নুসরাত হত্যা মামলার সব আসামীদের মুক্তি চাই!

Submitted by WatchDog on Friday, October 25, 2019

বাংলাদেশের গোটা বিচার ব্যবস্থা হচ্ছে একটি নির্মম কৌতুক। বিনোদনে ভরপুর। দেশের বাকি 'গণতান্ত্রিক' প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সামঞ্জশ্যপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলি হতে একটা ঘটনা শেয়ার করলে হয়ত এই ষ্ট্যান্ড-আপ কমেডি প্রতিষ্ঠানের সার্বিক একটা চিত্র তুলে ধরা যাবে। চলুন ঘুরে আসি স্মৃতির গলিতে...

শুক্রবার।
মাঘ মাসের সোনাঝরা রোদ্দুর আলতো পরশ বুলাচ্ছে গায়ে-গতরে। বসে আছি আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানের ছোট খোলা মাঠটায়।। চোখ বুলাচ্ছি দৈনিক একটা পত্রিকায়। হঠাৎ মুল ফটকে হাল্কা একটা ঝটলার কারণে মনযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। চোখ ফেরাতেই দেখলাম কোটা টাই পরিহিত এক ভদ্রলোক ঢোকার চেষ্টা করছেন। তাতে বাধ সা্ধছে ফটকের দারোয়ান। কিছুতেই ঢুকতে দেবেনা। আমাদের এলাকায় এমন পোশাকের ভদ্রলোক খুব একটা দেখা যায়না। বিশেষকরে শুক্রবার সকালে। হাতে একটা কালো ব্রীফকেস ভদ্রলোকের পরিচয়কে আরও রহস্যময় করে তুলল। দারোয়ান আমার দিকে তাকালো। আমি ইশারা দিতেই ছেড়ে দিল।

লম্বা একটা সালাম দিয়ে আমার সামনে দাড়াল। উত্তরে মিন মিন সুরে আমিও কিছু একটা বললাম।
- আমি এসেছি ঢাকা হতে। বিশেষ একটা বিষয়ে কথা বলতে। বলেই একটা বিজনেস কার্ড বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।
অনেকদিনের আগের ঘটনা। ভদ্রলোকের নাম মনে থাকার কথা নয়। লেখার খাতিরে ধরে নিলাম তিনি ছিলেন বাবু ইন্দ্রজিত মন্ডল।
কথা বেশিদূর গড়ানোর আগেই জানা গেল তিনি ঢাকার কোন এক কোর্টের পেশকার। আজ এখানে এসেছেন জনৈক বিচারকের প্রতিনিধি হয়ে। অপেক্ষমান কোন এক মামলার দফারফা করতে।

ভেতরের কাহিনী বাইরে আনতে একটু সময় লাগলো। এই ফাঁকে পাশের চায়ের দোকান হতে দু'কাপ চা আনতে দারোয়ানকে ইশারা দিলাম।
রহস্যময় এক গল্প শোনালেন ভদ্রলোক।
বেশ ক'বছর আগের কাহিনী। আব্বা তখনো বেঁচে। পেশকার সাহেবের মতে আমাদের শিল্প-কারখানার পরিসর বাড়ানোর লক্ষে আব্বা স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে নতুন সংযোগের জন্যে দরখাস্ত করেছিলেন। সময়মত তার অনুমতিও দেওয়া হয়েছিল। এবং মাসে মাসে এই সংযোগের বিপরীতে বিদ্যুৎ বিলও পাঠানো হয়েছিল আমাদের ঠিকানায়। কিন্তু আমরা এসব বিল পরিশোধে কোন উৎসাহ দেখাইনি। যার কারণে বিদ্যুৎ অফিস মামলা ঠুকে দেয় আমাদের নামে। কেস চলে যায় রাজধানী ঢাকা শহরের কোন এক কোর্টে। সে সব শুনানিতে আমাদের কেউ হাজিরা দেয়নি। বিচারক সাহেব তাই বেজায় অসুখি। চটে আছেন আমাদের উপর। গায়ের জ্বালা ঠাণ্ডা করার অহি বানী নিয়েই মন্ডল বাবু পা রেখেছেন আমাদের সীমানায়। 'মহামান্য' বিচারক প্রস্তাব পাঠিয়েছেন নগদ দশ হাজার (এখনকার পাঁচ লাখের সমান হবে হয়ত) দিলে মামলা আমাদের পক্ষে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। না দিলে আসামীকে গ্রেফতার সহ স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক দেয়ার ডিক্রি জারী করে দেবেন। বলাই বাহুল্য বিদ্যুৎ সংযোগে কারখানার উদ্যোক্তা হিসাবে দেখানো হয়েছে আমাদের মা'কে। তাই আসামীও তিনি। এবং কাউকে গ্রেফতার করলে উনাকেই করা হবে।

প্রচ্ছন্ন হুমকি। তুবড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার উপায় ছিলনা। ডাকলাম আমাদের হিসাব রক্ষক আলমকে। জানতে চাইলাম এর ব্যাকগ্রাউন্ড। এবং বেরিয়ে এলো, এমন একটা কারখানার আসলেই উদ্যোগ ছিল। যা বাস্তবে রূপ নেয়নি বহুবিধ কারণে। বিদ্যুৎ সংযোগেরও দরখাস্ত জমা হয়েছিল। কিন্তু তা বেশিদূর গড়ায়নি।
আলমের মুখে শোনা গেল আরও চমকপ্রদ কিছু তথ্য। এর আগেও কোট-টাই পরিহিত এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। এবং উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। বিলের যে অংক জমা হয়েছিল তার অনেকটাই পরিশোধ করা হয়েছিল। এবং বিচারকের উপঢৌকন হিসাবে মোটা দাগের একটা অংক নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন সে ভদ্রলোক। কথা দিয়েছিলেন এখানেই কবর রচিত হবে এ অধ্যায়ের।

ইন্দ্রজিত বাবুর কাছে অতীত ইতিহাস তুলে ধরতে বেচারা ফিক করে হেসে দিলেন। গুষ্টি উদ্বার করলেন নিম্ন আদালতের বিচারকদের। জানালেন এটা নাকি খুব স্বাভাবিক। ঊপঢৌকন পেয়েও বিচারকরা ফাইনাল রিপোর্টে লিখেন না। সুযোগ রেখে যান পরিবর্তী বিচারকের জন্যে। নতুন বিচারক আসেন এবং ফাইল ঘেটে বের করেন আয়-রোজগারের নতুন টার্গেট।

কাহিনীর বাকিটা শেয়ার না করলেই ভাল। বিচারক নামের এসব বেজন্মা কুকুরদের মুখে আহার তুলে দেয়ার কাহিনীতে গৌরবের কিছু নাই। আছে ব্যর্থতার থোকা থোকা গ্লানি। আছে বাংলাদেশ নামের একটা নষ্ট দেশে জন্ম নেয়ার কষ্ট।

নুসরাত হত্যা মামলার ১৬ আসামীর সবাইকে ফাঁসির রায় দিয়েছেন নিম্ন আদালতের বিচারক। এবং জাতি এ নিয়ে স্বস্তির উল্লাস করছে। এ রায় যে স্রেফ একটা কৌতুক ও তামাশা তা অনুধাবন করতে কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। এ রায় আবেগের রায়। রাষ্ট্রযন্ত্রের মালেকানকে খুশি করার রায়। বিচারক সাহেব ভাল করেই জানেন উপরওয়ালাকে এ মুহূর্তে খুশি করতে ১৬ জনের ফাঁসির কোন বিকল্প নেই। তিনি খুশি তো জাতি খুশি। জাতি খুশি তো তেনার চাকরির প্রমোশন নিশ্চিত।

যে দেশের গোটা বিচার ব্যবস্থা একজনের মনোরঞ্জের জন্যে কাজ করে থাকে, তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করার অবশিষ্ট কিছু থাকেনা। এই ১৬ জনের রায়ও গানের স্বরলিপির মত কাজ করবে। মামলা যাবে উচ্চ আদালতে। ওখানেও চাতক পাখীর মত অপেক্ষায় থাকবে একদল বুভুক্ষ কুকুর। ওরাও রায় দেবে নেত্রীর মনোরঞ্জনের জন্যে। ততদিনে নুসরাত ট্রাজেডি হজম হয়ে যাবে জাতির উদরে। ২/১ জন ছিচকে আসামীর রায় বহাল রেখে বাকি সবাইকে খালাস দেয়া যাবে। আর যাদের ফাঁসি বহাল থাকবে তারা আওয়ামী লাইসেন্সে মোমেনশাহীর শাহী দাস আব্দুল হামিদের বদৌলতে ব্যান্ড বাজিয়ে বেরিয়ে আসবে কয়েদখানা হতে।

যে রাস্ট্র নিজে তার নাগরিকদের রাতের অন্ধকারে বিনা বিচারে মার্ডার করে পার পেয়ে যায়, সেখানে একজন নুসরাত অপরাধের মহাসাগরে একটা পুটিমাছ মাত্র। অনেকটা পুতুল নাচের মত এই পুটিমাছ নিয়েও আমরা নাচ দেখছি। যারা উপভোগ করছেন তাদের সবাইকে প্রাণঢালা অভিনন্দন।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন