একজন আমিন সাহেবের গল্প

Submitted by WatchDog on Sunday, February 21, 2010

আমিন সাহেব নামের একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই আপনাদের। ভয় পাবেন না, উনি দু’হাত, দু’পা আর ঘাড়ের উপর মাথাওয়ালা সাধারণ একজন মানুষ মাত্র। ঘটা করে পরিচয় না করালে এই আমিন সাহেবকে হয়ত দেখেও না দেখার ভান করতেন, চিনেও না চেনার তাগাদা অনুভব করতেন। কারণ গোটা বাংলাদেশ জুড়েই এখন আমিন সাহবদের মেলা। আমিন সাহেবের সাথে পরিচয় ৭১’এর আগে। শ্রেফ আমিন নামেই চিনতাম উনাকে। ৭১’এর সিড়ি ডিংগিয়ে পাড়ার বখাটে যুবক আমিন কবে কার কাছে থেকে সাহেব উপাধি পেয়েছিল তার দিন ক্ষণ কেউ মনে রাখেনি।

পাকিদের বোমার ছোবলে দাউ দাউ করে জ্বলছিল আমাদের শহর। আগুনের দাবানল নেভানোর চাইতে মানুষ হঠাৎ করেই বেশী উৎসাহী হয়ে পরল বাজার বন্দর, ব্যবসা বানিজ্য লুটতরাজে। বখে যাওয়া আমিন ও তার জোয়ান দুই ভাই সামনে হতে নেত্রীত্ব দেয় ঐ দিনের ভয়াবহতায়। দিনান্তে সর্বগ্রাসী আগুনের লেলিহান শিখা নেভানো সম্ভব হলেও আমিন & ব্রাদার্সের সর্বগ্রাসী লিপ্সা নেভানোর মত যথেষ্ট পানি পাওয়া যায়নি মেঘনা নদীর মোহনায়। ন’মাস ধরে পাকি বাহিনী ও তাদের দোসরদের প্রত্যক্ষ মদদে আমিন পরিবার একে একে গ্রাস করে নেয় সংখ্যালঘুদের ব্যবসা-বানিজ্য, বসত বাড়ি সহ সম্পদের সাম্রাজ্য। একদিকে লুণ্ঠিত সম্পদ, অন্যদিকে দখল করা চলমান ব্যবসা, সব মিলিয়ে সিনিয়র আমিন নিজকে শহরের নব্য সাহেব বলে দাবি করলে কেউ প্রতিবাদ করার সাহষ করেনি। এই আমিন গং ডিসেম্বরের শেষ হতে মার্চের শুরু পর্যন্ত ক’টা মাস নিখোঁজ থাকতে বাধ্য হলেও কথিত আছে পলাতক অবস্থায় এই লুটেরা পরিবার স্থানীয় আওয়ামী সাংসদকে মোটা অংকের উৎকোচ দিয়ে অবমুক্ত করে নেয় ৭১’এর পাঁপ। এরপর আর পিছু তাকাতে হয়নি ইতিমধ্যে সাহেব বনে যাওয়া আমিনকে। ৭৫’এর পট পরিবর্তন উনার জন্যে খুলে দেয় সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত, রাজনীতি! সময়টা ছিল জেনারেল জিয়ার খারাপ মানুষের সন্ধানে বাংলাদেশ চষে বেড়ানোর সময়। ভ্রমরে ভ্রমর চিনে কায়দায় আমিন সাহবেকে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি জেনারেলের চামচাদের। এর পরের ইতিহাস খুব সাদামাটা। রাজনীতিকে পূঁজি করে আমিন সাহেব আর দশটা রাজনীতিবিদের মত র্দুনীতির পাগলা ঘোড়ায় চেপে বিপুল বিক্রমে পৌঁছে যান সাফল্যের শেষ বন্দরে। ক্ষমতার ভরা বসন্তে পয়সা ছড়িয়ে একদল সেবাদাস সৃষ্টি করতেও ভুল করেন্‌নি আমিন সাহেব। শহরের বখে যাওয়া যুবকদের মাসোহারা আর পাঁপের রসদ যুগিয়ে হেন কোন কাজ নেই যা করাতে দ্বিধা করতেন তিনি। কথিত আছে স্থানীয় সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজারকে নিয়মিত রঙ্গিন পানি আর দেহপশারিনী সাপ্লাই দিয়ে ভূয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে বাগিয়ে নিয়েছিলেন কোটি কোটি টাকার ব্যাংক লোন। এভাবেই শুরু আমিন সাহেবের ফেরিটেইল জার্নি। নাম, যশ আর প্রতিপত্তির নীচে কখন চাপা পরে যায় ৭১’এর আমিন চাইলেও এখন আর কেউ মনে করতে পারবেনা।

ক্ষমতা ও বয়সের প্রবাহে আমিন সাহেব হতে হাজী আমিন বনে গেলেও উনাকে আমি সব সময় ৭১’এর পূর্ব আমিন হিসাবেই জানতাম। সংগত কারণে ’আপনি’ ও ’সাহেব’ বলে সম্বোধন করার তাগাদা অনুভব করিনি কখনও। উনিও তা জানতেন, এবং এখানেই শুরু হত আমিন সাহবের সাথে আমার ব্যক্তিগত সংঘাত। বাবা বেচে থাকতে গোরস্থানের জন্যে বিশাল একটা জমি দান করে গিয়েছিলেন, যা বর্তমান বাজার মূল্যে বিক্রী করলে আমাদের দুই প্রজন্মের স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হত। একই গোরস্থানে আমিন সাহেবও উনার অবৈধ আয়ে ক্রয় করা সামন্য কিছু জায়গা দান করেছিলেন। মৃত্যুর অনেকগুলো বছর পর বাবার কবর পাঁকা করার সিদ্বান্ত নেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে। কাজ শুরুর সুন্দর সকালে আমিন সাহেবের পেশী বাহিনী এসে বাধা দিল নির্মান কাজে। খবর পেয়ে আমিন সাহেবের মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ব পিতা চলে আসলেন ’যুদ্বের’ মাঠে। পিতা জয়নাল হোসেনেরও একটা পরিচয় আছে। ’৭১ সাল পর্যন্ত এই জয়নাল হোসেন আমাদের বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩০ বছর নৈশপ্রহরী হিসাবে কর্মরত ছিল। নৈশপ্রহরী হলেও উনাকে আমরা পরিবারের একজন বলেই জানতাম এবং জয়নাল কাকা বলে সম্বোধন করতাম। পাকিদের বোমার আঘাতে আমাদের শহর যেদিন জ্বলছিল এই জয়নাল কাকার হাতেই ছিল আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চাবি। ওখানটায় আগুনের দাবানল পৌঁছানোর কোন সম্ভাবনা না থাকলেও জয়নাল কাকা উনার ছেলেদের নিয়ে সর্বপ্রথম লুটে নেন নিজের ৩০ বছরের রুটি রোজগারের কর্মস্থল। অনেকগুলো বছর পর গোরস্থানেই দেখা হল জয়নাল কাকার। চোখের পানি আর নাকের পানি একাকার করে ক্ষমা চাইলেন নিজের ও সন্তানদের অপরাধের জন্যে। শেষ পর্যন্ত উনাকেই দায়িত্ব দিয়েছিলাম কবর পাকার কাজ তদারকির জন্যে। কৈ এর তেলে কৈ ভাজার আমার এই অভ্যাসের সাথে আমিন সাহেবের ভাল করেই পরিচয় ছিল। প্রতিশোধের হাজার চেষ্টা করেও উনি সফল হন্‌নি মূলত শহরের খেটে খাওয়া মানুষের জন্যে।

এই আমিন সাহেবই আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। ছুটিতে দেশে বেড়াতে গেছি সে যাত্রায়। উনি ভাল করেই জানতেন বেঁচে থাকতে আমি উনার সাথে দেখা করতে যাবনা। আগ পিছ চিন্তা না করে নিজেই আসার সিদ্বান্ত জানালেন। সকাল ১০টায় সময় দিয়ে আসলেন দপুর ১২টার পর। আগের মত তুই তুকারী করায় মনে মনে ক্ষুন্ন হলেও মুখ খুলে প্রকাশ করার সাহষ পেলেন্‌না। আমার সাথে দেখা করার আসল কারণটা জেনে খুব একটা অবাক হলামনা। উনার দুই ছেলেকে কি করে আমেরিকায় পাঠানো যায় তার একটা প্রেসক্রিপশন চাইছেন আমার কাছে। দুটো ছেলেই নাকি ড্রাগ আসক্তি সহ হরেক রকম ক্রাইমের জড়িয়ে নৈতিক পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমার যা বলার তা শেষ করতেই আমিন সাহেব ফিরে এলেন রাজনীতিতে। উনার দল তখন ক্ষমতায়। এর আগেও প্রস্তবটা একজনের মারফত দিয়েছিলেন, এবার সড়াসড়ি বলে ফেল্‌লেন, আমাদের ক্ষয়িষ্ণু পরিবারে আগের শান সৈকত ফিরিয়ে আনতে আমার মত জটিল ’বুদ্বিওয়ালা’ মানুষের নাকি রাজনীতিতে যোগ দেয়া উচিৎ। রাগ করলাম না উনার কথায়, যা বলেছেন একেবারে খাঁটি কথা। উত্তরটা একটু ঘুরিয়ে দিলাম।

’আসতে তোর এত দেরী হল যে, ঘটনা কি?’
’রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম, তাই’
’শুনেছি তোদের ব্যবসা বানিজ্যও ভাল যাচ্ছেনা, কারণটা কি?
’বিদ্যুৎ আর গ্যাস ঝামেলা করছে, কুল কিনারা পাচ্ছিনা কি করব। একদিকে উৎপাদন মার খাচ্ছে, পাশাপাশি ভারতীয় পন্যে সায়লাব হয়ে যাচ্ছে বাজার। লোনের টাকার সুদ পরিশোধ করতে পারছিনা সময়মত, তাই ব্যাংক ম্যানেজারদের ঘুষ দিতে হচ্ছে দেদারসে‘
'তোর এত টাকা-পয়সা, ছেলেদের মানুষ করতে পারলিনা কোন কারণে?’
’ছাত্ররাজনীতি আর সংগদোষে নষ্ট হয়ে গেছে শুয়রের বাচ্চারা’।

এবার ফিরে এলাম রাজনীতিতে যোগদান প্রসংগে। সড়াসড়ি বলতে বাধ্য হলাম মোটা মাথার এই রাজনীতিবিদ্‌কে। ’মাজার প্রিয় তোর নেত্রী যেদিন মৃত স্বামীকে টানা হেচড়া রেখে রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সমস্যা, ভারতীয় পন্যের চোরাইকারবারী, ব্যাংক ম্যনেজারদের ঘুষ আর ছাত্ররাজনীতি সমস্যা দূর করার কথা বলবে সেদিনই যোগ দেব তোর দলে। মেট্রিক ফেল নেত্রীর দলে যোগ দিয়ে অবৈধ পথে নিজদের ভাগ্য ফেরাতে গেলে ছেলেমেয়ারা নষ্ট হবেই, এমন একটা সত্য জোড় গলায় বলতেই মলিন হয়ে এল আমিন সাহেবের মুখ। উনি বুঝতে পারলেন আমি ’৭১এ ফিরে যাতে যাচ্ছি। সহসাই বিদায় নিলেন শহরের নামকরা ব্যবসায়ী ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জনাব আমিন হোসেন।

আমিন সাহেবের মৃত্যু সংবাদটা নিউ ইয়র্ক বসেই পেয়েছিলাম। হাজী হলেও মদ ও মেয়ে মানুষের পুরানো অভ্যাস নাকি দূর করতে পারেন্‌নি। ঢাকার নিকুঞ্জ এলাকায় গোপন একটা ফ্লাট রেখে ইয়ার-দোস্ত নিয়ে আমুদ ফুর্তি করতেন প্রায়ই। শরীরের উপর মদের অত্যাচার সাথে নানাবিধ মানসিক যন্ত্রণা, এগুলোই কাল হয়ে দাঁড়ায় আমিন সাহেবের জন্যে।

উঠতি কোন ব্যবসায়ী-কাম-রাজনীতিবিদের গল্প শুনলেই কেন জানি আমিন সাহেবের চেহারাটা সামনে এসে দাড়ায়। দাউ দাউ করা জ্বলন্ত আগুন হতে লুটে নিচ্ছে অন্যের সম্পদ, পাকসেনা আর রাজাকারদের মদদে দখল নিচ্ছে র্দুবল সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, রাজনীতির ছত্রছায়ায় লুটপাট করছে সরকারী সম্পদ, ব্যাংকের তহবিল উজাড় করছে রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতায়, রাজনীতির মাঠ গরম করছে জ্বালাময়ী ভাষনে, একুশে ফেব্রুয়ারীতে শহীদ মিনারে, কারণ অকারনে নেতার মাজারে, পেশীশক্তি লালনের মত বর্জ্য সাংস্কৃতির জড়ায়ুতেই বেড়ে উঠছে আমিন সাহেব তথা গোটা বাংলাদেশের রাজনীতি। জটিল আর্থ সামাজিক সমীকরন মেলাতে গিয়ে ব্যর্থতাকে যারা নিয়তি বলে মেনে নিয়েছেন তাদের জন্যে আমিন সাহবে হতে পারেন ভাল মন্দ দুটোরই উদাহরন। রাস্তায় চকচক করা আমিন সাহেবদের জৌলুষ দেখে বিমোহিত হওয়ার আগে আমার আমিন সাহেবের কথাটা একবার মনে করার জন্যে অনুরোধ করব। একটা কথা মনে রাখবেন, চাঁদেও অন্ধকার আছে, আছে কলংক।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন