মায়া শহর, ফুড স্ট্যাম্প ও একদল বাংলাদেশি মিসফিটস্‌ অব সাইন্স

Submitted by WatchDog on Sunday, June 23, 2013

Bangladesh

তিনটা ভিন্ন খবর। তিন পত্রিকায় প্রকাশিত তিন মাত্রার খবর গুলো পড়ে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও বিমূঢ় হয়ে রইলাম। এ ধরনের খবর গ্রহ নক্ষত্র সহ সৌরজগতের অলৌকিক আয়োজনে ঈশ্বর নামের কারও বাস্তবতা নতুন করে কড়া নেড়ে যায়। সৃষ্টিকর্তা তথা পর জনম তত্ত্ব নিয়ে অনেক তর্ক করেছি, যতটুকু সম্ভব পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছি, এবং সিদ্ধান্তে এসেছি সভ্যতার ধাপে ধর্ম এবং পরজগত তত্ত্ব ছিল একটি অপরিহার্য অধ্যায়, যার আগমন ছিল অবশ্যম্ভাবী, এবং প্রয়োজন ছিল সময়ের চাহিদা। এ চাহিদা মেটাতে গিয়েই হয়ত মুনি-ঋষিরা বিশাল বহরের নিরাকার ঈশ্বর থিওরির অবতারণা করেছিলেন। সত্য হোক মিথ্যা হোক এ থিওরি সভ্যতার ধাপে ধাপে কাজে এসেছে, আসছে এবং হয়ত অনন্ত কাল ধরে আসতে থাকবে। তবে যে খবর তিনটার কথা বলতে যাচ্ছি তার ইমপ্যাক্ট সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। ভাবনার নতুন নতুন ভান্ডার সামনে দাঁড় করায়। সৌরজগতের কোন এক কক্ষপথে কেউ একজন চালকের আসনে না থাকলে এসব কি করে সম্ভব হয় তা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।

খবর ১: স্থান মেক্সিকোর রেইনফরেস্ট। মায়া সভ্যতায় গড়ে উঠা এক পিরামিড-শহরের সন্ধান পেয়েছেন আইভান স্প্রাইক নামের এক পুরাতত্ত্ববিদ। পনের বছর আগের তোলা কতগুলো ছবি হাতে আসে এই পুরোতত্ত্ববিদের। দেশটার বিজ্ঞান বিষয়ক এক কমিশন রেইনফরেস্টের সমসাময়িক স্বাস্থ্য খতিয়ে দেখতে ছবি গুলো তুলেছিল হেলিকপ্টার হতে। দেখেই খটকা লাগে আইভানের। রেইনফরেস্ট মানেই গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার গাছ যার বুক চিড়ে পথ করে নেয়াটা দুরূহ এক কাজ। প্রফেশনাল অভিজ্ঞতা না থাকলে গহীন জঙ্গলেই হতে পারে জীবনের শেষ ঠিকানা। কোন কিছুই থামাতে পারেনি আইভান ও তার দলকে। দীর্ঘ তিন সপ্তাহ ধরে দশ মাইল চলার পর দেখা মেলে মায়া শহরের। সন্ধান মেলে সম্ভাব্য ৬০০-৯০০ শতকে গড়ে উঠা পিরামিড শহরের। লাল পাথরের শহর, তাই আবিষ্কারকেরা আদর করে নাম দিয়েছে ’চাকতুন’, মানে লাল পাথর। মায়া যুগে বেড়ে উঠা অন্য এক আবিস্কার ’চিচেন ইথজা’ এখন পৃথিবীর সাত-আশ্চর্যের অন্যতম আশ্চর্য , যা নিয়ে পুরোতত্ত্ববিদগন আজ পর্যন্ত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্প্রাইকের নতুন আবিস্কার মানব সভ্যতার বিবর্তন নিয়ে নতুন বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। অনেকে বলছে এ কেবল শুরু।

খবর ২: স্থান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের কলটন সিটি। এই শহরের ২২১৫ ওয়েষ্টউড স্ট্রীটের বাসিন্দা এবং বাংলাদেশের নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুরের সন্তান মোহম্মদ ইসমাইল হোসেন ও তার স্ত্রী মায়া হোসেনকে গ্রেফতার করেছে স্থানীয় পুলিশ। অভিযোগ যেনতেন নয়, জালিয়াতির নয়া দিগন্ত আবিস্কার পূর্বক অপরাধ জগতে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন এই জুটি। স্থানীয় পুলিশ এর নাম দিয়েছে ফুড স্ট্যাম্প ফ্রড। মার্কিন ফেডারেল সরকারের ফুড স্ট্যাম্প প্রকল্প দেশটার কম ভাগ্যবানদের জন্য। স্বল্প আয়ের মার্কিনিরা যারা টেবিলে তিন বেলা খাবার যোগান দেয়ার লড়াই করেছে তাদের সহায়তা করার জন্যই এ আয়োজন। অঙ্গরাজ্যের সান বারনারডিনো শহরের বিভিন্ন রাস্তায় মোট ৫টা স্টোরের মালিক ইসমাইল হোসেন। ফুড স্ট্যাম্প নিয়ে খাদ্য ক্রয়ে গরীব মার্কিনিরা স্টোরে পা দিলেই ইসমাইল হোসেন তাদের কাছ হতে নগদ অর্থে ষ্ট্যাম্প গুলো কিনে নেয়ার প্রস্তাব করতেন। ১০০ ডলারের ষ্ট্যাম্প নগদ ৫০ ডলার বা আরও কমে ক্রয় করে তা হতে হাতিয়ে নিত বাকি ৫০ ডলার। এভাবে বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে এ জালিয়াতি। খবর চলে যায় স্থানীয় এফবিআইয়ের দপ্তরে। শুরু হয় তদন্ত। ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোর সদস্যদের কেউ কেউ নিজে গ্রাহক সেজে হাজির হন স্টোরে এবং হাতেনাতে প্রমাণ যোগাড় করতে থাকেন এই অমানবিক অপরাধের। জনাব হোসেন ও তার স্ত্রীর ব্যাংক একাউন্ট ঘাটতে গিয়ে আবিস্কার করে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য, ইতিমধ্যে লাখ লাখ ডলার পাচার হয়ে গেছে বাংলাদেশে। বিচার শেষে আগামী ২৬ আগষ্ট নির্ধারিত হবে এই দুই বাংলাদেশির ভাগ্য। অনেকে যারা বাংলাদেশিদের বহুমুখি ধান্ধাবাজির সাথে পরিচিত তারা বলছেন এ আর এমন কি, এ তো সমুদ্রে এক ফোঁটা জল মাত্র।

খবর ৩: খবরটা বিশ্বব্যাপী প্রচার পায়নি এখনো। তবে পাবে, এবং তা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমার মত অনেকেরই আশংকা বিশ্ব মিডিয়াতে ঝড় উঠাবে, বিস্ময়ের সুনামিতে থমকে যাবে সভ্যতা। স্থান দক্ষিন এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশের সাভার অঞ্চল। রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে কামড়া কামড়ি করছে দেশটার দুই বৈরী রাজনৈতিক পরিবার। এক পরিবার ক্ষমতায়, অন্যটা ক্ষমতার বাইরে। ধর্মঘট ও হরতালের বিভীষিকায় ক্ষতবিক্ষত দেশটার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এমনই এক প্রেক্ষাপটে সাভার অঞ্চলে হঠাৎ করেই ধ্বসে পরে একটি বহুতল ভবন। পোষাক সেক্টরের বেশ কটা কারখানা দিনরাত কাজ করতো এই বিল্ডিংয়ে। রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট কারখানার মালিকরা সিমেন্টের বদলে কাদামাটি দিয়ে স্কাই-স্ক্রেপ্রার বানালেও এখানে তা অপরাধ বলে গন্য হয়না। সাভারের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ভবনে পিষ্ট হয়ে ১১২৭ জন পোষাক কর্মী প্রাণ হারায়। যেহেতু ভবনের মালিক সোহেল রানা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের যোগানদাতা, তাই তাকে রক্ষা করাটা ছিল সরকারের পবিত্র দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবিস্কার করেন নতুন এক তত্ত্ব, যে তত্ত্ব এতদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত স্ট্রাকচারাল সাইন্সের মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে। মন্ত্রী আবিস্কার করেন প্রতিপক্ষ দলের কতিপয় ইনক্রেডিবল হাল্ক হাত দিয়ে নাড়া দিয়েছিল বলেই ভবনটি পরে যায় এবং সাথে নিয়ে যায় সহস্রাধিক প্রাণ। তবে খবরের গুরুত্বটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঘিরে নয়,এর মূল চরিত্র রেশমা নামের একজন পোষাক কর্মীকে নিয়ে। রাষ্ট্রকে খারিজ পূর্বক পারিবারিক সম্পত্তি বানাতে গিয়ে সরকারকে এমন কিছু পৈশাচিক কাজ করতে হচ্ছে যা দেশে বিদেশে প্রচন্ড আলোড়ণ তুলছে। তার অন্যতম মধ্যরাতে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে আলো নিভিয়ে একদল নিরস্ত্র প্রতিবাদকারীকে পশুর মত হত্যা করা। সরকারের এ কাজে লেলিয়ে দেয় পুলিশ, পুলিশের কিলিং মেশিন এলিট ফোর্স র‌্যাব, বর্ডার গার্ড, আর্মড ছাত্রলীগ সহ সরকারের বেশ কটা প্রাইভেট বাহিনী। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে কেঁপে উঠে রাজধানী। চারদিক ঘেরাও করে কুকুর বেড়ালের মত মারতে থাকে মাদ্রাসার একদল কিশোর তরুনকে। ঝড় বয়ে যায় দেশে বিদেশে। কুশাসন, অপশাসন ও দুর্নীতির মহামারিতে আক্রান্ত সরকারের ক্রেডিবিলিটি এমনিতেই ছিল তলানিতে, মতিঝিল হত্যাকাণ্ড তাকে ঠেলে দেয় আরও গহীনে। চিন্তায় পরে যায় সরকারের থিংকট্যাংকরা। এবং এখানেই জন্ম নেয় রেশমা প্রকল্প। উদ্দেশ্য সহজ, দেশী বিদেশী মিডিয়ার বাহবা, সহযোগীতা ও সহমর্মিতা আদায় পূর্বক মতিঝিল ট্রাজেডি হতে নাগরিকদের চোখ ও মন দূরে সরিয়ে রাখা। দুর্ঘটনার প্রথমে রাতে রানা প্লাজা হতে নিরাপদে বেরিয়ে আসে রেশমা। চিকিৎসা নেয় স্থানীয় এক হাসপাতালে এবং হারিয়ে যায় আহত নিহতদের মিছিলে। বিশ্বের সবকটা মিডিয়াতে তখন তোলপাড় চলছে এবং পাশাপাশি বাংলাদেশের পোষাক শিল্পের অবকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলছে ভোক্তারা। সরকার তার অযোগ্য মন্ত্রীদের নিয়ে একঘরে হয়ে একেবারেই দিশেহারা। কার মগজ হতে এ প্রকল্পের জন্ম তা জানতে আমাদের কটা মাস অপেক্ষা করতে হবে। হঠাৎ করেই রানা প্লাজার চতুর্দিকে জরুরি অবস্থা জারী পূর্বক জনজীবন অচল করে দেয় দেশটার সেনাবাহিনী। রাস্তায় চলাচল দুরে থাক, ঘর হতে বের হওয়াও আটকে দেয়া হয় বন্দুকের নলের মুখে। দৃশ্যপটের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সেনাবাহিনীর হাতে। খবরটা দাবানলের মত ছড়িয়ে পরে দেশে বিদেশে। ঘটনার সতের দিন পর জীবন্ত একজনকে উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। কটা বিস্কুট ও পানি খেয়ে ধ্বংসস্তুপের নীচে একে একে সতের দিন বেঁচে ছিল রেশমা। দেশে যতটা না হোক বিদেশে বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পরে রেশমা উদ্ধারের বিস্ময়কর কাহিনী। নিয়মিত খবর থামিয়ে অনেক চ্যানেল ব্রেকিং নিউজ হিসাবে উপস্থাপন করে বাংলাদেশের এই ঘটনা। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় কোটি কোটি মানুষ। গোটা বিশ্ব রেশমার জন্য প্রকাশ করে সহমর্মিতা ও বাড়িয়ে দেয় সহযোগিতার হাত। রেশমা উদ্ধার পর্বের আড়াল চাপা পরে যায় মতিঝিলের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড। কিন্তু হায়, খবরের পেছনে খবর জন্ম দেয়ার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ নামক দেশটা পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশের চাইতে একধাপ এগিয়ে, এ যাত্রায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

সন্দেহের শুরুটা ধ্বংসস্তূপ হতে বেরিয়ে আসার পর মুহূর্ত হতেই। পরিপাটি চেহারার রেশমাকে দেখে স্থানীয় এক সাংবাদিক প্রশ্ন তোলেন ঘটনার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। কিন্তু বন্দুকের জোর ও সরকারের বিরামহীন প্রচারণার নীচে চাপা পরে যায় উৎসুক মানুষের একাধিক প্রশ্ন। এ ফাঁকে রেশমাকে নিয়ে শুরু হয় সরকারের সন্দেহজনক কার্যকলাপ। স্বাধীন চলাচল ও কথা বলার উপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি মালটি ন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরির ব্যবস্থা করে লুকিয়ে ফেলে তাকে। সরকারি নিপীড়নের শিকার একটি দৈনিক পত্রিকা ঘটনার গভীরে প্রবেশ করার মিশন চালিয়ে যেতে থাকে। এবং এখানেই উন্মোচিত হয় সরকারের রেশমা প্রকল্পের আসল রহস্য। গোটা ব্যাপারটাই ছিল সাজানো, ইংরেজীতে যাকে বলে হোক্স, বিশ্বকে ধোঁকা দেয়ার শেখ হাসিনা প্রকল্প। এলাকায় কার্ফু জারী করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেশমাকে দ্বিতীয় বারের মত পাঠানো হয় ধ্বংসস্তূপের নীচে। সেনাবাহিনীর পরিচালনায় দৃশ্যায়িত হয় উদ্ধার পর্ব।

আইভান স্প্রাইকের মায়া শহর আবিস্কার নিয়ে হয়ত পুরোতত্ত্ববিদরা গবেষণা অব্যহত রাখবেন এবং নতুন নতুন আবিস্কারের মাধ্যমে উন্মোচন করবে্ন মায়া সভ্যতার আদ্যপান্ত। কিন্তু আমরা যারা বাংলাদেশি জনগণ ও দেশটার রাজনীতিবিদদের মগজের খবর জানি চাইলে তারাও অপেক্ষায় থাকতে পারি ইসমাইল হোসেনদের নতুন নতুন জালিয়াতি্র, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধাক্কা দিয়ে দশতলা বিল্ডিং ফেলা দেয়ার তত্ত্বের, অথবা প্রধানমন্ত্রীর গায়ে রং মেখে লাশ হওয়ার কল্পকাহিনীর। আশাকরি এসব বাংলাদেশির মগজ নিয়েও বিজ্ঞানীরা হাজার বছর ধরে গবেষণা করবেন এবং সভ্যতার এক পর্যায়ে উন্মোচিত করবে্ন মিসফিট অব সাইন্সের এসব নিগূঢ় রহস্য।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন