিশ্চিত হয়ে গেলাম।

Rotordram পার হয়ে Hook Van Holland’এ পৌঁছতে রাত ১০টা বেজে গেল। ফেরী ছাড়তে তখনও এক ঘণ্টা দেরী। ব্যস্ত এ বন্দরে যাত্রীদের ভিড় লেগেই থাকে। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার এ পথটা বাকি পথ গুলোর চাইতে একটু লম্বা। বেলজিয়াম হয়ে গেলে ৬ ঘণ্টার কম সময়ে অতিক্রম করা যায় ইংলিশ চ্যানেল। কিন্তু আমার মত অনেকেই এ পথ বেছে নেয় উন্নত ফেরী সার্ভিসের কারণে।

যাত্রী ও যাত্রীদের গাড়ি পাশাপাশি দুটো লাইনে উঠছে ফেরীতে। লম্বা লাইন, কিন্তু খুব দ্রুতই এগুচ্ছে।

আমার সামনে একজন ভারতীয়। বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। চোখে চোখ পড়তে মৃদু একটা হাসি দিয়ে ফিরিয়ে দিলাম তার চাউনি। এখন কথা বলার সময় না। ফেরীতে উঠে রাতের ঘুমের জন্যে ভাল একটা জায়গা খুঁজতে হবে। পেটে দিতে হবে কিছু। তারপর না হয় কথা বলা।
ফেরীতে ঘুমের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা আছে। তার জন্যে পে করতে হয়। আমার মত পকেটে ২০০/৩০০ ডলার নিয়ে যারা ভ্রমণ করে তাদের জন্যে এ লাক্সারি সাজে না। তাই ডেকেই খুঁজতে হয় রাতের আশ্রয়।

এ পথে প্রথম যাত্রায় বুঝতে পারিনি এতকিছু। রাতের খাবার আর ফেরীর উপর নীচ সব তলা আবিষ্কারের পর রাত বেশ গড়িয়ে যায়। ঘুমের আয়োজন করতে গিয়ে হতাশ হলাম। কোথাও এক ফোঁটা জায়গা নেই। এমনকি করিডোরেও ঘুমন্ত মানুষের মিছিল। শেষপর্যন্ত লাইভ ব্যান্ড শো আর কাসিনোর রুলেটের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁটাতে হয়েছিল বাকি রাত।

হঠাৎ মনে হল সবকিছুর আগে ভারতীয় যাত্রীর সাথে আলাপটা সেরে নিলে আমারই সুবিধা। অন্তত সাথে আনা লাগেজটা তার জিম্মায় রেখে খাবারের সন্ধানে যাওয়া যাবে। সাথে বোঝাটা টানতে ক্লান্তি লাগছিল। দুনিয়ার বাকি সব অর্থহীন মনে হল ক্ষুধার কাছে।

আকবর আলী। জন্ম ভারতে হলেও এসেছে পর্তুগাল হতে। ওখানকার কোন এক সমুদ্র সৈকতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। সেও একা। কারও সাথে পরিচয় হওয়াটা তার জন্যেও ছিল জরুরি।

উপর তলার ডেকে খালি কিছু স্পট পাওয়া গেল। বিছানা হিসাবে ব্যবহারের জন্যে আমার কাছে হাল্কা একটা কম্বল ও এয়ার বালিশ ছিল। আকবর আলীও আমার পাশে বিছানা পাতলো। সবকিছু তার জিম্মায় রেখে কেবল পাসপোর্ট ও মানিব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পরলাম খাবারের সন্ধানে।

রাত যত গভীর হয় ফেরীর জীবন ততই রহস্যময় হয়ে উঠে। হাই ভলিউমের লাইভ মিউজিক, রুলেট ও ব্ল্যাক জ্যাক টেবিলে সুন্দরীদের অর্ধ-নগ্ন দেহ, বারে বোতল আর গ্লাসের টুং টাং আওয়াজ বৈচিত্র্য এনে দেয় রাতের জার্নিতে।

পতিতাদের আনাগোনাও চোখ পরার মত। ওরা কেবিন ভাড়া নিয়ে খদ্দের টানে। ফাঁদ পাতে বার ও কাসিনোতে। স্পেন ও ইতালি হতে আসা অনেক কিশোরীও অতিরিক্ত কিছু আয়ের জন্যে শরীর বিক্রি করে। ওদের কেবিন থাকেনা। নির্জন কোন জায়গা পেয়ে ওখানেই মিলিত হয়।

এ এক বিস্ময়কর অনুভূতি। প্রথম প্রথম খুব অবাক হতাম। কিন্তু অনেকের সাথে মেশা ও আলাপের পর উপসংহারে আসতে বাধ্য হয়েছি, মেয়েদের অনেকের কাছে শরীর আসলে জাস্ট একটা অঙ্গ। হাত পা, চোখ মুখ ব্যবহারের মত শরীরে সে সব অঙ্গও ব্যবহার করে শারীরিক অথবা পকেটের চাহিদা মেটাতে। এ নিয়ে কারও কোন আক্ষেপ নেই। ওদের অনেকের ভাষ্য, শরীর থাকলে তার চাহিদাও থাকবে। সে চাহিদা মেটাতে পুরুষের মত অনেক মেয়েও সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়।

ফেরীতে কেবল পতিতারাই আয়ের জন্যে শরীর বিক্রি করেনা। অনেক মহিলাও one night stand’এর বৈচিত্র্য কাছ হতে উপভোগের জন্যে পুরুষদের বিছানায় নেয়। কাসিনো অথবা বারে বসলে এসবের আলামত অনুধাবন করতে সময় লাগেনা।

অনেক রাত পর্যন্ত সহযাত্রী আকবর আলীর সাথে আলাপ হল। ভারতের গুজরাটে জন্ম হলেও জীবনের অনেকটা সময় ইউরোপে কাটিয়েছেন। চাকরি পর্ব সেরে এখন নিজে ব্যবসা করছেন। বিয়ে করেছেন পর্তুগীজ এক মহিলাকে। ব্যবসা বাড়াতে চাইছেন, কিন্তু লোকবল পাচ্ছেন না। লন্ডন যাত্রার এটাই অন্যতম কারণ। পরিচিত অনেকে আছে ওখানে। এবং তাদের মাধ্যমে সন্ধান করবেন নতুন রেস্টুরেন্টের জন্যে সেফ, ওয়েটার সহ আরও অনেককে।

লন্ডন যাত্রার আমার হেতু জানতে চাইলেন আগ্রহ নিয়ে। খুলে বললাম আমার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। ওখানে কাজ করতে পর্তুগাল যাওয়ার কোন উইন্ডো ছিলনা। ভদ্রলোক খুব করে অনুরোধ করলেন ছুটি কাটাতেও যেন ওনার কাছে যাই। হাতে একটা বিজনেস কার্ড ধরিয়ে নিজের ঠিকানা ও ফোন নাম্বার দিলেন।
সে রাতে আর ঘুম আসেনি। জীবনের অনেক হিসাব সেলুলয়েডের ফিতার মত মগজে কড়া নাড়ছিল। পকেটে ১০ ডলার নিয়ে এ পথে প্রথম জার্নি। কোন এক জার্নিতে নর্থ সী’র উত্তাল ঢেউ, সাথে ফেরীর নিয়ন্ত্রনহীন উদ্দামতা, মানিব্যাগ হারিয়ে খুঁজে পাওয়া, গায়ানীজ ভারতীয় এক যুবতীর সাথে কিছু অন্তরঙ্গ সময়… মনেকরার মত অনেক কিছুই ছিল।

সবকিছু ছাপিয়ে কিছু কষ্ট বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল, এটাই আমার শেষ যাওয়া। আর কোনদিন আসা হবেনা। লাইভ ব্যান্ডের পর্দা ফাটানো মিউজিক, কাসিনোর রুলেট টেবিলে হঠাৎ জেতা জুয়ারির বাঁধভাঙ্গা উল্লাস, ডেকের চোরাগলিতে পতিতাদের ইশারা…অনেক কিছুই মিস করবো। মিস করবো এসব বাধাহীন সহজ জীবন।
শেষরাতের দিকে কখন ঘুমিয়ে পরেছি টের পাইনি।

বরাবরের মতই ব্রিটেনের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। প্রথম দেখায় মনে হবে নিশ্চয় বর্ষাকাল এখন। উত্তর সাগর হতে মেঘমালা সহসাই উড়ে এসে ভিজিয়ে দেবে সবকিছু। শরীর হয়ে ধুয়ে মুছে ফেলবে লম্বা জার্নির ক্লান্তি।

এ ধরণের আবহাওয়া টিপিক্যাল ব্রিটেনের জন্যে। যতবার এ দ্বীপপুঞ্জে এসেছি ততবারই মেঘাচ্ছন্ন সকাল স্বাগত জানিয়েছে। তাই অবাক হইনি এ যাত্রায়। বিষণ্ণতায় ভরা এ সকাল যে বেশিক্ষণ স্থায়ী হবেনা সেটাও জানা ছিল। কারণ মেঘের ওপাশেই আধির আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে গ্রীষ্মের ঝলমলে রোদ।

দশটা বাজার সাথে ভোজবাজির মত বদলে যায় সকালের বিষণ্ণ চেহারা। কুয়াশার চাদরে মোড়া উত্তর সাগর জেগে উঠবে ঘুম হতে। বাস, ট্রেন আর ফেরী গুলো কানায় কানায় ভরে উঠে পর্যটকদের পদভারে।

ব্যস্ততা বাড়ছে ইমিগ্রেশন বুথ গুলোতে। কাঁধে ব্যাক-প্যাক আর হাতে ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ এগুচ্ছে ওদিকে। কমনওয়েলথভুক্ত দেশ গুলোর জন্যে আলাদা একটা লাইনের ব্যবস্থা আছে। তুলনামূলক কম ভিড় থাকে ওখানটায়। যেহেতু বাংলাদেশ কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশ তাই ওখানেই আমাদের লাইন ধরতে হয়।

পাসপোর্টের পাতাগুলো এদিক সেদিক করে কোন প্রশ্ন না করেই ৬ মাসের ভিজিটির ভিসা ইস্যু করে স্বাগত জানাল ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে। হালকা একটা হাসি দিয়ে আমিও ধন্যবাদ জানালাম।

ইমিগ্রেশন ঝামেলা বলতে যা বুঝায় তা প্রথমবার এ দেশে প্রবেশ করার সময় সেরে নিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার এ নিয়ে আর কোন ঝামেলা পোহাতে হয়নি।

অতিরিক্ত কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছিল সে যাত্রায়। নিজের ব্রিটেন ভ্রমণকে জাস্টিফাই করতে হয়েছিল। কেন এসেছি, কোথায় থাকবো, কতদিন থাকবো এসব প্রশ্নের উত্তর সাবলীলভাবে দেয়ার পর গুনে ২ মাস ১০ দিনের ভিসা দিয়েছিল। পকেটে ১০ ডলার নগদ নিয়ে টুরিস্ট হিসাবে এ দেশে ঢোকা নিমিষেই বানচাল হয়ে যেত যদি ইমিগ্রেশন আমার ওয়ালেট পরখ করতে চাইতো।
তেমন কিছুই করেনি। আমি সোভিয়েত দেশে সরকারী স্কলারশিপে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি এবং আমার ডিগ্রীলাভ ব্রিটেনে অবৈধ অভিবাসী হওয়ার চাইতেও অনেক জরুরি এটাই ছিল আমার ডিফেন্স আর্গুমেন্ট।

ইমিগ্রেশন হতে বেরিয়ে রেল ষ্টেশনে এসে ভাবনায় পরে গেলাম। এখনও অনেক সকাল। কাউকে ফোন করে ঘুম ভাঙ্গানোর সময় হয়নি। বন্ধু হাসানকে ফোন না করে লন্ডনের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আবারও ট্রেন ধরতে হবে। এ যাত্রায় ব্রিটেনের আন্তঃশহর ট্রেন। এসেক্সের হারউইচ হতে লন্ডনের লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশন।

দেড় ঘণ্টার ট্রেন জার্নি। জানালার পাশে বসলে ব্রিটেনের কান্ট্রি সাইড খুব কাছ হতে দেখা যায়। ছোট ছোট উপশহর, ফসলের মাঠ, কাউবয়দের ক্যাটেল নিয়ে ব্যস্ততা, সবকিছু মগজে আটকে যায় স্থায়ী স্মৃতি হিসাবে।

সকালের লোকাল ট্রেন। বলতে গেলে খালিই ছিল যাত্রার শুরুতে। কিন্তু ঘাটে ঘাটে থামার কারণ যাত্রীদের ভিড় বাড়তে শুরু করল। এ পথেই যে অনেকে চাকরি করতে লন্ডন যায় তার আলামত সবখানে। আমার উদ্দেশ্য একই। তবে পার্থক্য হচ্ছে, চাকরি করার আগে তার সন্ধান করতে হবে।

লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশনে নেমে হাতের ব্যাক-প্যাকটাকে বালিশ বানিয়ে প্লাটফর্মের এক কোনায় শুয়ে পরলাম। আমার মত আরও অনেকে একইভাবে সময় কাটাচ্ছে। দশটা বাজার আগ পর্যন্ত বন্ধু হাসানকে ফোন না করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ও অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে। সকালে বিছানা ছাড়ে অনেক দেরী করে।

শুয়ে শুয়েই ফিরে গেলাম একই ষ্টেশনের এক ঘটনায়। বেশ ক’বছর আগের ঘটনা। ব্রিটেন তখন লণ্ডভণ্ড আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির হুমকিতে। যত্রতত্র বোমা ফুটছে। আকাশে বাতাসে ভয়ের রাজত্ব। রাস্তা-ঘাট, বাজার-বন্দর, ষ্টেশনগুলোতে পুলিশদের অতিরিক্ত নজরদারি। সাথে কেডাবরা ডগ। সন্দেহ হলেই পুলিশ আটকে দিচ্ছে অনেক কিছু।

প্রতিবারের মত সেবারও লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশনে বসে অপেক্ষা করছি বেলা গড়ানোর। দশটা বাজার সাথে সাথে হাতের ব্যাক-প্যাকটা বাইরে রেখে ঢুকে গেলাম পাশের টেলিফোন বুথে। একটা পর একটা নাম্বার ডায়াল করে চালিয়ে গেলাম চাকরি সন্ধানের কাজ। মূলত সিলেটী ভাইদের রেস্টুরেন্টের কাজই ছিল আমার মূল টার্গেট। বেশকিছুটা সময় টেলিফোন বুথে কাটিয়ে বাইরে আসতে চোখ ছানাবড়া। পুলিশ!

একগাদা পুলিশ ঘিরে রেখেছে আমার ব্যাক-প্যাক। ক্যডাবরা ডগের সাহায্য নিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। আমি কাছে আসতে চীৎকার করে আদেশ দিল যেখানে আছি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার। আমি একেবারেই বোবা। কোথা দিয়ে কি শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। পুলিশই বা কেন আমার ব্যাক-প্যাক ঘিরে রেখেছে তার আগা-মাথা কিছু বুঝতে পারলাম না।

একজন এগিয়ে এসে জানতে চাইল ব্যাগটা আমার কিনা। স্বীকার করতে আমাকে ঘিরে ফেললো। জানতে চাইলো কি আছে ব্যাগে এবং কেন আমি এক ঘণ্টার উপর একে বাইরে ফেলে রেখেছি।

সোভিয়েত দেশের টুরিস্ট আমি। ব্যাগ বাইরে রেখে ফোনে বন্ধুদের সন্ধান করছিলাম এতক্ষণ। অনেক কষ্টে বুঝানো গেল। ব্যাক-প্যাকে বিস্ফোরক কিছু নেই এমনটা নিশ্চিত হওয়ার পর আমাকে খুলে বলল ঘটনা প্রবাহ। মালিকানা না থাকায় কেউ একজন পুলিশে ফোন করেছিল। পুলিশের সন্দেহ হয়ত আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি ব্যাগ ভর্তি বিস্ফোরক রেখে গেছে বড় ধরণের নাশকতার অংশ হিসাবে।

আমাকে খুবই নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সবকিছু পরিষ্কার হওয়ার পর পুলিশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। প্রস্তাব দিল আমাকে আমার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার। ধন্যবাদ দিয়ে ব্যাক-প্যাক গুটিয়ে বিদায় জানালাম লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশনকে। উৎসুক জনতার অনেকে আমার দিয়ে তাকিয়ে আই এর এ’র চেহারায় দেখছিল।

ষ্টেশনের ঘড়ির কাটা ততক্ষণে ১০টায় পৌঁছে গেছে। বন্ধু হাসানকে ফোন করার সময় হয়েছে।

জানতাম ও রাগ করবে আমার হঠাৎ আগমনে। গেলবার কথা দিয়েছিলাম পশ্চিম বার্লিন নেমেই ওকে ফোন করবো এবং ও আমার জন্যে হারউইচ ষ্টেশনে অপেক্ষা করবে।

যেখানে আছি সেখান হতে এক পা না নড়ার নির্দেশ দিয়ে বন্ধু হাসান রওয়ানা দিল আমার সন্ধানে।

- শেষ।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন