আয়নাল হাজির ঈদ ও একটি লাল গরু...

Submitted by WatchDog on Monday, November 7, 2011

Eid-ul-Azha

মসজিদ হতে সোজা বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল আয়নাল হাজী। মনটা ভাল নাই তার। নামাজেও মন দিতে পারছে না ইদানিং। ঘরে বাইরে কেবল ঝামেলা আর ঝামেলা। কোনটা রেখে কোনটার রাশ ধরবে কুল কিনারা করতে কষ্ট হচ্ছে। উত্তর চকের জমিতে সার দেয়া দরকার। চেয়ারম্যানকে টাকা দিয়েছে আজ প্রায় দুই মাস, অথচ সারের কথা জিজ্ঞাস করলে বলে আল্লা আল্লা কর। ছোট বিবি সাত মাসের পোয়াতি। ডাক্তার দেখানোর সময় হয়েছে। অথচ গঞ্জের মুশফিক ডাক্তার বিবির পছন্দ না। সে নাকি কেমন কেমন করে তাকায় আর বিনা দরকারে গায়ে গতরে হাত দেয়। চেয়ারম্যানের ছেলে মুশফিক যেদিন গঞ্জে ডাক্তারী করার ঘোষনা দেয় বেদে পাড়ার হিজরা ভাড়া করেছিল তার বাবা। সামনে পিছে ডজন খানেক হিজরা আর মাঝখানে আধমরা একটা হাতিতে ডাক্তারকে চড়িয়ে গোটা অঞ্চল তোলপাড় করছিল চেয়ারম্যানের লাঠিয়াল বাহিনী।

পাকিস্তানী ডিগ্রী নিয়ে হরিহরগঞ্জের মত দুর্গম এলাকায় কেন ডাক্তারী করতে এলো মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল এ নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেন। তিনি বলেন, পেশোয়ারের কোন এক বিধবা তার পুরুষাঙ্গ কেটে বাজারে কাবাব বানিয়ে বিক্রি করেছে। তার হাতে নাকি প্রমান আছে। পাকিস্তানের সাথে প্রিন্সিপালের গোপন দহরম মহরম। অনেকে বলে প্রিন্সিপালের সাথে খোদ ওসামা বিন লাদেনের খাতির ছিল। পাকিস্তান প্রসঙ্গ এলে তার কথা সহজে কেউ উড়িয়ে দেয় না। দয়াগঞ্জেও ডাক্তারের নামে মামলা ঝুলছে গোটা দশেক। ছোট বিবির এক কথা, ’মইরা যামু কিন্তু এই বেশরমা ডাক্তারের কাছে যামু না’। গঞ্জে যাওয়ার মত যথেষ্ট সময় নেই আয়নালের হাতে। এদিকে বড় ছেলে খবর পাঠাচ্ছে, ছোট নাতির বিয়ে। না গেলে চলবে না। ৩৫ বছরের ছোট মেয়েটা পাঁচ পাঁচটা নাবালক সন্তান ফেলে ১৮ বছর বয়সী কামলার হাত ধরে পালিয়েছে এক মাস হয়ে গেল। এই নিয়ে হরিহরগঞ্জের ঘরে ঘরে ফিসফাস, ঢুসঢাস। তিন বিবির কোন বিবি পাঁচটা দুরে থাক একটারও দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছেনা। তিন ঘরেই এ নিয়ে উত্তেজনা। এতিম গুলোর ভবিষ্যৎ ভেবে চতুর্থ বিবি ঘরে আনার চিন্তাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তার। সব ফেলে তারাকান্দির ওলাউঠা পীরের মুরিদ হওয়ার পুরানো চিন্তাটাও যোগ হয়েছে ইচ্ছার তালিকায়।

আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে এসে গেছে খেয়াল করেনি আয়নাল হাজি। এখান হতে দশ ক্রোশ হাঁটলেই উত্তর চক। পাম্পের ঘরটা পরখ করার তাগাদা অনুভব করল। গেল অমাবস্যায় ডিপটিউবওয়েলের মাথাটা চুরি গেছে। নতুন করে পাহারাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু তাতে দুঃশ্চিন্তা কমা দুরে থাক বেড়েই চলছে। চুরির হিড়িক পরে গেছে চারদিকে। আকাশের দিকে তাকালো আয়নাল। পূব দিকে আলো আধারের খেলাটা শুরু হতে এখনও অনেক বাকি। শেষ বারের মত তাকাল ঐ দিকটায়। বাড়ি যাওয়ার আগে উওর চকটা ঘুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঐদিকে পা বাড়াল।

'আসসালামুয়ালাইকুম হাজী সাব’
অচানক লম্বা সালামে চমকে উঠল আয়নাল হাজী। মুখ তুলে সালামের উত্তর দিল। কাজী বাড়ির কামলা আপ্তরদ্দি হাল নিয়ে মাঠে যাচ্ছে। আগ বাড়িয়ে কেউ সালাম দিলে খুব ভাল লাগে তার। নিজেকে নামি দামি মনে হয়। মেম্বার চেয়ারম্যান হওয়ার খায়েশ জাগে। সুবেহ সাদিকের সুরেলা বাতাস সর্বাঙ্গ ঝাপটে ধরতে মনটা হাল্কা হয়ে গেল। শীতের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে বাতাসে। খেজুর গাছে কলসি বাধার সময় হয়ছে, কথাটা মনে হতে যৌবনের দাপাদাপি অনুভব করল রক্তে। আজ আর মন খারাপ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করল।

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ঘটল ঘটনাটা। এ নিয়ে দ্বিতীয় বার। প্রথমবার ঘটেছিল কোরবানীর হাটে। ঐদিন পাত্তা দেয়নি, ভেবেছিল ওটা মনের দুর্বলতা, কেটে যাবে সময়ের সাথে। কিন্তু কাটেনি।

হাটের সেরা গরুটা কিনতেই অভ্যস্ত সে। এমনটাই হয়ে আসছে গেল ২০ বছর। এ যাত্রায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। হাটে পা দেয়ার সাথে মাথাটা কেমন ঝিম মেরে উঠে তার। স্বাভাবিকের চাইতে দশগুণ আওয়াজে দিশেহারা হায়ে যায়। এমনটা কেন হচ্ছে আন্দাজ করতে কষ্ট হল। ক্রেতার তেমন সমাগম হয়নি যার কারণে এত সোরগোল হতে পারে। অথচ হাজির কানে অস্বাভাবিক সব শব্দ আসছ...ফিসফাস... ফিসফাস। কারা যেন বাতাসে কথা বলছে, কানে শোনা যায় অথচ চোখে দেখা যায়না। মোটাতাজা পছন্দের গরুটার সামনে দাঁড়াতেই ছুরির মত উড়ে এলো প্রশ্নটা, ’কেমন আছ চোরের ব্যাটা?’ মনে হল বাম পাঁজরে ছুরি ঢুকিয়েছে কেউ। তার বাবা চোর ছিল ইহজগতের কারও জানার কথা নয়। ব্যবস্থা করেই সে হরিহরগঞ্জে পা রেখেছিল। ভোঁ ভোঁ করে চোখ ঘুরাল চতুর্দিকে। পুরানো কারও চেহারা চেনার চেষ্টা করল। না, তেমন কাউকে দেখতে পেল না। আবারও ভেসে এলো প্রশ্নটা। প্রশ্নকর্তাকে সামনে পেয়ে কোটর হতে বেরিয়ে আসতে চাইল চোখ দুটো। নিজের চোখ ও কানকে বিশ্বাস করাতে কষ্ট হল। মোটা তাজা, চকচকে শিংওয়ালা লাল গরুটা প্রশ্ন করছে। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে নেতিয়ে পরল আয়নাল হাজির ছোটখাট শরীর।

আজ না ঈদ! মনে হতে কেঁপে উঠল আয়নাল হাজির অন্তরাত্মা। এখানে সে কি করছে? ঈদের সকালে আপ্তরদ্দিই বা মাঠে যাচ্ছে কেন? আজ তো কারও কাজে যাওয়ার কথা না। নিজের শরীরে চিমটি কাটল। না, সে স্বপ্ন দেখছে না, মরেওনি। কিন্তু কোথায় যেন কি একটা গোলমাল হচ্ছে, যা বুঝতে তার কষ্ট হচ্ছে।

’কেমন আছ হাজী?’ দুহাত দুরে দাঁড়ানো কোরবানীর গরুটা দেখে জমে গেল আয়নাল হাজির শরীর। কি বলতে হবে আন্দাজ করতে পারল না।
- চিনতে পারলা না আমারে? তয় তোমারে আমি ঠিকই চিনছি। খালি আমি না, যেই হাটে আমারে খরিদ করছো সেই হাটের হগলে তোমারে চিনছে। তুমি জব্বর মিয়ার ছোট ছাওয়াল আয়নাল। তোমার বাবা ছিল বিবিরকান্দি বাজারের নামকরা চোর। আর তুমি হইছ যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তান, চোরের ছাওয়াল চোর।
সবকিছু ধোঁয়াটে লাগল আয়নালের কাছে। তার মনে হল সুবেহ সাদিকের আলোটা ফিকে হয়ে আসছে বায়োস্কোপের মত। মনে হল কাট কাট মার মার শব্দে ভয়াল কিছু ধেয়ে আসছে তার দিকে। অসহায়ের মত তাকাল সবদিকে। কিন্তু গহীন অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। মাটিতে শুয়ে পরল আশ্রয়ের আশায়। উপুর হয়ে আকাশটাকে দেখার চেষ্টা করল।
-ভাবছ আমার মত অবুঝ আর বোবা গরুরে কুরবানী দিয়ে পাপের দরিয়া পাড়ি দিবা? দরিয়ার দিল এত নরম না যা রক্ত দিয়া ভরাট করবা।
- আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। চাইরবার হজ্জে গেছি। পাপ তাপ যা আছিল সব ধুইয়া ফেলছি। বিড় বিড় করে কথা গুলো বলার চেষ্টা করল আয়নাল। সব কথা বের হলনা। শেষের দিকে দলায় দলায় ফেনা বেরিয়ে এলো।
- তুমি হজ্জে গিয়া সোনা কিনছো, হেই সোনা চোরাই বাজারে বিক্রি করছো। রাইতের পর রাইত নারীর ইজ্জত লুটছ। ফালানীরে খুন করছ। তার লাশে পাত্থর বাইন্ধ্যা কালিগঙ্গায় ভাসাইয়্যা দিছ। হের পর তুমি জুমা ঘরে গেছ ফজর নামাজ পড়তে।
- আমি মসজিদ বানাইছি, মার নামে মাদ্রাসা দিছি। উপরওয়ালা সব দেখছে। তিনিই আমার স্বাক্ষী।
- আমরাও স্বাক্ষী কি কইরা তুমি মাইনসের সম্পত্তি দখল নিছ। হিন্দুর বাড়িঘরে আগুন দিছ। আবার হেই সম্পত্তির উপর মার নামে মাদ্রাসা বানাইছ। উপরওয়ালা কি আন্ধা না দেন্ধা যে তোমার পাপ দেহে নাই?
- আমি আশরাফুল মুখলুকাত, আর তুমরা হইলা ইতর, নাদান বলদ। খোদায় তো্মাগরে বানাইছে আঙ্গো সেবার লাইগ্যা। এইবার দুর হও। গোয়াইলঘরে যাও।
গগনবিদারী শব্দে কিছু একটা ভেঙে পরার আওয়াজে শিউরে উঠল আয়নাল। কড়াৎ কড়াৎ শব্দে বিদ্যুতের মিছিল শুরু হল ঊর্ধ্ব আকাশে। আলোর বন্যায় ভেসে গেল চারদিক। এবং এই আলোতেই দেখল যা দেখার।
দুই খন্ড আসমানের ঠিক মাঝখানটায় দাড়িয়ে আছেন খোদ পরোয়ারদিগার। হাতে আয়নাল পরিবারের আমলনামা। বাবাকে দেখল দাদাবাড়ির খোলা আঙ্গিনায়। হাতে কোরবানীর ধারালো ছুরি। আয়নাল মাথা নীচু করে বসে আছে ছুরির নীচে। বাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে আপেক্ষা করছেন নির্দেশের।
’ আমি প্রতিপালক বলছি। হে পেয়ারের আদম, তোমার প্রিয় সন্তানকে আমার চরণতলে নিবেদন কর। আমাকে খুশি কর। কুরবানী দাও।
জব্বার মিয়া শক্ত করে ধরল ছুরিটা। এগিয়ে নিল গর্দানের কাছাকাছি। আয়নাল সুবহানাল্লাহ সুবাহানাল্লহ রবে কাঁপতে শুরু করে দিল। ভাবল এই বুঝি নেমে এলো। কিন্তু কি ভেবে থেমে গেল জব্বার মিয়ার হাত। হয়ত অপেক্ষায় ছিল শেষ নির্দেশের। ভেবেছিল ইব্রাহিমের মতই নির্দেশ আসবে, ’তোমার বিশ্বাসে আমি অভিভূত। আয়নাল নয়, আঙ্গিনায় বাধা নাদুস নুদুস লাল গরুটা কুরবানী দিলেই আমি সন্তুষ্ট’।
এমন আদেশ আসতে দেরী হওয়ায় ক্ষণিকের জন্যে থমকে গেল জব্বর মিয়ার হাত।
’রে পাপিষ্ঠ, আমি কি হুকুম দেইনি? অপেক্ষা কেন?
সাঁই করে নেমে এ্লো ছুরিটা। ছুটন্ত ফুটবলের মত উড়ে গেল আয়নালের মস্তক। রক্তের ফোয়ারা ফিনকি দিয়ে মিশে গেল মধ্য আকাশে।

ফজরের আজানের সাথে সাথে পাওয়া গেল আয়নাল হাজির ক্ষতবিক্ষত লাশ। গোয়ালঘরের এক কোনায় অতি আদরের সাথে লাশটা আগলে বসে আছে হাট হতে কেনা কোরবানীর লাল গরুটা। শেষরাতে গরুর হাম্বা রব আর দাপাদাপিতে অনেকেরই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু গোয়ালঘরে যাওয়ার তাগাদা অনুভব করেনি কেউ। প্রিন্সিপাল সাহেব আগেই বলে দিয়েছেন, নাদান হলেও ওরা বুঝতে পারে মৃত্যুর আগমন। সুবেহ সাদিকের আগেই আজরাইল আলাইসাল্লামের সাথে ওদের মোরাকাবা হয়। ঐ সময় তাদের বিরক্ত করতে নেই, তাতে পাপ হয়, খোদার আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠে।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন