স্বপ্নের কালো বিড়াল ও একজন প্রবাসীর দেশে ফেরা

Submitted by WatchDog on Sunday, April 29, 2012

Bangladesh

সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল বয়সের কাছে যেদিন পরাজিত হব ফিরে যাব নিজ দেশে। একখণ্ড জমি আর এক জোড়া গরু পুজি করে জীবনের শেষ যুদ্ধটা শুরু করব মা আর মাটিকে ঘিরে। অনেকদিন হয়ে গেল ঘর ছেড়েছি। ইউরোপে ১২ বছর, অষ্ট্রেলিয়ায় ৫ আর আর যুক্তরাষ্ট্রে ১২, বলতে গেলে ২৯ বছর ধরেই স্বপ্নটা লালন করে চলছি। কিন্তু হঠাৎ করেই সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো মনে হচ্ছে। হিসাব কশতে গিয়ে বুঝতে পারছি ছন্দপতন হয়ে গেছে জীবনের। প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গে অজানা আশংকায়। ফোনটাকেই আজকাল বেশি ভয়। অসময়ে বেজে উঠলে মনে হয় এই বুঝি খবরটা এলো। সাথে শুরু হয় হূৎপিণ্ডের দাপাদাপি। মা বাবা বেচে নেই অনেকদিন। আপন বলতে একগাদা ভাইবোন আর তাদের সন্তানাদি। জীবন নিয়ে আমাদের কারও কোন অভিযোগ ছিলনা। যে যার মত চেষ্টা করে নির্দিষ্ট কোন বন্দরে গেছি, যেখানে সততা, পরিশ্রম আর পারস্পরিক সম্মানবোধ পাথেয় হিসাবে কাজ করে গেছে। চাহিদা আর প্রাপ্তি নিয়েও আমাদের তেমন আক্ষেপ ছিলনা। কিন্তু একই ভাই-বোনদের কাউকে যখন নিজের অক্ষমতা আর ব্যর্থতার কাহিনী বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুনি বুকটা ভেঙ্গে যায়, নিজের অক্ষমতাকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করে। কেন জানি মনে হয় আমি থাকলে হয়ত এমনটা হতো না। ব্যাপারটা আসলেই কি তাই!

স্কুলে পড়ি তখন। আমাদের ছোট্ট থানা শহরটার পাশ দিয়ে তৈরী হচ্ছে রেললাইন। জনমনে এ নিয়ে ব্যাপক উদ্দীপনা। গ্রাম গঞ্জের মানুষ স্বপ্ন দেখছে হেটে নয়, ট্রেনে চড়ে বাবুর হাট যাচ্ছে এবং দিনান্তে অবিক্রীত পণ্য নিয়ে আবার ট্রেনেই ফিরে আসছে নিজ ঘরে। মাঝে মধ্যে ইস্কুল কামাই করে আমরাও চলে যেতাম নির্মান কাজ দেখতে। ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে দেখতাম একটার পর একটা ট্রাক থামছে আর মাটি ফেলে ভরাট করছে ধানী জমি সহ খাল বিল। বেশ কয়েক বছর ধরে চলল কাজ এবং একদিন সরকার নিজেই ঘোষনা দিল ট্রেন আসছে এ পথে। হঠাৎ করেই ঘটল ঘটনাটা। স্বপ্ন পু্রণে সহসাই ছেদ পরল যেন। বর্ষা কেবল আসি আসি করছে সে বছর। অবিরাম বৃষ্টির কারণে ডুবে গেছে শহরতলীর ডোবা নালা। রেল লাইনের প্রয়োজনে মাটি কাটায় সৃষ্টি হওয়া নতুন খালটায় পাওয়া গেল লাশটা। তাও আবার মস্তক বিহীন। চারদিকে দাবানলের মত ছড়িয়ে পরল খবরটা। ভীত মা বাবাদের কারণ ছুটি ঘোষনা করতে বাধ্য হল ইস্কুল কর্তৃপক্ষ। গোট শহর জুড়ে রাজত্ব করতে শুরু করল ভয়, ভীতি আর আতংক। মাথা বিহীন উপুর হয়ে ভাসতে থাকা লাশটা দেখে আমার মত অনেকেই সে বছর ভাল করে ঘুমাতে পারেনি। সদ্য তৈরী রেল লাইনে ঢল নামে মানুষের। দূর দুরান্ত হতে অনেকে মহিলাদের পালকি চড়ে পর্যন্ত আসতে দেখেছি। বোরকা পরে মা নিজেও দেখতে গিয়েছিলেন ভয়াবহ এ দৃশ্য। কেবল তারপরই জারী করেছিলেন ’ফতোয়া’, অবৈধ দখল নিয়ে অন্যের জমিতে তৈরী রেললাইনের কারণে খোদ সৃষ্টিকর্তা নাজিল করেছেন এ গজব।

মাস দুয়েক আগে একই জায়গাতে পাওয়া গেল একটা নয়, একে একে ছয়টা লাশ। গোপনে খুন করে কেউ ফেলে যায়নি, বরং রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয় তাদের। তাও আবার জনসম্মুখে। অপরাধ, কথিত ৪০ হাজার টাকার চাঁদাবাজী। গুলিতে ঝাঝরা হয়ে যাওয়া লাশ গুলোর জন্যে কেউ দুফোঁটা চোখের পানি অথবা ভয়ে এক রাতের ঘুম হারাম করেছে এমনটা শোনা যায়নি। বরং অনেককেই শুনেছি বাহাবা দিতে এবং সঠিক রাষ্ট্র পরিচালনায় ’সঠিক’ সিদ্ধান্ত নেয়ায় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাতে। লাভ হয়না বলে সরকার অনেক আগেই উঠিয়ে নিয়েছে রেললাইন। সে পথে এখন হরেক রকম যানবাহনের চলাচল। সাইকেল, রিক্সা, নসিমন, করিমন ও এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের আলিশান গাড়ি সহ বাহারি অনেক গাড়ি। বদলে গেছে লোকালয়। সাথে বদলে গেছে মানুষের পরিচয়। মানুষ আর আগের মত কেবল মানুষ নয়, এখন সে আওয়ামী মানুষ অথবা বিএনপির মানুষ। খুনের বধ্যভূমিতে পরিনত হয়েছে এক কালের সে রেললাইন। কুরবানির রক্ত শুকোবার আগেই ওখানে ঝরছে নতুন নতুন রক্ত। কেবল মাথা নয়, লাশের সাথে পাওয়া যাচ্ছে না হাত-পা, নাড়ি-ভুরি অথবা গোপনাঙ্গ। পালকি দুরে থাক, পাশ দিয়ে হেটে গিয়েও অনেক ফিরে তাকায় না এসব লাশের দিকে। আর সে লাশ যদি হয় রাজনৈতিক লাশ মুখে থুথু ফেলতেও দ্বিধা করেনা প্রতিপক্ষ।

ইলিয়াস আলী উপাখ্যান নিয়ে দেশ প্রায় অচল। একই কারণে ইতিমধ্যে খুন হয়ে গেছে ডজন খানেক। বিশ্বনাথ নামের সিলেটি এলাকা এখন বিরানভূমি। দেশ জুড়ে রাজত্ব করছে আতংক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে গোটা দেশই এখন একটা রেললাইন যেখানে লাশ পরছে অনেকটা বৃষ্টির মত। রাষ্ট্রের জিম্মায় সৃষ্ট খুন প্রকল্প এখন কাজের বিনিময়ে খাদ্যের মত ছড়িয়ে পরছে টেকনাফ হতে তেতুলিয়া। টাকার বিনিময়ে চাইলে ভাড়া করা যায় আইন রক্ষাকারী বাহিনী এবং তাদের দিয়ে খুন করানো যায় যাকে মন চায়। কাউকে টাকা ধার দিয়েছি এবং সে টাকা ফেরৎ পাচ্ছি না, এর সমাধানের জন্যে এখন আর আদালতে যেতে হয়না, বরং অতিরিক্ত কিছু খরচ করে পুলিশ র‌্যাব ভাড়া করলেই পাওয়া যায় কাঙ্খিত ফল। সঙ্গত কারণেই মহামারীর রূপ নিচ্ছে এ ব্যবসা। টাকার বস্তা নিয়ে ধরা পরেন মন্ত্রী আর গুম হয় তার ড্রাইভার। একই ড্রাইভার যার কারণে জাতি দেখতে পেল ক্ষমতার কালো বিড়ালের কলংকিত চেহারা। ইলিয়াস আলী গুমের প্রত্যক্ষদর্শী কথা বললো মিডিয়ার সাথে এবং পরদিন সে নিজে গুম। সাগর-রুনী হত্যা পর্বের যারাই কাছাকাছি এসেছে তাদের অনেকেই আজ নিখোঁজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস যাদের জানা আছে তাদের হয়ত বুঝতে সুবিধা হবে গেস্টাপো বাহিনীর সংজ্ঞা। ওরাও আসত রাতের আধারে এবং মুখ কাপড় আটকে উঠিয়ে নিত। যাদের ধরে আনা হত তাদের সবাই কোন চিহ্ন ছাড়াই পৃথিবী হতে মিলিয়ে যেত ভুতের মত। ইসরাইলের মোসাদের শিক্ষাটা বোধহয় গেস্টাপো হতেই নেয়া। হিটলারের উদ্দেশ্য যদি উগ্র জাতীয়তাবাদের ছত্র ছায়ায় ব্লু কালার সাদাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে থাকে মোসাদের উদ্দেশ্য আরব ভূমিতে নিজেদের অন্যায় অধিকার নিশ্চিত করা। যৌক্তিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, তাহলে আমাদের উদ্দেশ্যটা কি? কি জন্যে এই গুম? কার স্বার্থে এই গুপ্তহত্যা? ক্ষমতার মসনদের প্রতি বিশেষ দুই পরিবারের দাবি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার জন্যেই কি এসব নয়? স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এটাই কি আমাদের একমাত্র চাওয়া পাওয়া হয়ে দাঁড়ায়নি? পাকিস্তানী ২২ পরিবারের খপ্পর হয়ে বেরিয়ে বাংলাদেশি দুই পরিবারের খপ্পরে আটকে যাওয়ার জন্যেই কি ছিল ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ? দেশ শাসনের নামে আজকে যা হচ্ছে তাকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের কোন সংজ্ঞায় বৈধতা দেয়া সম্ভব নয়, কারণ আমরা যে স্বাধীনতার কথা বলছি তা দুই পরিবারের স্বাধীনতা, জাতীয় স্বাধীনতা নয়।

আর কতদিন অপেক্ষা করলে আমাদের স্বপ্ন গুলো আলোর মুখ দেখবে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনার সময় কি হয়নি? আমাদের সবার স্বপ্নই কিন্তু রাতারাতি ৭০ লাখ কামানোর স্বপ্ন নয়, এ স্বপ্ন দুবেলা দুমুঠো আহারের স্বপ্ন, ছোট্ট একটা চাকরির স্বপ্ন, মাথার উপর যেনতেন একটা ছাদের স্বপ্ন। আর আমার মত প্রবাসী যাদের টাকায় অর্থনীতির চাকা ঘুরে, বেলা শেষে ঘরে ফেরার স্বপ্ন। এগুলো কি খুবই বড় স্বপ্ন? রেলের বগিতে জন্ম নেয়া কালো বিড়াল ধরার স্বপ্ন?

ভালো লাগলে শেয়ার করুন