দ্যা ডে আফটার...

Submitted by WatchDog on Thursday, November 26, 2020

অনেকে প্রশ্ন করছেন একজন বাংলদেশি হয়ে কেন আমি মার্কিন নির্বাচন অথবা দেশটার সার্বিক রাজনীতি নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছি। প্রশ্নগুলোতে যেমন যুক্তি আছে তেমনি এর উওরেও আমার জন্যে আছে শক্ত ভিত্তি। প্রথমত, এটা খুবই যুক্তিসংগত প্রশ্ন একজন বাংলাদেশি হয়ে কেন আমি মার্কিন নির্বাচন নিয়ে এতো মাথা ঘামাবো। এর দুটো উত্তর আছে আমার কাছে। প্রথমত, আমরা গ্লোবাল অর্থনীতির পৃথিবীতে বাসকরি। কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই নয়,,বরং পৃথিবীর কোন কোনায় কি ঘটছে এবং তাতে বিশ্ব অর্থনীতির উপর কি প্রভাব ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে মাথা ঘামাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সন্ত্রাষী হামলা হলে এর প্রভাব নিমিষেই ছড়িয়ে পর পৃথিবীর সব কোনায়। তেলের বাজারে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা, বাড়তে থাকে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম। এর তাৎক্ষুণিক প্রভাব দেখা দেয় দৈনন্দিন জীবনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক অর্থে বিশ্ব অর্থনীতির চালিকা শক্তি। আর এই শক্তির ড্রাইভিং সীটে আসীন থাকে দেশটার গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন কেবল সে দেশের জন্যেই নয়, বরং বাকি বিশ্বের জন্যেও খুব কাছ হতে লক্ষ্য করার মত একটি প্রক্রিয়া।
দ্ধিতীয়ত; ব্যক্তি হিসাবে আমি দেশটার রাজনীতিরকেবল নীরব দর্শকই নই,বরং এর সক্রিয় অংশীদার। নাগরিক হিসাবে এ দেশের দলীয় রাজনীতির সাথে আমি জড়িত এবং এর গতিপ্রকৃতি তথা আউটকাম নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহী।

ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেনের বিজয়ের মাধ্যমে নির্বাচনী উত্তাপ থিতু হয়ে গেছে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। বরং এই উত্তাপ নতুন ডাইমেনশন নিয়ে আমেরিকান সমাজকে গ্রাসকরার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কেবল। মার্কিন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নির্বাচনের অংশ হচ্ছে, পরাজিত প্রার্থী নিজের পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানায়। এমনটা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। ব্যতিক্রম কিছু থাকলেও এবারই প্রথম পরাজিত প্রার্থী কেবল বিজয়ী প্রার্থীকে অভনন্দনই জানাননি, বরং নিজকে বিজয়ী হিসাবে দাবি করতে শুরু করেছেন।

একটা বাস্তবতা পরিস্কার না করলেই নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফল সরকারীভাবে ঘোষণার এখনও অনেকদেরী। জয়-পরাজয়ের বর্তমান সিদ্ধান্ত মোটেও সরকারী সিদ্ধান্ত নয়, বরং স্থানীয় মিডিয়ার প্রজেকশন মাত্র। ভোটকেন্দ্রের বেসরকারী ফল ও ভোটকেন্দ্রের বাইরে পরিচালিত জরীপের মাধ্যমে মিডিয়া তাদের সিদ্ধান্ত জানায়। এসব ঘোষণার পেছনে থাকে অতীত ভোট ট্রেন্ডের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও ফিন্ড ডাটা। সবকিছু মিলিয়ে এবারের নির্বাচন ছিল আন-প্রেডিক্টেবল। যার কারণে মিডিয়া অনেক অঙ্গরাজ্যের ফলাফল প্রজেকশনে তাড়াহুড়া করেনি।

বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নির্বাচনী ক্যাম্প মিডিয়ার প্রজেকশন মেনে নেয়নি। অফিসিয়াল ফলাফল ঘোষণার আগে তা প্রত্যাখান করা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে যে কারণে তারা তা করছে তা গোনায় আনার দাবি রাখে। ট্রাম্প ক্যাম্পের অভিযোগ হচ্ছে, নির্বাচনে ব্যাপক ধরণের কারচুপি হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরছে, ফলাফল ঘোষণার প্রথম প্রহরে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্পের ব্যাপক ব্যবধানে এগিয়ে থাকা। এবং যত সময় গড়াতে থাকে ফলাফল বিপক্ষে যাওয়া। যাদের ভেতরের খবর জানা নেই তাদের কাছে এসব অভিযোগ অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। আমি আগের এক লেখায় এর কারণ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এবারের নির্বাচন অন্যবারের মত স্বাভাবিক নির্বাচন ছিলনা গ্লোবাল পেন্ডেমিকের কারণে। দেশের সিংহভাগ মানুষ সশরীরে ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়ে ভোট দেয়নি। বরং আমার মত অনেকেই ভোট দিয়েছে ডাক মাধ্যমে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের রি-ইলেকশন প্রচারণায় কোভিড-১৯'কে গুরুত্ব দিতে চাননি। বরং পেন্ডেমিককে আন্ডার মাইন করে তার সমর্থকদের মগজে এমন একটা ধারণা ঢুকাতে সমর্থ হয়েছিলেন, করোনা ভাইরাসকে অস্বীকার করলে মার্কিন জনগণ অন্য ক্ষেত্রে তার সাফল্যকে মূল্যায়ন করবে বেশী এবংতা পুণঃনির্বাচনে সহায়তা করবে। তাই প্রচারণার মাঠে নিজে যেমন ভাইরাস মোকাবেলায় মাস্ক পরেননি, অন্যদেরও না পরায় উৎসাহ দিয়ে আসছিলেন। পাশাপাশি ডেমোক্রেট দলীয় প্রচারণার মূল অস্ত্র ছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কভিড মোকাবেলার ব্যর্থতা।

মেইল-ইন ব্যালটে ডেমোক্রেটদের অংশগ্রহন ছিল ব্যপক। অন্যদিকে রিপাব্লিকানরা তাদের নেতার সাথে একাত্মতা ঘোষণার অংশ হিসাবে ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়ে ভোট দেয়াকে বেছে নিয়েছিলেন। ভোটকেন্দ্র বন্ধ হওয়ার পর পর কেন্দ্রগুলোতে হাজির হয়ে যারা ভোট দিয়েছিলেন তাদের ভোট গননা দিয়ে শুরু হয় গোনার প্রক্রিয়া। স্বাভবতই ফলাফল ঘোষণার প্রথম প্রহরে ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যবক ব্যবধানে এগিয়ে যান। ভোটকেন্দ্রে দেয়া ভোটগুলোর ফলাফল ঘোষণার পর শুরু হয় মেইল-ইন ব্যালট গোনার প্রক্রিয়া। যেমনটা আশাকরা গিয়েছিল, ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থীরা ধীরে ধীরে ডমিনেট করতে শুরু করে। পেনসেলভানিয়া ও জর্জিয়ার মেইল-ইন ভোটের সংখ্যা আন্দাজ করার পর আমি নিজে ফলাফল ঘোষণার একদিন আগেই বলেছিলাম বাইডেন ঐ দুটো অঙ্গরাজ্যে জিততে যাচ্ছে। বাস্তবেও তাই হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজের পরাজয় সহজভাবে মেনে নেবেননা, এমনটা সবাই আশংকা করছিলেন। বাস্তবেও তাই ঘটছে। না মেনে নেয়ার কারণ হিসাবে দাবি করছেন ওয়াইড স্প্রেড ইলেকশন ফ্রড। এবং মামলার পর মামলা করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। সমস্যা হচ্ছে, এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। উল্লেখ্য, প্রায় সব নির্বাচনী কেন্দ্রে ট্রাম্প ক্যাম্পের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল। বিশেষকরে সুইং অংগরাজ্যের কেন্দ্রগুলোতে। আমেরিকার ২০০ বছরের নির্বাচনী ইতিহাসে ভোটকেন্দ্রে ব্যপক ভোট জালিয়াতির কোন উদাহরণ নেই। পরিসংখ্যান মতে, গেল ৪০ বছরে কাস্ট করা ১ বিলিয়ন ভোটের মাত্র ১২৯৮টা জাল ভোটের প্রমাণ রেকর্ড করা হয়েছে। তাই ট্রাম্পের এসব অভিযোগের যেমন ভিত্তি নেই, তেমনি নেই আদালতে জেতার আশা।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বাদে এবারের নির্বাচনে রিপাব্লিকানদের প্রাপ্তি কম ছিলনা। হাউসে তাদের সংখ্যা বেড়েছে। সিনেটের মেজোরিটও তারা হারায়নি যেমনটা আশা করেছিল অনেকে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বলা যায় ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্রেটরা তাদের মেজোরিটি হারাবে। তার অন্যতম কারণ হবে ডেমোক্রেট দলের আভ্যন্তরীণ বিভক্তি। এই দলে একদিকে বার্ণি সান্ডার্স ও আলেক্সানড্রা ওকাসিও কোর্তেজের প্রোগ্রেসিভ উইং পাশাপাশি এলিজাবেত ওয়ারেনের মত বাম ঘেষা মধ্যপন্থী ডেমোক্রেট এবং জো বাইডেনের মত ট্রাডিশনাল ডেমোক্রেট। সন্দেহ নেই এবারের কংগ্রেস নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ ছিল বার্ণি সান্ডার্স গ্রুপের কথিত সমাজতান্ত্রিক এজেন্ডা। সাধারণ আমেরিকানদের কাছে সমাজতন্ত্র এখনো একটি ভীতি। ট্রাম্প ও তার নির্বাচনী প্রচারণার অন্যতম আইটেম ছিল এই সমাজতান্ত্রিক দৈত্য। যদিও এওসি ও ইলহান ওমারের মত বামঘেঁষা প্রার্থীরা হারেনি, কিন্তু রিপাবলিকান অংগরাজ্য গুলোতে এর প্রভাব ছিল ব্যপাক। আরও কারণ ছিল ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস'এর মত সহিংস সামাজিক আন্দোলন। আফ্রিকান আমেরিকানদের এ আন্দোলন অনেক মধ্যপন্থী সাদা আমারিকানদের ট্রাম্প শিবিরের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ভোটের বিবেচনায় এ আন্দোলন ছিল ডেমোক্রেটদের জন্যে বড় ধরণের বিপর্যয়। এ আন্দোলন অব্যাহত থাকলে বাইডেনের জন্যে দ্বিতীয় টার্ম জেতা হবে খুব কষ্টসাধ্য ব্যপার।

আমেরিকা একটা গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে অনেক কিছুই পৃথিবীর অন্যসব উন্নত দেশের চাইতে ভিন্ন। দেশটাকে বলাহয় ল্যান্ড অব অপরট্যুনিটি। যোগ্যাতার বলে একজন কেনিয়ান ইমিগ্রেন্টের সন্তানও এদেশে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হতে পারে। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত অন্যকোন দেশের বেলায় এ বাস্তবতা প্রযোজ্য নয়। কামালা হ্যারিসের নির্বাচন নতুন করে তা গোটা বিশ্বকে মনে করিয়ে দিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনীতি মার্কিনীদের সে বাস্তবতাকেই কেড়ে নিতে চেয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাদাদের, এটাই ছিল ট্রাম্পের আসল ম্যাসেজ। খুব সফল্ভাবে তিনি পৌছে দিতে সক্ষম হয়েছেন সাদা আমেরিকানদের দুয়ারে। বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন আমেরিকানদের। এবং এই বিভক্তির রেশ আগামী ১০০ বছরে দূর হবে বলে মনে হয়না।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন