অপেক্ষায় থাকবো নয় বছর

Submitted by WatchDog on Tuesday, January 7, 2014

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আতংকটা সবাইকে চেপে ধরলো। এই বুঝি এল! শহরে গুজবের প্লাবন বয়ে গেল। কেউ কেউ বলল নিজ চোখে দেখে এসেছে বিশ মাইলের মধ্যে এসে গেছে। গণ্ডারের শরীর, বাঘের চাউনি আর হাতে অলৌকিক সব অস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসছে ওরা। আসার পথে দশ বিশ মাইলের ভেতর কোন বাড়ি ঘর নাকি আস্ত রাখছে না, সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই খুন করছে। ভয়, আতংক আর অনিশ্চয়তার কারণে অনেকে শহর ছেড়ে পালানো শুরু করে দিল। ৪ তারিখ সকালে শহরবাসীর ঘুম ভাঙ্গল গুর গুর আওয়াজে। আকাশ পথে এলো ওরা। দুই দফায় চারটা জঙ্গী বিমান ঝাঁপিয়ে পরলো শহরের উপর। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মত ঝলসে উঠল চারদিক। তারও এক মাস পর শহরের উপকণ্ঠে দেখা গেল তাদের ট্যাংক। ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে বরণ করে নিল একদল স্বদেশি। পিপীলিকার মত গর্তের ভেতর হতে বেরিয়ে এল ওরা এবং ’বিজয়’ উল্লাসে কাঁপিয়ে দিল শহরের অলিগলি। আমার বন্ধু সামাদ এবং তাদের পরিবারের আনন্দটা ছিল চোখে পরার মত। সামনে পেয়ে টিটকারি দিল এবং মনে করিয়ে দিল পাকিস্তানী সেনাদের শক্তি। ওরা নাকি হাজার বছর ধরে থাকবে এ শহরে এবং একটা একটা করে নিধন করবে পাকিস্তান বিরোধীদের। সামাদের মত আরও অনেকে রাস্তায় নেমে উল্লাস করলো এবং কদিন আগে যারা এ শহরে জয়বাংলার পতাকা উড়িয়েছিল তাদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে লম্প জম্প করতে শুরু করল। আমার মত অনেকেই চুপসে গেল এবং নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেল। কদিন পর সামাদের বাবাকে শান্তি কমিটির চেয়ায়ম্যান হিসাবে ঘোষনা দেয়া হল। চোখে মুখে শংকা আর বুকে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে আমাদের মত অনেকেই মিশে গেল জীবন প্রবাহে। সামাদ এবং তাদের সঙ্গীরা নটা মাস ধরে শহরে হত্যা, গুম, খুন, লুণ্ঠনের রাজত্ব চালিয়ে গেল। সমস্যা শুরু হল নভেম্বরের শেষ দিকে। রাতের অন্ধকারে ওদের পালাতে দেখ আতংকে শিউরে উঠল সামাদ পরিবারের সবাই। কোথাও পালানোর জায়গা ছিলনা তাদের। তাই শহরে থেকে যেতে বাধ্য হল। ডিসেম্বরের ১২ তারিখ মুক্ত হয়ে গেল আমাদের শহর। আরেক পশলা রক্তের নদী বয়ে গেল শহরে। এ যাত্রায় রক্তের রং ছিল মিশ্র। বাঙ্গালী ও পাকিস্তানী রক্তের সংমিশ্রণ। সামাদের বাবার লাশ সাতদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখল শহরের মূল চত্বরে। কে একজন মুখটা টেনে হিঁচড়ে বড় করে ফেলল এবং তাতে ঢুকিয়ে দিল এক গাদা ডান্ডি কার্ড (আইডি কার্ডকে সে সময় সংক্ষেপে ডান্ডি কার্ড বলা হত)। পরনের কাপড় উপচে গেল মলমূত্রে।

উপরের সব গুলো ঘটনাই ৭১ সালের। আজ প্রায় ৪৩ বছর পর নতুন করে অনুভব করলাম তাদের পুনঃ উত্থান। গায়ের জোর, অস্ত্রের জোর আর গোয়েবলসীয় মিথ্যাচারে ১৫ কোটি মানুষকে তামাশার পাত্র বানিয়ে ওরা উল্লাস করছে। সাথে যোগ দিচ্ছে নতুন নতুন সামাদ পরিবার। আবারও টিটকারি, হুমকি আর আস্ফালন করে ঘোষনা দেয়া হচ্ছে দশকের পর দশক ধরে ক্ষমতা ধরে রাখার। ৭১ সালের প্রথম দিকে সময়টা ছিল তাদের। বিজয় ছিল তাদের পায়ের তলে। দেশ ছিল মুঠোয়। আজ এত বছর পর দেশের মাটিতে আবারও শোনা যাচ্ছে হায়েনাদের পদধ্বনি। নটা মাস ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছিল পশুদের শেষ দেখার জন্য। আজকের হিসাবে নয় মাস তেমন কোন সময় নয়, বরং দরকারে নয় বছর অপেক্ষায় থাকবো। তবু দেখতে চাই কেউ না কেউ ওদের মুখ গুলো টেনে ছিড়ে ফেলেছে এবং তাতে ঢুকিয়ে দিয়েছে বস্তা বস্তা ভোট।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন