ক্যরাবিয়ান বেলাভূমি...কার্তাখেনা দ্যা ইন্ডিয়াস!

Submitted by WatchDog on Saturday, November 17, 2018

অদ্ভুত সুন্দর একটা সকাল। চারদিকে বসন্তের মৌ মৌ গন্ধ। জানালার বাইরে উদ্দাম উচ্ছল ক্যারিবিয়ান সাগর। এর বিশাল বিশাল ঢেউ তীরে এসে আছড়ে পরছে অনেকটা লজ্জাবতী বধূর মত। দু'দিন হল এখানটায় এসেছি। বসন্তের এ সময়টায় পর্যটকদের ভিড়ে গিজ গিজ করে শহরের পথঘাট। কার্তাখেনা দ্যা ইন্ডিয়াস। ক্যরাবিয়ান সাগরের বুক ঘেঁষে কলোম্বিয়ার একটা শহর। রাজধানী বগোটা হতে প্রায় দেড়-ঘণ্টার ফ্লাইট। অবশ্য আমরা এসেছি অন্য পথে। সান্তা মার্তা হতে শুরুকরে বারাংকিয়া হয়ে বাসে করে এখানে আসতে প্রায় একটা দিন চলে গেল। মাঝখানে বারাংকিয়া শহরে ঘণ্টা দুয়েকের বিরতি ছিল অনেকটা অপ্রত্যাশিত। সাঁটল জার্নির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাস কোম্পানি টিকেট বিক্রি করলেও বারাংকিয়ায় এসে নামিয়ে দিল। এর পরের অংশ নাকি আমাদের নিজ দায়িত্বে যেতে হবে। অবশ্য এ নিয়ে অভিযোগ করার কিছু ছিলনা। নিউ ইয়র্কের কর্মক্ষেত্রের কলিগ নরমা লপেজের বাড়ি এ শহরে। অনেক গল্প শুনেছি তার মুখে। কলোম্বিয়ান গায়িকা সাকিরারও জন্ম এখানে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে জয়ী কলোম্বিয়ান বিশ্ব-সুন্দরীদের অনেকের জন্ম এদিকটায়। বিশাল বিশাল অট্টালিকায় ছেয়ে আছে শহর। জনস্রোত আর ট্রাফিক স্রোতে জমজমাট শহরের অলিগলি। তবে কোথায় যেন কিছু একটার অভাব কান আর চোখ খোলা রাখলে সহজেই ধরা পরবে। আভিজাত্যের টানপোড়ন! শহরের ঢোকার মুখেই দেখলাম খোলা শৌচাগার। মানুষ নির্লিপ্ত হয়ে মল-মূত্র ত্যাগ করছে যত্রতত্র।

বেলা গড়িয়ে যাচ্ছিল কার্তাখেনায় যখন বাসটা এসে থামল। বাস-স্ট্যান্ডেই মেলল হোটেল দালালের। একাধারে সে ক্যাব চালকও। শেষবার এমন দালালের খপ্পরে পরেছিলাম সেই ভারতের পূরীতে। ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাদের যে হোটেলে এনে নামিয়ে দিল তাতে না ছিল পরিচ্ছন্নতা, না আতিথেয়তার নাম গন্ধ। ঝাঁকে ঝাঁকে টুরিস্ট এসে ঠাঁই নিচ্ছে হোটেলটায়। নাম মাত্র মূল্যে রাত কাটানোর উত্তম ব্যবস্থা। প্রথম রাতটা কাটাতে অন্যকোথাও যাওয়ার মত ধৈর্য ছিলনা। তাই লম্বা একটা গোসল দিয়ে ঠাঁই নিলাম বিছানায়। বিশ্রাম।

ঘুম ভাঙ্গল সেই রাত ১০টায়। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতে শিহরণ বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। সমুদ্র আর জ্যোৎস্নার প্লাবনে ভেসে গেছে বাইরের পৃথিবী। সময়টা ঘরে থাকার নয়। চুম্বকের মত টানছে রাতের শহর। হোটেল ক্যাফেটেরিয়াতে রাতের খাবার সেরে নিলাম। পইয়ো লা ব্রাসা সাথে ফ্রাইড পটেটো। কফির কাপে শেষ চুমুক দেয়ার সাথে সারাদিনের ক্লান্তি যেন ভোজবাজির মত উবে গেল। বেরিয়ে পরলাম নৈশ অভিযানে।

কার্তাখেনা দ্যা ইন্ডিয়াসে আসার পেছনে আমার ব্যক্তিগত একটা কারণ ছিল, যা গিন্নীর সাথেও শেয়ার করিনি। বিশ্বখ্যাত কলোম্বিয়ান লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে কাছ হতে দেখা। ফেওদর দস্তায়ভস্কির পর দ্বিতীয় কোন লেখকের লেখায় মাতাল হব তা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। কিন্তু রুশ দেশে ছাত্রজীবনের রুমমেট আন্দ্রেই সুশ্যেনিয়া যেদিন লেখকের 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিট্যুড' বইটা ধরিয়ে দিল সেদিন হতেই শুরু এ অবশেশন। এরপর আর পিছু তাকাতে হয়নি। রুশ ভাষায় অনুবাদ করা আধা ভৌতিক বইটা শেষ করতে বেশ ক'দিন লেগে গিয়েছিল। পড়তে গিয়ে দুদিন ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে তাও খেয়াল করিনি।

হোটেলের বাইরেই অপেক্ষা করছিল টমটম গুলো। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে শহর দেখার ইচ্ছাটা অনেকদিনের। ধারণাটা ক্লাসিক ছায়াছবি আর রুশ লেখকদের লেখনী হতে নেয়া। সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না এ যাত্রায়। দরদাম না করেই চড়ে বসলাম গাড়িটায়। শুরু করলাম উনবিংশ শতাব্দীতে ফিরে যাওয়ার জার্নি। পুরানো শহরের একটা জায়গায় আসতে অসংখ্য মানুষের ভীর দেখে নেমে পরলাম। সন্দেহ হল কিছু একটা ঘটছে এখানে। আসলেই তাই। নিভু নিভু নিয়ন বাতি, ক্যামেরা, লাইট, ম্যাক-আপ ...শুটিং হচ্ছে। পুলিশি বাধা পেরিয়ে আমরাও মিশে গেলাম বিশাল আয়োজনে। যেন তেন মুভি নয়, প্রিয় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়ার অমর উপন্যাস 'লাভ ইন দ্যা টাইম অব কলেরা' অবলম্বনে নির্মিত হচ্ছে এ মুভি। শিহরিত হলাম, নিজকে ভাগ্যবান মনে করলাম। অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিলাম এখানে। রাত ৩টার দিকে টমটম-ওয়ালা তাগাদা দিল বাকি ভ্রমণটা সেরে ফেলতে।

মাথার উপর রূপালী চাঁদ আর অপরূপ জোৎস্নাভরা সে রাত কোথাও থেমে থাকেনি। সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে ঘোড়ার খট খট আওয়াজ নীরবতা ভঙ্গের কোন কারণ হয়নি। কারণ তখনও শত শত মানুষ সমুদ্রের কোল-জুড়ে কিলবিল করছে। ছোট ছোট তাঁবু গেড়ে অনেকে শোয়ার আয়োজন করছে। B-B-Q'র ধোঁয়া আর গন্ধ যেন রাত-যৌবনেরই জয়গান গাইছে। একহাতে গীটার আর অন্যহাতে লাল-নীল পানির গ্লাস নিয়ে বাঁধভাঙ্গা যৌবন উপভোগ করছে নিশাচরের দল। আমরাও নেমে যোগ দিলাম কিছুক্ষণের জন্যে। এতরাতেও শহরের শুঁড়িখানার একটাও বন্ধ হতে দেখলাম না। পতিতারা ঘুরে বেড়াচ্ছে খদ্দেরের খোজে। বোধহয় জোয়ারের সময় ছিল ওটা। হঠাৎ করেই ফুঁসে উঠল ক্যারিবিয়ান সাগর। হিস হিস শব্দে ঢেউ এসে আছড়ে পরল তীরে। এবার ঘরে ফেরার পালা।

আগামী পর্বে সমাপ্য।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন