কর্পোরেট আমেরিকা ও আমেরিকান রাজনীতি!

Submitted by WatchDog on Friday, May 21, 2021

সোমবার। আর দশটা দিনের মতই একটা দিন। সপ্তাহের শুরু এবং প্রকৃতি বসন্তের অপরূপ সাজে হাজির হয়েছে ঘরে বাইরে।
উইকএন্ডের পর কিছুটা খারাপ লাগলেও ফিরে গেছি কাজের টেবিলে। গিন্নী ছুটি নিয়েছে মেয়ের ভার্চুয়াল ক্লাসে সঙ্গ দিতে। ছেলেটা টিভি ছেড়ে কার্টুন দেখছে।
ঘণ্টা খানেক ক্লাস চলার পর মেয়ে ও তার মা টেবিল ছেড়ে উপরে চলে গেল। অবাক হলাম। কারণ জানতে আমিও তাদের পিছু নিলাম।
সকাল সকাল ক্লাশ শেষ হওয়ার কারণটা জেনে কিছুটা হতাশ হলাম।

কোভিড পরিস্থিতির কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের একাংশ স্কুলে ফিরে গেলেও অনেকেই ফিরে যায়নি। তাই ক্লাশ দু'ফ্রণ্টেই হচ্ছে, স্কুলে ইন পার্সন ও ভার্চুয়াল।
ভার্চুয়াল ক্লাশ হঠাৎ শেষ হওয়ার কারণ স্কুলে আজ একটা ড্রিল চলছে। ড্রিল মানে মহড়া। মহড়ার উপলক্ষ একান্তই আমেরিকান। পৃথিবীর দ্বিতীয় কোন দেশে এ ধরণের মহড়ার কথা কল্পনাও করা যায়না।
মহড়া চলছে, স্কুলে কেউ একজন বন্দুক নিয়ে প্রবেশ করে এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে স্কুলে উপস্থিত ছাত্র ও শিক্ষকদের আত্মরক্ষার জন্যে কি করতে হবে তা হাতে কলমে শিক্ষা দিচ্ছে।

এমন মহড়া দেয়ার যথেষ্ট কারণ আছে আমেরিকান স্কুল গুলোতে। কারণ বছরের পর বছর ধরে স্কুল আঙ্গিনা দেখছে ম্যাস শুটিং। রক্ত ঝড়ছে। প্রাণ হারাচ্ছে ছোট ছোট শিশুরা। ঘরের সমস্যায় ডিপ্রেসড কিশোরদের অনেকে বাক্স ভর্তি গুলি নিয়ে হাজির হয় স্কুলে এবং নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নিজের আক্রোশ মেটায়।

২০১২ সালের ১৪ই ডিসেম্বর কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যের নিউটাউন শহরের স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুল শিকার হয় তেমনি এক ম্যাস শুটিং'এর। ২০ বছর বয়স্ক এডাম লানজা খুন করে ২০ জন ছাত্র, যাদের সবাই ছিল ১ম শ্রেনীর। খুন করে ৬জন শিক্ষক। এবং স্কুলে আসার আগে বাসায় খুন করে আসে নিজের মা'কে।
২০ জন শিশুদের অনেককেই চেনার উপায় ছিলনা। কারণ তাদের শরীরে চেনার মত কোন অঙ্গ ছিলনা। থেতলে গিয়েছিল সবকিছু।

আমার মত অনেকেই মনে করেছিল এমন হ্রদয়বিদারক ঘটনার পর নিশ্চয় কিছু একটা ঘটবে। হয়ত জনগণের চাপে প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস একত্রিত হয়ে ফ্রী অস্ত্র প্রবাহের উপর কিছুটা হলেও বিধিনিষধ আরোপ করবে।
বাস্তবে এমন কিছুই ঘটেনি। আর দশটা ম্যাস শুটিংয়ের মত স্যান্ডি হোক শুটিংও ঠাঁই নেয় ইতিহাসে।

কেন এমনটা হয়? বার বার এমন নির্মম হত্যাকান্ডের পরও কেন মার্কিন সরকার ও জনপ্রতিনিধিরা কিছু করতে যায়না? এ দুটো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বেরিয়ে আসে আমেরিকান সমাজের অনেক অজানা তথ্য, যার সবাটাই বাইরের পৃথিবীতে যায়না।

আমেরিকান সরকার ও তার নাগরিকরা যে আমেরিকার আসল মালিক নয় তার আসল চিত্র লুকিয়ে আছে এসব হত্যাকান্ড ও এর পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে। আসল মালিক তাহলে কে বা কারা?
আমার ২১ বছর আমেরিকান জীবন এমন একটা সত্য উপলদ্বি করতে সাহায্য করেছে, যা ছিল অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর।
যে কোন বিচারে কর্পোরেট আমেরিকা হচ্ছে আমেরিকার আসল মালিক। ওরাই নিয়ন্ত্রন করে রাস্ট্র, সমাজ, আইন, আদালত, নির্বাচন, পার্লামেন্ট, হোয়াইট হাউস সহ বাকি সবকিছু।

ন্যাশনাল রাইফেল এসোসিয়েশন হচ্ছে তেমনি এক কর্পোরেট বডি যারা নিয়ন্ত্রণ করে দেশের অনেক কিছু। এ বডির চালিকাশক্তি দেশের আর্ম ম্যানুফেকচারিং কারখানাগুলো। দেশে অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয় কতটা সহজ করা যায় এনআরএ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য এটাই।
এখানে বলে রাখা ভাল, বাংলাদেশের মুদি দোকানে আকিজ বিড়ি যেমন সহজল্ভ্য, এ দেশে সেমি অটোমেটিক রাইফেল কেনা তার চাইতেও অনেক সহজ ও সস্তা। আমেরিকার প্রতি ঘরে একাধিক অস্ত্র থাকে। এ দেশে পিতা তার অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের জন্মদিনে একে-১৫ রাইফেল উপহার দেয়।

এনআরএ তার অর্থ ও জনপ্রিয়তাকে কংগ্রেস নির্বাচনে বিনিয়োগ করে। যেসব ক্যান্ডিডেট তাদের কর্মসূচীকে সমর্থন করে তাদের পেছনে ব্যায় করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। তাদের ডলার প্লাবনে ভেসে যায় হাজার মানুষের নিরাপত্তা। তাদের পয়সায় নির্বাচিত কংগ্রেস সদ্যসরা বোবা হয়ে যায় যখন প্রশ্ন উঠে অস্ত্র নিয়ন্ত্রনের। স্যান্ডি হোকের বেলায়ও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। এমনকি যেসব মা-বাব তার সন্তানদের হারিয়েছিল তাদের অনেকেও কথা বলেনি অস্ত্র নিয়ন্ত্রনের।

বাইডেন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্য কনফ্লিক্টে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সাথে ফোনালাপের পর জোরদার করেছে গাজায় বিমান হামলা। কারণ ফোনে প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিশ্চিত করেছেন ইসরায়েলের প্রতি তাদের শর্তহীন সমর্থন।

এখানে ব্যাক্তি বাইডেনকে আমরা কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারি এমন অমানবিক সমর্থনের কারণে। প্রশ্ন উঠে ব্যাক্তি বাইডেন কি টেলিভিশন দেখন না? ইসরায়েলি পশুত্ব কি তাকে নাড়া দেয়না। অসহায় শিশুদের লাশ কি তাকে কাঁদায় না? এসব প্রশ্নের উওর হয়ত আমরা কোনদিনও পাবোনা। কারণ ব্যাক্তি বাইডেনের পছন্দ অপছন্দগুলো আমার মত সাধারণ পাব্লিকদের কাছে উন্মোচিত হবেনা।
তবে ইসরায়েলের প্রতি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আনকন্ডিশনাল সমর্থনের কারণ খুঁজতে আমাদের বেশিদূর যেতে হয়না। এখানেই ডিসাইসিভ রোল প্লে করে কর্পোরেট আমেরিকা। ওদের অর্থায়নেই নির্বাচিত হয়েছেন বাইডেন। এবং সামনে পুণঃনির্বাচনে তারাই পালন করেব আসল ভূমিকা।

ইসরায়েলি ও ইহুদি লবির হাতে অনেক টাকা। আমেরিকার অর্থনীতির সিংহভাগ ওদের নিয়ন্ত্রনে। মিডিয়ায় তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। আমেরিকার জনসংখ্যার শতকরা ২০ ভাগ হচ্ছে খ্রীষ্টান ধর্মের ইভানজেলিকো ভাবধারার অনুসারী। এই জনসংখ্যার সবাই খোদ ইসরায়েলের চাইতেও বেশি ইসরায়েল প্রেমী। তার কারণ ধর্মীয়। ওদের হাতেও অনেক টাকা। এই টাকা নির্বাচনের মাঠে অনেক খেলা খেলে থাকে।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গিয়ে প্যালেষ্টাইনের পক্ষে কথা বললে সামনের নির্বাচনে কেবল তারই ভরাভুবি হবেনা, সাথে ডুববে তার ডেমোক্রেট দলীয় কংগ্রেস সদস্যরা।
ক্ষমতার মোহ ও বিভিন্ন লবির অর্থই নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সহ কংগ্রেস সদস্যদের।
এখানে উল্লেখ্য এক সময় রিপাব্লিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও আরিজোনা অঙ্গরাজ্যের আজীবন সিনেটর জন ম্যাককেইন ছিলেন এনআরএ'র নির্বাচনী ফান্ডের নাম্বার ১ বেনিফিশিয়ারী। এবং এ কারনেই এই সিনেটর স্যন্ডি হোকের ২০ শিশুর থেতলে যাওয়া লাশ দেখেও কিছু বলতে অথবা করতে সাহস করেননি। কারণ তিনিও ছিলেন এনআরএ'র দম দেওয়া পুতুল। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও তেমনি ইসরায়েলি লবি ও স্থানীয় ইহুদিদের অর্থের সেবক। তার কাছে একজন প্যালেষ্টাইনি শিশুর লাশের চাইতে তার পুণঃনির্বাচন অনেক বেশী জরুরি।

প্রশ্ন উঠবে তাহলে কংগ্রেসের যেসব সদস্য প্যালেষ্টাইনের পক্ষ নিয়ে কথা বলছে ওরা কারা? এখানের ব্যপারটাও খুব জটিল না।
নিউ ইয়র্কের কংগ্রেস ওম্যান ওকাসিও কোর্তেজ এমন ডিষ্ট্রিক হতে নির্বাচিত হয়ে থাকেন যেখানে বাংলাদেশি সহ অনেক দেশের মুসলমানদের বাস। একই ব্যাপার মিনিসোটার ইলহান ওমার ও মিশিগানের প্যালিষ্টাইনি বংশোদ্ভূত রাশিদা তালিব।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন