একজন দেশপশারিনী এবং সমসাময়িক দুবাই সংকট...

Submitted by WatchDog on Saturday, November 28, 2009

Dubai Crisis

’ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ প্যালেষ্টাইনী জংগী সংগঠন ’ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ ধাচের কোন রাজনৈতিক অথবা সামরিক সংগঠন নয়, এ নেহাতই একটা শুক্রবার যা মার্কিন মুলুকে ক্রিসমাস শপিং শুরুর দিন হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। নিত্য ব্যবহার্য্য জিনিষপত্রের অভাবিত মূল্যহ্রাস দিনটার অন্যতম আকর্ষন। লাখ লাখ ক্রেতা সূর্য্য উঠার আগেই উৎসব আমাজে ভীড় জমায় নামী দামী ষ্টোর গুলোর দুয়ারে। ’আগে এলে আগে পাওয়া যাবে’ এ সূযোগ নিতে অনেকে আবার তাবু খাটিয়ে সাড়া রাত অপেক্ষা করতেও দ্বিধা করেনা। ভোর ৩/৪ টা হতে শুরু হয় এ পাগলামী। ৯ বছর ধরে আছি এ দেশে, প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে এ ধরনের পাগলামীতে যোগ দেয়ার তাগাদা কোন কালেই অনুভব করিনি। কিন্তূ এবার যেতে হল গৃহিনীর কারণে। সকাল ৪টায় বের হয়ে প্রয়োজনীয় কেনাকাটি শেষে বাসায় ফিরতে ৯টা বেজে গেল। ত্যাক্ত, বিরক্ত এবং পরিশ্রান্ত হয়ে মন এমনিতেই ছিল তিরিক্ষ, তার উপর বাসায় ফিরে ওয়াল ষ্ট্রীটের অবস্থা দেখে মাথার উপর আকাশ ভেঙে পরল যেন। ষ্টক মার্কেটে রক্ত গংগা বইছে আবারও। দিন শেষে আমার পোর্টফোলিও হতে বেশ ক’হাজার ডলার হাওয়া হয়ে গেল। প্রায় প্রতিদিনই ঘট্‌ছে দরপতনের এ হূদয়বিদারক ঘটনা। তবে গতকালের দরপতনের উপলক্ষটা ছিল একটু অন্যরকম এবং এক কথায় চমকপ্রদ; সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যতম সম্পদশালী দেশ দুবাই তার ৬০ বিলিয়ন ডলার দেনা শোধের জন্যে অতিরিক্ত সময় চাইছে!

পর্ব-১

আবুধাবী হয়ে এমিরেটেস্‌’এর ফ্লাইটে নিউ ইয়র্ক ফিরছি। ঢাকা হতে ছেড়ে আসা বিমানটা বদলে লন্ডনগামী ফ্লাইটে উঠতেই চোখ জুড়িয়ে গেল, বিমান তো নয় যেন ফুটবল খেলার মাঠ। নিজের সীট্‌টা খুঁজে নিয়ে লম্বা একটা জার্নির আয়োজন শেষ করতেই পাশের সীটের সহযাত্রী আকাশ ফুড়ে হাজির হল। মনে মনে দোয়া করছিলাম সীটটা যেন খালি থাকে যাতে করে রাতটা ঘুমিয়ে কাটানো যায়। মধ্য বয়সী এক মহিলা, পরনে বিপদজনক মিনি স্কার্ট এবং শরীরের সর্বাংগে হরেক রকম গহনা, প্রথম দৃষ্টিতে ভারতীয় বলেই মনে হল। কিছুটা সময় পার হতে নিজেই জানাল ইয়েমেনে জন্ম এবং স্থায়ী নিবাস যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অংগরাজ্যের শিকাগো শহরে। পারফিউমের উৎকট গন্ধে বোয়িং ৭৪৭’এর সবটাই যেন নিমজ্জিত হয়ে গেল, রাতের ঘুম নিয়ে বেশ একটু চিন্তায় পরে গেলাম। লম্বা সময় পাশাপাশি কাটাতে হবে তাই কথা না বলে উপায় ছিলনা। কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম আমার সহযাত্রী অসম্ভব বাচাল, কথা না বলে একটা মিনিটও থাকতে পারেনা। প্রসংগক্রমে জিজ্ঞেষ করতে বাধ্য হলাম দুবাই আগমনের হেতু। বিনয়ের সাথে জানাল ব্যবসা! রাত যতই গড়াতে থাকল পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল তার মদ্যপান। মহিলার আসল পরিচয় বেরিয়ে আসতেই আমি একটু দমে গেলাম, দুবাইয়ের দেহপশারিনী! গড় গড় করে বলে গেল তার কথিত ব্যবসার খুটিনাটি। বেশ ক’বছর ধরে সফলভাবে চালিয়ে আসছিল ব্যবসা, কিন্তূ ইদানিং ভাল যাচ্ছেনা কারণ মার খাচ্ছে যৌনাবেদনময়ী রুশ প্রতিদ্বন্ধীদের কাছে। রাত যতই গড়াতে থাকল তার মুখের ভাষা ততই অশ্লীল হতে অশ্লীলতর হতে থাকল। পর্ন ছবির কায়দায় বর্ণনা করে গেল খদ্দেরদের শারীরিক ক্ষমতার ইতিবৃত্ত। ভারতীয়দের আখ্যায়িত করল কঞ্জুস এবং গায়ে মসলার গন্ধযুক্ত নিকৃষ্ট খদ্দের হিসাবে। বিমানবালা বেশ ক’বার অনুরোধ জানিয়ে গেল গলার স্বর নীচু করার জন্যে। কে শুনে কার কথা! বিরামহীন বকর বকর করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পরল এক সময়, পাশের খালি সীটে সটান হয়ে শুয়ে নাক ডাকতে সময় নিলনা বেশীক্ষন। শোয়াবস্থায় গায়ে গতরে কাপড় বলতে কিছু রইলনা, হোষ্টেজের চোখ পরতেই কম্বলে দিয়ে ঢেকে দিল তার অবিন্যস্ত শরীর। সকালে ঘুম ভাংগতে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিল রাতের মাতলামির জন্যে। লন্ডনের গ্যাটওয়ে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার আগে হাতে একটা বিজনেস কার্ড ধরিয়ে দুবাই ভ্রমনের আমন্ত্রন জানাল আমায়, সাথে দিল ডিসকাউন্ট রেটে বিনোদনের সার্বিক নিশ্চয়তা।

পর্ব-২

দুবাই! সমসাময়িক বিশ্বে এর পরিচিতি কল্পলোকের স্বপ্নপূরী হিসাবে। মরুভূমির লু হাওয়ায় প্রযুক্তির ডালিতে স্বপ্নের পরশ বুলিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই শহর। ৫০ ডিগ্রী তাপমাত্রার মরুভূমিকে আটকে দিয়ে বরফের উপর স্কী, ৭ তারা খচিত হোটেল, বিভিন্ন দেশের মানচিত্র নিয়ে সমুদ্রের উপর কৃত্তিম দ্বীপ, উচ্চতম ইমারত, কি নেই দেশটায়! দুবাইকে সে দেশের শাষকগুষ্টি কোন আদেলে গড়ে তুলতে চাইছে তারাই তা ভাল বলতে পারবে, কিন্তূ আমরা সহজ সরল বিশ্বাষপ্রবন মুসলমানরা দেখছি দেশটায় ব্যাপকহারে বিনিয়োগ হচ্ছে আফগান ড্রাগ মানি, যার মূলে রয়েছে পাকিস্তানী, ভারতীয়, আরব এবং ইসরাইলী ওয়ারলর্ডের দল। সিয়েরা লিওনের মত আফ্রিকান দেশ হতে আসছে রক্তচোষা হীরার টাকা। ভারতীয় ডন দাউদ ইব্রাহিমের মত মাফিয়া চক্রদের জন্যে দুবাই এখন অভয়ারন্য, সাথে থাকছে রুশ, ফিলিপিনো, ইন্দোনেশিয়ান, ইসরাইলী সহ বহু দেশের দেশপশারিনীর দল। কথিত আছে বাংলাদেশ সহ অনেক দেশের গৃহপারিচিকাদের জোড় করে ভোগের সামগ্রী বানিয়ে উপভোগ করছে আলখেল্লা পরিহিত আরব্য শেখের দল। হাতে তসবী আর গলায় হুইস্কীর বোতল ঝুলিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অন্ধগলিতে এই শেখদের দাপট কোন বানানো কাহিনী নয়। প্যালেষ্টানীদের দুর্দশাকে পূঁজি বানিয়ে লম্পট শেখের দল কোটি কোটি মুসলমানদের বিভ্রান্ত করছে ধর্মের নামে, উস্কে দিচ্ছে ইসরাইল এবং মার্কিনীদের বিরুদ্বে। অথচ এই ইসরাইলী এবং মার্কিনীদের সাথেই তাদের ব্যাপক ব্যবসায়িক এবং বিনিয়োগ বন্ধুত্ব। বাংলাদেশের মত গরীব দেশে হিযবুত তাহীরি, লস্করে তৈয়াবা এবং জেএমবি’র মত জংগী সংগঠন গুলোকে অর্থায়ন করে মধ্যপ্রাচ্যের চরিত্রহীন শাষকগুষ্টি ফেরেশতা সাজতে চাইছে সহজ সরল ধমর্ভীরু মুসলমানদের চোখে। অথচ এই বেজন্মার দল দারিদ্রতার সূযোগ নিয়ে আমাদের দেশ হতে অপহরন করে নিয়ে যাচ্ছে নিষ্পাপ শিশুদের, যাদের উটের জকি হিসাবে ব্যবহার করে লাশ বানিয়ে ফেরৎ পাঠাচ্ছে মা-বাবার কাছে।

পর্বহীন

এই দুবাই বেলুন কি চুপসে গেল শেষ পর্য্যন্ত? যে দেশের আমীর বাদশাদের সম্পদের উপর পৃথিবী গড়াগড়ি খায়, সে দেশ ৬০ বিলিয়ন ডলার দেনা শোধ করতে সময় চাইছে, এর অন্যকোন অর্থ থাকলেও কর্পোরেট দুনিয়ায় এর একটাই অর্থ the begging of the end! পাপ বাপকেও ছাড়েনা, লম্পট আরবদের এ সত্যটা বুঝার সময় বোধহয় সামনে অপেক্ষা করছে।

আমার ষ্টক পোর্টফোলিও হতে উবে যাক আরও কিছু অর্থ, কিন্তূ বিনিময়ে ভন্ড আরব শাষকগুষ্টির যদি ভাল একটা শিক্ষা হয় হাসি মূখে মেনে নেব এ ক্ষতি। আধা বেতন আর বিনা বেতনের শ্রমের ফসল মরুদেশের তপ্ত লু হাওয়ায় তৈরী দুবাই নামের বেহেশত্‌খানা তাসের ঘরের মত ধ্বসে পরলেও এতটুকু দুঃখ করার কোন উপলক্ষ খুঁজবনা। অনেক বাংলাদেশীর নীরব কান্না লুকিয়ে আছে দুবাই শহরের ইট-পাথরে।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন