দেড় ঘণ্টার এল সালভাদর!

Submitted by WatchDog on Sunday, July 19, 2020

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় সালভাদর নামে আমার একজন বন্ধু ছিল। খুব ঘনিষ্ঠ না হলেও একই ফ্যাকাল্টির ছাত্র হওয়ার কারণে প্রায়ই ক্লাসে অথবা করিডোরে দেখা হয়ে যেত। হাই হ্যালো ছাড়া তেমন কোন বাক্য বিনিময় হতনা। খুব ঘোলাটে চরিত্রের এই মানুষটার সাথে একদিন ডর্মের ক্যাফেটেরিয়ায় অনেক আলাপ। জায়গা না থাকায় খাবার নিয়ে একই টেবিলে বসতে বাধ্য হই আমরা। কথা প্রসঙ্গে উঠে এলো উভয়ের আদিবাস। আমি বাংলাদেশ হতে তার নাকি জানা ছিল। ইউনিভার্সিটির ম্যাগাজিনে আমার লেখা সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে। তাছাড়া আমার রুশ ভাষার শিক্ষকের মুখেও নাকি আমার কথা শুনেছে। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে জানালো তার জন্মভূমি সেন্ট্রাল আমেরিকার দেশ এল সালভাদর। এবং বাড়ি দেশটার রাজধানী সান সালভাদর'এ। অর্থাৎ তার নাম সালভাদর, দেশ এল সালভাদর এবং জন্মের শহর সান সালভাদর। ঐদিনের পর হতে যখনই সাথে দেখা হতো তাকে আমি থ্রি-ইন-ওয়ান বলে ডাকতাম।

যাচ্ছি লস এঞ্জেলস হয়ে কলোম্বিয়ার রাজধানী বগোটায়। ছুটির কিছু অলস ঘণ্টা কাটানোই ছিল আসল উদ্দেশ্য। ইচ্ছা ছিল ড্রাগ লর্ডদের অভয়ারণ্য মেদেইনে ঢু মারার। ফ্লাইটের ইঞ্জিনে কিছু গোলমাল দেখা দেয়ায় ইমার্জেন্সি কোথাও ল্যান্ড করতে বাধ্য হলো। এভিয়াংকা এয়ারলাইন্সের পাইলট অথবা হোষ্টেসদের মুখ অনেকক্ষণ বন্ধ ছিল। উৎকণ্ঠায় সবার দম বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা। অবশেষে বিশেষ কোন ঝামেলা ছাড়াই অপরিচিত একটা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করল বগোটাগামী এ ফ্লাইট। কেবল সফল ল্যান্ড করার পরই জানতে পারলাম আমরা সেন্ট্রাল আমেরিকার দেশ এল সালভাদরের রাজধানী সান সালভাদরে ল্যান্ড করেছি। এবং ১২ ঘণ্টার আগে এখান হতে উড়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

এ ধরণের অপরিকল্পিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত দেরীগুলো মাঝে মধ্যে আমি খুব উপভোগ করি। বিশেষকরে ছুটির সময়ে। হাতের লাগেজ নিয়ে ট্রানজিট লাউঞ্জে আয়েশ করে বসতেই মনে হলো ১২ ঘণ্টা এয়ারপোর্ট নামের এই জেলখানায় বসে থাকা অসম্ভব। এয়ারপোর্টের নামটা যেমন অদ্ভুত ভেতরের কাজা-কারবারও ছিল তেমনি অদ্ভুত...Monseñor Óscar Arnulfo Romero International Airport! খুব সাদামাটা একটা এয়ারপোর্ট। দেখার মত তেমন কিছু নেই। এয়ারলাইন্সের পয়সায় ব্রেকফাস্ট সেরে সোফায় বসতেই আইডিয়াটা মাথায় এলো...ভিসা নিয়ে কয়েক ঘণ্টার জন্যে সান সালভাদর ঘুরে আসা!

অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টের কারণে খুব সমাদরের সাথে ইমিগ্রেশন স্বাগত জানালো দেশটায়। হাতের লাগেজটা এয়ারপোর্ট লকারে রেখে বেরিয়ে এলাম এল সালভাদর নামের নতুন একটা দেশে। অপরিচিত দেশ। ভাষা জানা নেই। কোথায় যাব তার কোন ঠিকানা নেই। খুঁজে খুঁজে বের করলাম বাসের সাঁটল সার্ভিস আছে সান সালভাদরের ডাউন টাউনে যাবার। সময় লাগে ৪৫ মিনিটের মত। ভাড়াও তেমন কিছু নয়। পাশের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডেও অনেক ট্যাক্সি। ওরাও ভাড়া যায়। দোটানায় পরে গেলাম, কোথা হতে শুরু করবো এ জার্নি!

হাতে নষ্ট করার মত অজস্র সময়। তাই সময় নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করলাম। পরিষ্কার একটা জায়গা দেখে বসে পরলাম। ওখানে আমার মত আরও অনেকে বসে আছে। এবং ওখানেই পরিচয় এরনেস্তোর সাথে। ও আর্জেন্টিনার বাসিন্দা। থাকে মায়ামিতে। বসে অপেক্ষা করছে তার সালভাদরিয়ান বান্ধবীর। কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলো আমার ভ্রমণের উদ্দেশ্য। সংক্ষেপে জানান দিলাম ফ্লাইটের ইঞ্জিন ত্রুটি এবং ১২ ঘণ্টার নির্বাসন। এরনেস্তো নড়েচড়ে উঠলো আমার কথা শুনে। রীতিমত ভয় পেয়ে গেল আমার সান সালভাদর দেখার পরিকল্পনা শুনে। উপদেশ দিল এখনই ট্রানজিট লাউঞ্জে ফিরে যাওয়ার। জান নিয়ে ফিরে যেতে চাইলে এটাই নাকি একমাত্র পথ। অনেক গল্প শোনালো এ দেশটার। প্রতি পরতে নাকি ওরা ওৎপেতে থাকে থাকে বিদেশিদের জন্যে। এ শহরে বিদেশিদের কিডন্যাপ নাকি খুব লাভজনক বাণিজ্য। এয়ারপোর্টের আশেপাশেই থাকে ওরা। হটলাইন থাকে বাস ও ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সাথে। পরিকল্পনা মাফিক মাঝপথে বিকল হয়ে যায় বাস অথবা ট্যাক্সি। এবং মুখোশ পরা সালভাদরিয়ান সন্ত্রাসীরা চারদিক হতে ঘিরে ধরে। উঠিয়ে নিয়ে যায় বিদেশিদের। এবং বিরাট অংকের মুক্তিপণ না দিলে ভবলীলা সাঙ্গকরে দেয় অতিথিদের!

নিজকে দ্বিতীয় কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ না দিয়ে তখনি ফিরে গেলামএয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে। ঘোলাটে চরিত্রের বন্ধু সালভাদরের মতই ঘোলাটে মনে হলো এ দেশ। সর্বসাকুল্যে ঘণ্টা দেড়েকের ভেতর সমাপ্ত হলো আমার সেন্ট্রাল আমেরিকার একটা দেশ দেখার মিশন।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন