অনন্তকালের একাকিত্বে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

Submitted by WatchDog on Friday, April 18, 2014

gabriel garcia marquez

কখন দুটো বেজে গেল বুঝতে পারিনি। দেরি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সকাল সাতটায় অফিস ধরতে হলে এখুনি ঘুমাতে হবে। লেখাটা শেষ করার ইচ্ছা থাকলেও উপায় ছিলনা। অফিস মিস করা চলবে না। গুড ফ্রাইডে উপলক্ষে শুক্রবার ছুটি। তাছাড়া শনি রোববারের উইকএন্ড তো আছেই। সামনে তিনদিনের অফুরন্ত অবসর এবং এ ধরণের একটা লেখা শেষ করার জন্য যথেষ্ট সময়, ভাবনাটা মাথায় ঢুকতে ঘুমাতে গেলাম। সকালে অবশ্য নির্দ্দিষ্ট সময়েই ঘুম ভাঙল। প্রচ¨ গরম পানিতে দশ মিনিটের একটা ঝটপট গোসল দিয়ে মুছে ফেললাম রাত জাগার ক্লান্তি। এক কাপ গরম কফি মুখে দিয়ে দৌড়াতে হল অফিসের দিকে। কর্পোরেট আমেরিকায় পা রাখা মাত্র বাকি পৃথিবী কেমন যেন ধোয়াটে হয়ে আসে। চাইলেও বাইরের দুনিয়াকে দেখা যায়না, কান পাতলেও শোনা যায়না জীবনের স্পন্দন। যান্ত্রিক রোবটের মত কেটে যায়া সময়গুলো। দিনান্তে ফুরফুরে মেজাজেই ফিরতে হল বাসায়। ফিরেই খবরটা পেলাম। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস আর নেই। না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি। অথচ রাতের লেখাটা ছিল তাকে নিয়েই। ৮৭ বছর বয়স্ক লেখকের শারীরিক অবস্থা খুবই সঙ্গীন গতকালই প্রথম জানতে পারি। কিন্তু দিন গড়ানোর আগেই মৃত্যু সংবাদ শুনতে হবে স্বপ্নেও ভাবিনি। জীবন্ত মার্কেসকে নিয়ে লেখাটা মৃত মার্কেস পর্যন্ত টেনে আনতে বিশাল ক্যানভাসের দরকার, এত সময় নেই হাতে। তাছাড়া একজন বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিকের জন্ম-মৃত্যু স্বল্প কথায় তুলে ধরার মত লেখনি শক্তিও নেই আমার কলমে, সে মাপের লেখক নই আমি। তাই মুছতে হল রাতের লেখাটা।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময় তখন। গল্পের বইয়ের পোকা আমি। তাও সেই ছোটবেলা হতে। একটা সময় তৃপ্তির সাথে আবিস্কার করলাম রুশ ভাষায় খুব স্বাচ্ছন্দের সাথে উপন্যাস পড়তে পারছি। বাংলা ইংরেজির সাথে তৃতীয় একটা ভাষা যোগ হওয়ায় লিও টলস্টয়, আন্তন চেখব এবং ফেওদর দস্তয়ভস্কির মত ভুবনখ্যাত লেখকদের সাহিত্যকর্মের দিকে হাত বাড়াতে সাহস করলাম। একে একে পড়ছি আর গোগ্রাসে গিলছি প্রিয় লেখদের লেখা। আন্দ্রেই সুস্যেনিয়া ছিল আমার রুমমেট। সাখালিন দ্বীপের এই রুশ তরুণেরও ছিল বই পড়ার রোগ। এবং তার মাধ্যমে প্রথম পরিচয় লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সাথে।

’স্ত লিয়েত ওদিনেস্তবো’ বা ’ওয়ান হান্ড্রেডে ইয়ারস অব সলিচ্যুড’ বইটা পড়া শেষ করে আন্দ্রেই বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে। আশ্বাস দেয় ভাল লাগার। এবং এখানেই শুরু। উপন্যাস পড়ছি সেই ছোটবেলা হতে। অনেক লেখকের গুণমুগ্ধ পাঠক আমি। শুরুটা বোধহয় তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে। বেলা বাড়ার সাথে লেখা ও লেখকের পরিসরও পা বাড়ায় উপমহাদেশের বাইরে। নতুন শুরুটা ছিল ফেওদর দস্তয়েভস্কির ’ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’ ভুবন হতে। লেখকের লেখাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মত সমালোচক নই আমি। এ ব্যাপারের আমার সমীকরণ খুব সহজ, ভাল লাগলে পড়াটা শেষ করি, না লাগলে মাঝ পথে ক্ষান্ত দেই। দুদিন লেগে গেল ’শত বর্ষের একাকিত্ব’ বইটা শেষ করতে। এই দুই দিন ক্লাশে যাইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছরের শিক্ষা জীবনে এটাই ছিল প্রথম ক্লাশ ফাঁকি। কেন যাইনি এর কোন যুতসই ব্যাখ্যা দিতে পারিনি শিক্ষকদের কাছে। আসলে এর কোন ব্যাখ্যাও ছিলনা। কেবল পড়ার দুই দিন নয়, পরবর্তী দু সপ্তাহ এক ধরণের মোহ রাজত্ব করেছিল গোটা শরীর জুড়ে। চোখ বুজলে মনে হত আমিও হোসে আরকাডিও বুয়েন্দিয়া বংশের একজন এবং বাস করছি তার স্বপ্নের শহর মাকন্দোতে। উরসুলা, আওরিলিনো, ডন আপোলিনর, রেবেকার মত চরিত্র গুলো মনে হত আমার চারদিকে হাটাচলা করছে। প্লেগ ও গৃহযুদ্ধ মাকন্দোকে ধ্বংস করতে পারেনি। কিন্তু তারপর এল বৃষ্টি। পাচ বছরের বিরামহীন বৃষ্টি ধ্বংস করে দেয় বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাথে মাকন্দো শহরকেও। সাত প্রজন্মের শেষ চরিত্র আরামান্তা উরসুলা গর্ভবতী হয়ে অপেক্ষায় থাকে সন্তানের। শুয়রের লেজ সহ জন্ম নেয়া সন্তান জন্ম দেয়ার সময় মারা যায় আরামান্তা। শেষ পর্যন্ত ঐ সন্তানকেও খেয়ে ফেলে পিপড়ার দল। এবং সব শেষে প্রচন্ড হারিকেন এসে মাটি হতে মুছে দেয় মাকন্দো শহর সহ বুয়েন্দিয়া বংশের অস্তিত্ব। একজন লেখকের পক্ষে সাত প্রজন্মের একটা পরিবারে আধা ভৌতিক কাহিনী এভাবে বর্ণনা করা যে সম্ভব গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আমরা হয়ত উপলদ্ধি করতে পারতাম না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘাত প্রতিঘাতের কারণে আমার ধারাবাহিক ’কলোম্বিয়ার পথে পথে’ লেখাটা থেমে আছে। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে দক্ষিন আমেরিকার দেশ কলোম্বিয়ায় দ্বিতীয় বারের মত ভ্রমনে যাই। সে যাত্রায় সাথে ছিল আমার গিন্নী। বগোটায় দুদিন কাটিয়ে সান্তা মার্তা নামক সামুদ্রিক শহরে এক সপ্তাহ কাটিয়ে রওয়ানা দেই ক্যারাবিয়ান সাগর পাড়ের শহর কার্তাখেনা দ্যা ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে। শহরটা পর্যটকদের লীলাভূমি। এর মূল আকর্ষন উত্তাল ক্যারাবিয়ান সাগর ও এর সফেদ ঢেউ। কিন্তু আমার জন্য শহরটার আকর্ষন ছিল অন্য কারণে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। লেখক জীবনের একটা অধ্যায় কাটিয়েছিলেন এই সমুদ্র শহরে এবং লিখেছিলেন ভুবনখ্যাত উপন্যাস ’সিয়েন আনিওস দ্যা সলিদাদ’এর একটা আংশ। কাব্যিক এ শহরে প্রথম রাতটা ঘোড়া গাড়িতে কাটিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পরি। রাতের শহরে নিভু নিভু আলোর স্বপ্নীল আভা এক ধরণের ভৌতিকতা সৃষ্টি করে। হরেক রকম ভয় এসে দানা বাধে। শহরের মূল চত্বর পেরিয়ে নির্জন আবাসিক এলাকায় ঢুকতে ভেসে এল আলো আধারিতে ফিসফাস আওয়াজ ও কিছু সাবধানী পায়ের নিঃশব্দ চলাফেরা। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যেতেই দেখলাম সিনেমার শ্যুটিং হচ্ছে। যেনতেন সিনেমা নয়, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আরেক উপন্যাস ’লাভ ইন দ্যা টাইম অব কলেরা’র চিত্রায়ন। স্থানীয় একটা রেস্টুরেন্টের লবিতে খাবার খাচ্ছে নায়ক নায়িকা। আশপাশের সবার গায়ে অন্য শতাব্দীর পোষাক। আমাদের দুজনকে দেখে কেউ একজন এগিয়ে এল এবং জানতে চাইল রেস্টুরেন্টের গ্রাহক হিসাবে সিনেমাতে নাম লেখাতে চাই কিনা। এবং তা করতে চাইলে ড্রেসিং রুমে গিয়ে পোষাক বদলে আসতে হবে। গিন্নী এক পায়ে দাড়িয়ে হা বলে দিল। আমাদের নিজস্ব পোশাকের উপর ফতুয়া জাতীয় কিছু একটা পড়ে বসে গেলাম টেবিলে। নিভু নিভু আলোতে কারও মুখ দেখার উপায় নেই। ক্যামেরাও আমাদের দিকে মুখ ফেরায়নি। গভীর রাত হয়ে গেল ছোট্ট একটা দৃশ্য শেষ করতে। আমাদের ঘোড়ার গাড়ি পাশেই অপেক্ষা করছিল। ’লাভ ইন দ্যা টাইম অব কলেরা’ হতে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলাম। এবং সে রাতেই ঘুরে এলাম লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়ার আবাস হতে। টমটমওয়ালা খুব গর্বভরে নিয়ে গেল লেখকের ব্যালকনির কাছে। এই সেই ব্যালকনি যেখানে বসে তিনি ছক আকতেন বুয়েন্দিয়া বংশের উত্থান পতনের। পরবর্তী সাতদিনের প্রায় প্রতিদিন খুঁজতে বেরিয়েছিলাম প্রিয় লেখকের পদচিহ্ন¡।

মার্কিন হিংস্র পশ্চিমের যে অংশটায় এখন বাস করি সেখান হতে মেক্সিকোর সীমান্ত চার ঘন্টার ড্রাইভ। সীমান্ত হতে হয়ত আরও কয়েক ঘন্টা জার্নি করলেই হয়ত দেখা মিলবে লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের। তবে জীবন্ত নয়, তার নিথর মৃতদেহের। আমার উপন্যাসের পৃথিবী যতদিন বেঁচে থাকবে ঠিক ততদিনই বেঁচে থাকবে কলোম্বিয়ার গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এবং তার কালজয়ী উপন্যাস ’ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুড’। বিনম্র শ্রদ্ধা প্রিয় লেখকের প্রতি। এ যাত্রায় আর শত বর্ষের নয়, বরং জন্য চলে গেলেন অনন্তকালের একাকিত্বে।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন