মধ্যরাতের শিকারী

Submitted by WatchDog on Thursday, January 14, 2010

Corruption in Bangladesh

শামশুল হক এবং সিদ্দিক হোসেন। দেখতে দু’রকম হলেও দু’জনের পেশা এক, ডেসার উপসহকারী প্রকোশলী। দীর্ঘ ১৪ বছর প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে আসি অনেক আশা নিয়ে। বেশ ক’বছর ঢাকায় চেষ্টা করে তেমন কিছু করতে না পেরে শেষ পর্য্যন্ত ফিরে যাই নিজ শহরে। শত বছরের পুরানো আমাদের পারিবারিক শিল্প প্রতিষ্ঠান বয়সের ভারে নূয্য হয়ে নিভু নিভু করছিল প্রায়। বেশিকিছু না ভেবে ওখানেই ঢুকে পরার সিদ্বান্ত নিলাম। সেখানেই পরিচয় শামশুল হকের সাথে, এবং উনার মাধ্যমে সিদ্দিক হোসেনের সাথে। কথা প্রংসগে জানা গেল বেশ ক’বছর ধরেই এই দুইজন আমাদের শিল্প কারখানার বন্ধু। বিষয়টা বুঝতে একটু সময় লাগল আমার। আসছি সে প্রসংগে।

শিল্প প্রতিষ্ঠানটাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে লোকালয়টা। বেশ কিছু দোকানপাট, খাবার হোটেল এবং সাথে বিরাট একটা মসজিদ। বছর জুড়ে মসজিদটায় লেগে থাকে তাবলিগ জামাতীদের কিছু না কিছু অনুষ্ঠান। সুদূর ইরান হতেও লোকজন আসা যাওয়া করে। মসজিদ কমিটির কর্নধারও আমাদের সামশুল হক এবং সিদ্দিক হোসেন। মসজিদটার ঠিক পেছনেই আলীশান দু’টা বাড়ি বানিয়েছেন দু’জনে। উপসহকারী প্রকৌশলী হয়ে এত টাকা কোথায় পান জানতে চাইলে হে হে করে হেসে বলেন, সব মাবুদের দয়া। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজপড়া পাক্কা মুসুল্লী দুজনেই, কথার আগে পিছে সৃষ্টি কর্তার নাম নিতে ভূল করেন্‌না। আমাকে দেখলেই লম্বা একটা সালাম দিয়ে কেন জানিনা ধর্মতত্ত্ব নিয়ে নিজদের পান্ডিত্য জাহির করতে উঠে পরে লাগেন। কম্যুনিষ্ট দেশে লেখাপড়া করেছি বলেই হয়ত সাচ্চা মমিন বানানোর একটা আলাদা তাগাদা অনুভব করতেন দুই মুরুব্বী। সর্বক্ষন মসজিদের কাজে ব্যস্ত থাকেন, অফিস কখন এবং কোথায় করেন কেউ জানেনা। অফিসে বসে কাজ করছি একদিন, হঠাৎ দেখি একদল মুরুব্বী হাজির একটা আর্জি নিয়ে। মসজিদে ভারত হতে জনৈক বুজুর্গ এসেছেন, বয়ান হবে তাই আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠান মাগরেব নামাজের পর ঘন্টা দুয়েক বন্ধ রাখতে হবে। শ্রমিকদের দাওয়াত দেয়া আছে আগেই। মুরুব্বীদের নেত্রীত্ব দিচ্ছেন আমাদের সেই শামশুল এবং সিদ্দিক সাহেব। আমি এক কথায় না করে দিলাম। প্রথমত, আমাদের কারখানা একটা প্রসেস সাইকেলে চলে, একবার গ্যাস নিভিয়ে দিলে ওটা চালু করতে ঘন্টা খানেক সময় লাগে, ব্যায় হয় অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা। দ্বিতীয়ত, তাবলিগ জামাত নিয়ে ইতিপূর্বে এলাকায় হাতাহাতি হতে দেখেছি। মনক্ষুন্ন এবং পরজনমে আমার সাজার উপর নাতিদীর্ঘ একটা লেকচার দিয়ে বেরিয়ে গেলেন মুরুব্বীর দল।

মাসের শেষ। সন্ধার পর কারখানায় যেতে বাধ্য হলাম একটা বিশেষ কাজে। হঠাৎ দেখি মূল ফটক বন্ধ এবং কারখানার সামনে থেমে আছে ডেসার একটা হাফট্রাক। কারখানার ভেতরেও দেখলাম বেশ অন্ধকার, ভয় পেয়ে গেলাম অজানা অশংকায়। প্রথমেই ধরলাম মিলের দাড়োয়ানকে। আমাকে দেখে সাপ দেখার মত চমকে উঠলো সে। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পরল দৃশ্যটা। লম্বা একটা মই ঝুলছে বিদ্যুতের খুঁটিতে। খুঁটির আগায় কেউ একজন লুংগি পরে কাজ করছে। পরিচিত শামশুল হক সাহেবকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম, পাশেই দেখলাম উনার সাড়া জীবনের সাথী সিদ্দিন হোসেন। আমার এক ছোট ভাইকেও দেখলাম উনাদের সাথে। ঘটনাটা আঁচ করতে বেশী সময় লাগলনা। বিদ্যুতের মিটার ঘুরাচ্ছেন হক-সিদ্দিক গং। প্রথমে ধরলাম আমার ভাইকে। সে যা বল্‌ল তা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। গত ৪ বছর ধরেই এই দুই মুরুব্বী শুধু আমাদের মিটারই ঘুরাচ্ছেন্‌না এলাকার যত কারখানা আছে তার সবকটাতেই চালিয়ে যাচ্ছেন নিজদের নৈশাভিযান। এটাই নাকি স্থানীয় ব্যবসার নিয়ম, সময়মত বিদ্যুৎ এবং গ্যাস মিটার ঘুরানো।

কাজ শেষে সামন্যতম কুণ্ঠা না দেখিয়ে হাতে নগদ নিয়ে পরবর্তী শিকারে বেরিয়ে গেল এই দুই বন্ধু। পরদিন সকালে অফিস যাওয়ার পথে আবারও দেখা এই দুই মুসুল্লীর সাথে। মসজিদের সামনের খোলা জায়গায়টায় অজুর ব্যবস্থা হচ্ছে, উনারা আছেন তদারকীতে। যথারীতি লম্বা একটা সালাম দিলেন। রাতের এই দুই পাখীকে কেন জানি এই প্রথম উলটো সালাম দিতে ইচ্ছে করলনা।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন