৯/১১ এবং ফ্লোরিডার গেইনসভিল চার্চ

Submitted by WatchDog on Sunday, August 22, 2010

শক্ত হয়ে বসুন। যে বিষয়টা নিয়ে লিখতে যাচ্ছি তা খুবই সংবেদনশীল এবং হজম করতে বেশ কস্ট হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের গেইনসভিল শহরে আগামী ১১ই সেপেটম্বর এমন একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে যা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলতে বাধ্য। সে আলোড়নে বাংলাদশ সহ পৃথিবীর অনেক দেশ উদ্বেলিত হবে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। শহরের Dove World Outreach Center নামের কম্যুনিটি বেইজড্‌ চার্চ ২০০১ সালে ঘটে যাওয়া ৯/১১’র সন্ত্রাসী হামলার নবম বার্ষিকী উপলক্ষে জনসমক্ষে মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরান পুড়ানোর ঘোষনা দিয়েছে। চার্চের পাষ্টর টেরি জোনসের মতে এ ধরনের প্রতিবাদের আসল উদ্দেশ্য দেশটায় বসবাসরত মুসলমানদের ধর্মান্তরিত হওয়ার একটা সূযোগ দেয়া। বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার জন্যে এ চার্চের খ্যাতি গোটা আমেরিকা জুড়ে। সমকামিতা ও গর্ভপাতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কারণে স্থানীয়ভাবে এদের নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। আয়রনি হচ্ছে গেনসভিল শহরের মেয়র নিজেই সমকামী। গত বছর জুলাই মাসে আউট অব দ্যা ব্লুউ ‘Islam Is Of The Devil"‘ সাইন ঝুলিয়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয় এই চার্চ।

প্রশ্ন জাগতে বাধ্য ৯/১১’র সন্ত্রাসী ঘটনার ৯ম বার্ষিকীতে এসে এই চার্চ কেন এতটা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল। এর কারণ খুঁজতে আমাদের বোধহয় পিছিয়ে যেতে হবে দেশটার ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। নিকট অতীতের দাস গুষ্ঠি্র কেউ একজন এ দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন রক্ষণশীল আমেরিকা স্বপ্নেও বোধহয় কল্পনা করতে পারেনি। হাফ কালো এবং হাফ মুসলমান বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়াটাকে দেশটার কট্টর রক্ষণশীলরা নৈতিক পরাজয় হিসাবে নিয়েছে। এবং এর জন্যে দায়ী করছে হিস্পানিক এবং মুসলিম ইমিগ্রান্টদের পাশাপাশি কালো এবং যুব সম্প্রদায়কে। প্রেসিডেন্ট বুশ ক্ষমতা হতে সড়ে যাওয়ার পূর্বক্ষণে অনেকদিন ধরে ঝুলে থাকা ইমিগ্রেশন সমস্যার কম্প্রিহেনসিভ সমাধানের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রায়। এ ব্যাপারে বুশের মূল সহযোগী ছিলেন আরিজোনা অংগরাজ্যের সিনেটর এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী জন ম্যাককেইন। প্রস্তাবিত এ পলিসি বাস্তবায়িত হলে দেশটায় বসবাসরত লাখ লাখ অবৈধ অভিবাসী বৈধ হওয়ার সূযোগ পেত বিভিন্ন জরিমানা দিয়ে। নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী পরাজিত হওয়ার সাথে সাথে বদলে যায় দলটার ইমিগ্রেশন পলিসি। শুরুটা সেই আরিজোনা হতেই। অংগরাজ্যের গভর্নর এমন একটা আইন পাশ করিয়েছেন যার ছত্রছায়ায় পুলিশ রাস্তার যে কাউকে ইমিগ্রেশন স্টেটাস নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে। সড়াসড়ি না বললেও বুঝতে কারও বাকি নেই অঙ্গরাজ্যের বসবাসরত অবৈধ মেক্সিকানদের ধরপাকড় করার জন্যে এ আইন। উল্লেখ্য প্রতিরক্ষার মত ইমিগ্রেশনও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের আওতাধীন। আরিজোনার সরকার শাসনতন্ত্রের এ ধারা ভংগ করতে গিয়ে বলছে ওবামার ফেডারেল সরকার অবৈধ মেক্সিকানদের বৈধ করার পাঁয়তারা করছে। আরিজোনার এ অভিযোগের সাথে গলা মেলাচ্ছে আরও অনেক অঙ্গরাজ্য। বলতে গেলে খাঁচাবন্দী করে ফেলেছে দেশটায় লুকিয়ে থাকা ১২ মিলিয়ন অবৈধ অভিবাসীকে। নভেম্বরের ২ তারিখ এ দেশে সিনেট নির্বাচন। ডেমোক্র্যাটদের ভোটব্যাংক বলে খ্যাত হিস্পানিকদের প্রেসিডেন্ট ওবামার মুখোমুখি ঠেলে দিতে দারুন কাজ দিচ্ছে আরিজোনা তথা রিপাবলিকানদের এই কৌশল। এ মুহূর্তে ইমিগ্রেশন সমস্যায় হাত দিলে ডেমোক্র্যাটদের হয় কট্টর সাদা অথবা হিস্পানিকদের ভোট হারাতে হবে।

একই কথা বলা যায় মুসলমানদের বেলায়। ৯/১১’এ কারণে এমনিতেই মুসলমানরা কোণঠাসা এ দেশে। এমন একটা অসহনীয় অবস্থায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনস্থ প্রাক্তন টুইন টাওয়ারের অনতিদূরে ইসলামী সেন্টার নির্মানে মুসলমানদের সিদ্ধান্ত। যদিও শাসনতান্ত্রিক ভাবে নিশ্চিত করা আছে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, কিন্তু এ দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে টুইন টাওয়ারের বিপরীতে ইসলামী সেন্টার নির্মান হবে ৯/১১ ঘটনায় নিহত ৩ হাজার আত্মার প্রতি অসম্মান দেখানো। প্রেসিডেন্ট ওবামা মুসলমানদের মসজিদ নির্মানের অধিকারের পক্ষে ওকালতি করে জন্ম দিয়েছেন নতুন বিতর্কের। দেশটার সংখ্যাগুরু সাদাদের অনেকেই নতুন করে প্রশ্ন তুলছে ওবামার ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে। ব্যাপারটা এতদূর গড়িয়েছে যে সেনাবাহিনীর এক অফিসার আর্মি হতে পদত্যাগ করতে গিয়ে কারণ দেখিয়েছে বারাক ওবামা নাকি এ দেশের নাগরিক নন। একজন বিদেশী কমান্ডার-ইন-চীফের আদেশ মানতে নাকি তিনি বাধ্য নন তাই এ পদত্যাগ। একই কায়দায় ডেমোক্রেটদের ভোটব্যাংক মুসলমানদেরও ঠেলে দেয়া হচ্ছে ওবামার মুখোমুখি। সিনেট নির্বাচনে ডেমোক্রেটদলীয় ভরাডুবি ঘটাতে এ ধরনের ক্যালকুলেটিভ ষড়যন্ত্র কাঙ্খিত ফল দিচ্ছে রিপাবলিকানদের জন্যে। সর্বশেষ জনমত যাচাইয়ে দেখা গেছে ওবামার জনপ্রিয়তা এখন সর্বকালের কম এবং নভেম্বরের নির্বাচনে ডেমোক্রেটরা হারাতে যাচ্ছে সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা।

এককালের বর্ণবাদী সুপ্রিমিষ্ট গ্রুপ কুকুক্সক্লান কায়দায় এ দেশে জন্ম নিয়েছে টি-পার্টি নামের কট্টর একটা রক্ষণশীল দল। দলটা কাজ করছে রিপাবলিকান দলের ছায়াতলে, এবং এর আসল নেতা বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের প্রাক্তন গভর্নর সুন্দরী সারাহ পালিন। বলা চলে টি-পার্টি দলের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করছে ফ্লোরিডার গেইনসভিল শহরের চার্চ। টি পার্টির অনকে বলছে শুধু ম্যানহাটনে নয় আমেরিকার কোথাও মসজিদ তৈরীর অধিকার নেই মুসলমানদের। পাশাপাশি এ দেশে জন্ম নেয়া যে কোন শিশু নাগরিক হওয়ার অধিকার হরণের দাবি জানাচ্ছে দলটা। উল্লেখ্য, রিপাবলিকান নেতা জন ম্যাককেইনের জন্ম পানাময় এবং মিট রমনির মেক্সিকোতে। ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে টি-পার্টি এবং এর অঘোষিত নেত্রী সারাহ পালিন। সন্দেহ নেই তাদের লক্ষ্য ২০১২ সালের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচন। অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক রোপের্ট মোরডক এবং তার মিডিয়া সাম্রাজ্য ফক্স সড়াসড়ি ইন্ধন যোগাচ্ছে টি-পার্টির ওবামা বিরোধিতায়। উল্লেখ্য সারাহ পালিনও ফক্স চ্যানেলের রেজিস্টার্ড কনট্রিবিউটর।

সন্দেহ নেই আমেরিকান মুসলমানদের জন্যে অপেক্ষা করছে আরও খারাপ সময়। ওবামা প্রেসিডেন্সি শেষ না হওয়া পর্যন্ত হয়ত চলতে থাকবে এই বহুমুখী আক্রমণ। তবে মুসলমানদের জন্যে সবকিছুই যে ব্লিক তা বলা যাবে না। গেইসনভিল শহর কর্তৃপক্ষ চার্চের কুরান পোড়ানোর সিদ্ধান্তে বাধা দিয়েছে ফায়ার এক্টের ভায়োলেশন বিবেচনায়। আরিজোনার একতরফা ইমিগ্রেশন পলিসির বিরুদ্ধেও মামলা করেছে ওবামা সরকার। আর টুইন টাওয়ারের বিপরীতে ইসলামিক সেন্টার নির্মানে সর্মথন জানিয়েছে নিউ ইয়র্কের ইহুদি মেয়র ব্লুমবার্গ। আমেরিকান অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার থাকে আমেরিকানরাই। এমনটা হয়ে আসছে সেই ভিয়েতনাম যুদ্ধ হতে। তবে এ ক্ষেত্রে একটা বাস্তবতা উল্লেখ না করলে নিশ্চয় অন্যায় হবে। ৯/১১’র সন্ত্রাসী ঘটনার পর আমেরিকায় একটিভ শত শত মুসলিম সংগঠনের কোনোটাই উচু গলায় ৩ হজার নাগরিক হত্যার নিন্দা করেনি। এমনকি অনেক বাংলাদেশি মসজিদেও ৯/১১’র পর কথিত কাফের নাসারাদের (আমেরিকার) ধ্বংসের জন্য দোয়া করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের রাস্তা না খুঁজে এ দেশের মুসলমানরা মূলধারার আমেরিকানদের সাথে কনফ্রনটেশনে যেতে চাইছে ম্যানহাটনের মত সংবেদশীল জায়াগায় মসজিদ বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে। শাসনতন্ত্রের জন্যে মানুষ নয়, মানুষের জন্যে শাসনতন্ত্র, এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে এ দেশের মুসলমানরা, যার সাথে তাল দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের মৌলবাদী দেশগুলোর অসৎ শাসকরা। আমেরিকান শাসনতন্ত্রের ১ম সংশোধনী মুসলমানদে পক্ষে গেলেও এর প্রয়োগে খুবই রিলাক্টটেন্ট খোদ ডেমোক্রেটরা।

সামনের ৯/১১তে যে কোনভাবে কুরান পোড়ানোর ঘোসনা দিয়েছে গেনসভিলের চার্চ। এমন একটা সিদ্ধান্ত খুবই কস্ট দেবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের। পরীক্ষার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয় মানুষের যোগ্যতা ও শক্তি। আশাকরি মুসলমানরা সফলভাবে উত্তীর্ণ হবে এ পরীক্ষায়।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন