গল্প নয়...

Submitted by WatchDog on Saturday, October 9, 2021

কর্মজীবনই আমাকে আমেরিকার গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ করে দিয়েছে। পাশাপাশি সক্রিয় রাজনীতি দিয়েছে দেশটার রাজনৈতিক দিগন্ত উন্মোচনের।
উন্নত বিশ্বে বাসকরে, এর বহুমুখী সুযোগ সুবিধা ভোগ করেও আমরা অনেকেই এ বিশ্বের দেশগুলো নিয়ে খুবই একপেশে। কথায় কথায় সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, দখলদাবাজ, ইসলামোফোবিয়ার মত অভিযোগে অভিযুক্ত করে থাকি। যদিও দিনশেষে আমাদের জীবনের অনেককিছুই আবর্তিত হয় এসব দেশকে ঘিরেই।

উন্নত বিশ্বের সবকিছুই উন্নত, আমাদের মত ৩য় বিশ্বের সবকিছু গাভনো (রুশ শব্দ) এমন উপসংহারে আসার মত বোকা আমি নই। ভাল-মন্দ নিয়েই একটা সমাজ। আমেরিকাও এর বাইরে নয়।
তবে এমনকিছু বিষয় আছে যা না চাইলেও চোখে পরবে, বিবেকে বাধবে। যে বিষয়টা নিয়ে লিখতে যাচ্ছি তা তেমনি একটা ব্যপার যা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

প্রতিবার দেশে গেলে পৈত্রিক সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বেশকিছু সময় ব্যায় করতে হয়। মা-বাবা মারা গেছেন অনেক বছর। কিন্তু বাংলাদেশের জন্যে টিপিক্যাল অলৌকিক কিছু কারণে সম্পত্তির সমাধান আজ পর্যন্ত করা যায়নি। তা যেমন জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে, তেমনি দাদা বাড়ির সাবরেজেস্ট্রি অফিসে।

নারায়ণগঞ্জ জেলায় আড়াই হাজার বলে একটা উপজেলা আছে। নামটা যেমন অদ্ভুত ওখানকার অনেক কাজকর্মও অদ্ভুত। কৃষি ও শিল্প খাতে গোটা অঞ্চলে একটা বিপ্লব হয়ে গেছে। বাবুরহাটকে ঘিরে ঐ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে তাত সাম্রাজ্য। মানুষের হাতে পয়সা এসেছে। ঐ পয়সাই বদলে দিয়েছে মানুষের জীবন। পাশাপাশি চরিত্র।

সকাল ১০টার ভেতর সাবরেজেষ্ট্রি অফিসে থাকার জন্যে আগেই প্রোগ্রাম করা ছিল। অনেক বছর পর আমরা সব ভাইবোন একত্র হয়েছি দাদা বাড়িতে। ৭১'এর পর এমনটা আর সম্ভব হয়নি। আত্মীয় স্বজনের পাশাপাশি উপচে পরেছে মানুষের ভিড়। আব্বা ছিলেন এলাকার মুরুব্বি। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদেও এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেছেনে। এমন কোন স্কুল, কলেজ, মসজিদ মাদ্রাসা নেই যাতে অবদান রাখেননি।
দুপুরের খাবার আয়োজনে বাবুর্চি পর্যন্ত ডাকতে হয়েছিল। চাচাত, ফুফাতো ভাইবোনদের সবাই হাজির হয়েছিল আমাদের সবাইকে একসাথে একনজর দেখার জন্যে।

রেজিস্ট্রি অফিস বলতে যা আছে তা কোন থিওরিতেই অফিস বলা যাবেনা। স্রেফ গরুর হাট। চারদিকে গিজগিজ করছে হরেক রকম মানুষ। তবে অধিকাংশই আশপাশের গ্রাম হতে আসা কৃষক ও খেটে খাওয়া মানুষ।
অফিস আঙ্গিনায় অন্য এক কিসিমের মানুষের ভিড়, যাদের চেহারাতে আছে বন্য চাউনি। প্রায় সবাই মোটর সাইকেলের উপর বসে কিসের যেন অপেক্ষায় আছে।
অপেক্ষার এ রহস্য উন্মোচন করতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি।
ওরা সবাই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিনিধি।
এমপি, চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নিজেরা উপস্থিত থাকতে পারেন না সামাজিক মর্যাদাবোধের কারণে। তাদের প্রতিনিধিরা প্রতিদিন সকাল হতে তাদের প্রক্সি দেয়। তার উপর আছে তিন চার রকম লীগ নেতাদের কর্মমূখর উপস্থিতি।
আমার ফুফাতো ভাইরা এ এলাকার মানুষ। সবাই ওদেরকে চেনে। বিশেষ খাতির যত্ন করে। ওরা অনেকে এসেছে আমাদের সঙ্গ দিতে। সাথে আমাদের দালাল।
সিরিয়াল ধরে মানুষ রেজেষ্ট্রি অফিসের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কি যেন একটা বলছে আর রেজিস্টার স্যারের খাতায় আঙ্গুলের টিপ দিচ্ছে। পাশাপাশি হাত বদল হচ্ছে শেখ মুজিবের ছবি সম্বলিত টাকার বান্ডেল।

ভিড় বাড়ছে। আমাদের সবাই বিরক্ত। কিন্তু আমার মনে হল জন্মভূমিকে কাছ হতে দেখার এমন একটা সোনালী সুযোগ হাতছাড়া করা উচিৎ হবেনা। তাই নিঃশব্দে মিশে গেলাম মানুষের মিছিলে। রেজিস্টার স্যারের ঠিক পিছনটায় গিয়ে ভূতের মত দাঁড়িয়ে রইলাম।
প্রতিবার স্যার যখন ড্রয়ার খুলে শেখ মুজিবকে ভেতরে ঢুকাচ্ছিলেন ড্রয়ারের পরিসর ছোট হয়ে আসছিল।
স্যার খুব পরহেজগার। লাল দাড়ির উপরে কপালের কালো দাগটা প্রমাণ করে জীবনে হয়ত কোন নামাজই কাজা করেননি।

আমাদের পালা আর আসেনা। ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে একসময় সারেন্ডার করতে বাধ্য হলাম। এই ফাঁকে স্যার ড্রয়ারের সবকটা শেখ মুজিব পকেটস্থ করে চলে গেলে যোহর নামাজ পড়তে।
হঠাৎ করেই সবকিছু নীরব হয়ে গেল। বাইরে টং'এর মত ছোট ছোট ঘরে যারা এতক্ষণ লেখালেখিতে ব্যস্ত ছিলেন সবাই চলে গেলেন জামাতে যোগ দিতে। একাধিক মসজিদ হতে মুয়াজ্জিনের আযান অনেকটা স্টেরিও এফেক্ট নিয়ে কানে বাজতে শুরু করল।

পাশে এক আত্মীয়ের বাসায় আমাদের লাঞ্চের আয়োজন করা হয়েছে। ওখানে ছুটতে হল সবাইকে। আমার ভাইবোনদের সবাইকে আমাকে শান্ত থাকতে অনুরোধ করল। সম্পত্তির সমাধান করতে চাইলে এ পথে হাটা নাকি বাধ্যতামূলক। সবাই হাঁটে, তাই আমাকেও হাঁটতে হবে।

দুপুরের খাবার শেষ করে আবারও ফিরে গেলাম আস্তানায়। চেয়ারের ওপাশে সবাইকে বেশ ফ্রেস দেখালো। বাইরে মোটর বাইকের উপর বসা শিকারির দল নতুন শিকারের আশায় উল্লাসিত দেখাল। ওদের প্রায় সবার হাতে দামি ব্রান্ডের সিগারেট। অনেকের মুখে পান।

কিছুটা চাঙ্গা হয়ে আবারও মিশে গেলাম জনতার মিছিলে। এ যাত্রায় স্যারের ধারে কাছে যাওয়ার সুযোগ ছিলনা। কারণ মানুষের জোয়ারে ভেসে গেছেন আমাদের স্যার।
বাইরে বটগাছের নীচে কেউ একটা গরু জবাই করে এনেছে। ভাগা করে বিক্রি করছে। আস্ত একটা গরুকে প্রাগৈতিহাসিক যুগের যন্ত্রপাতি দিয়ে কি করে কাটছিল মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। অপরিচিত একজন একটা চেয়ার এগিয়ে দিল। মাতব্বর গোছের অনেকেই চেয়ারে বসে নির্দেশনা দিচ্ছিল মাংস বিতরণের।
একজন জানিয়ে গেল আছর নামাজের আগে আমাদের কাঠগড়ায় উঠার সম্ভাবনা নেই। বিরক্ত হলেও হতাশ হলাম না।
বেরিয়ে পরলাম স্থানীয় বাজার দেখতে। আমার এক ফুফাতো ভাই গাইড হল আমার। তরকারী বাজার, মসলার গলি, মাছ বাজার, কোন কিছুই বাদ গেলনা। ৭১'এ যুদ্ধের ন'টা মাস এদিকেই কাটিয়ে গেছি। কিন্তু দেখা হয়নি কোন কিছু। হয়ত ঐ সময় আড়াই হাজার নামের এ বাজারটাও ছিলনা।

আছর নামাজ শেষে স্যার চেয়ারে বসতেই আমাদের ডাক এলো। সকাল হতে যারা লাইন দিচ্ছিল তাদের মত আমারও লাইন দিলাম। কাগজে দস্তখত দিলাম।
আমাদের দালাল কানে কানে বলল, এক লাখ টাকার বান্ডিলটা নাকি আগেই স্যারের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। কারণ নাকি বাইরে মোটর বাইকে বসা ভগবানদের চোখকে ফাঁকি দেয়া।

দাদাবাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল।
চারদিকে ঝি ঝি পোকাদের ডাক। কাঁচাপাকা রাস্তাগুলোতে বাতির ব্যবস্থা নেই। আমাদের গাড়ি অনেকটা ভরা বর্ষায় নদীতে চলমান নৌকার মত হেলছিল।
কারও মুখে কোন কথা নেই। সারাদিন ধৈর্যের সাথে যে পরীক্ষা দিয়েছি তাতে উত্তীর্ণ হওয়ার আমি খুশি। অন্তত সম্পত্তি নিয়ে যে সমস্যা তা হতে সাময়িক মুক্তি পাওয়ায় আনন্দিত।
এমন একটা দিনের অপেক্ষা করছিলাম অনেকদিন ধরে। ভাইবোনদের অনুরোধে কাজকর্ম ফেলে এসেছি সুদূর অস্ট্রেলিয়া হতে।

রাতে দাদাবাড়িতে থাকার কথা থাকলেও সিদ্ধান্ত নিলাম ফিরে যাওয়ার। এলাকাটা নাকি নিরাপদ না। ক্ষমতাসীনদের অনেকেই নাকি ডাকাত দল লালন পালন করে থাকে। সাথে জড়িত স্থানীয় পুলিশ।
ফুফাতো ভাইরা অভয় দিলেও আমরা রিস্ক নিতে চাইলাম না। রওয়ানা দিলাম বাড়ির দিকে।

ফেরার রাস্তার সবটাই ছিল অন্ধকারে ঢাকা। রাস্তাটা এক সময় রেললাইন ছিল। আমাদের শহর হতে মদনগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার সহজ রাস্তা ছিল।
যুদ্ধের ন'মাস বাড়ির কাউকে না জানিয়ে বহুবার হাহাহাটি করেছি এপথে। মোল্লার চর ষ্টেশন হতে ধানের বস্তা টানা ঘোড়ায় চড়ে চলে গেছি গঞ্জের দিকে।

'৭১ সাল কি হাজার বছর আগের কোন সাল! কেন জানি তাই মনে হচ্ছিল। খণ্ড খণ্ড স্মৃতিগুলো এক করে কোনভাবেই মেলাতে পারছিলাম না যুদ্ধের সময়গুলোর সমীকরণ। আসলেই কি এমন একটা স্বাধীনতার জন্যে অধীর আগ্রহে ছিলাম!
মনে রাখার মত একটা দিন শেষে আমরা সবাই ছিলাম ক্লান্ত। বাড়ির আঙ্গিনায় বসে বাকি রাতটা গল্প করে কাটিয়ে দিয়াছিলাম। সুখের ছোঁয়া ভুলিয়ে দিয়েছিল আড়াই হাজারের কয়েক ঘণ্টার দুঃসহ স্মৃতি।

আমেরিকার সম্পত্তি হাত বদলের নিয়ম-কানুন নিয়ে লেখাটা আলাদা করে লিখলেই বোধহয় পাঠকদের ধৈর্য ধরে রাখা যাবে।
সবাই ভাল থাকবেন।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন