স্মৃতির মনি কোঠা থেকে তিয়েন আন মেন ম্যাসাকার-২

Submitted by WatchDog on Sunday, June 7, 2009

১৯৮৯ সালের ৩রা জুন। চিনের রাজধানি বেইজিং এর কেন্দ্রস্থল তিয়েন আন মেন স্কয়ারে (স্বর্গের দ্বারে) চিনের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সংঘটিত সংস্কার ও গনতান্ত্রীক আন্দোলন নির্মুল করতে ঘটেছিল ইতিহাসের নির্মমতম এক হত্যাজজ্ঞ। তিয়েন আন মেন স্কয়ারের অদুরেই এক ছাত্র নিবাসে পাচ দিন অবরুদ্ধ ছিলাম আমি সহ হংকং থেকে আগত বেশ কিছু ছাত্র। স্মৃতির মনিকোঠা থেকে হাতড়ে অবরুদ্ধ সেই পাচ দিনের চাঞ্চল্যকর ঘটনার বিবরন।


দ্বিতিয় পর্ব
---------
স্মৃতি হাতড়ে সঠিক তারিখটি উদ্ধার করতে না পারলেও যতদূর মনে পড়ে মে’৮৯ মাসের ২২ অথবা ২৩ তারিখ সন্ধ্যায় তাজ সিং এর টেলিফোন পেলাম। তার কন্ঠস্বর শুনে মনে হলো সে খুবই উত্তেজিত। জানালো আজ সন্ধ্যায় তাদের একটি ছাত্রসভা আছে। সভাটি অত্যান্ত গোপনীয় বিধায় সেখানে আমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে আমাকে অনুরোধ জানালো আমি যেন গভীর রাতে তাদের নৈশ বাজারের তাবুতে দেখা করি। এখানে উল্লেখ্য যে, চীনের কমুনিষ্ট পার্টির উদারপন্থী ও সংস্কারবাদিদের কন্ঠস্বর বলে পরিচিত মি হুইও বাং এর মৃত্যুর পর তার শোকসভাকে কেন্দ্র করে বিগত এপ্রিল’৮৯ মাসের তৃতিয় সপ্তাহ থেকে গড়ে উঠে তিয়েন আন মেন স্কয়ারের মুল এই ছাত্র আন্দোলন। শুরু থেকেই এ আন্দোলনের প্রতি হংকং এর প্রো-ডেমোক্রেটিভ ছাত্ররা তাদের সর্বাত্বক সমর্থন ঘোষনা করে, এবং এ আন্দোলনে হংকং এর আপামর জনতার সহানুভুতি ও আর্থিক সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে শা তিন ক্যাম্পাস এলাকাস্থ এ নৈশ বাজারে প্রায় একমাস যাবৎ ছাত্ররা হরেক রকমে টি-সার্ট, টুপি ও বিভিন্ন রকমের ষ্টিকার বিক্রী করে আসছে। প্রতি রাতে দুজন করে ছাত্রদের এক একটি গ্রুপ প্রতি দু ঘন্টার জন্য পালাক্রমে এখানে স্বেচ্ছাশ্রম দান করে। এ উদ্দোগটি সংশ্লিষ্ট আন্দোলনের প্রতি স্থানীয় অধিবাসীদের ব্যপক সহানুভুতি আদায়ে সমর্থ হয়েছে বিধায় তাদের সংগ্রিহীত অর্থের অংক দিনেদিনে স্ফিত হচ্ছে । ইতিমধ্যে দু দফায় এ তহবিল থেকে বেইজিং এর মুল আন্দোলনের সংগঠকদের কাছে অর্থ প্রেরন করা হয়েছে ।

রাতে নির্ধারিত সময়ে নৈশবাজারে পৌছে জানতে পারি যে, চিনা কমুনিষ্ট পার্টির ততকালীন সাধারন সম্পাদক্ ঝাও জিয়াং বিগত ১৯ শে মে’৮৯ তিয়েন আন মেন স্কয়ারে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে যে মর্মস্পর্শী বক্তব্য দিয়েছেন তার ভিডিও কপি ইতিমধ্যেই হংকং এর ছাত্রদের হস্তগত হয়েছে এবং তা অদ্য সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত তাদের সভায় প্রদর্শিত হয়েছে। ঝাও জিয়াং এর এ বক্তব্যের পরদিন চীন সরকার কতৃক বেইজিং এ সামরিক আইন জারী করে তিয়েন আন মেন স্কয়ার সামরিক বাহীনির নিয়ন্ত্রনে নেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও আন্দোলনকারী ছাত্র ও বেইজিংবাসী সর্বস্তরের জনতার অভুতপুর্ব প্রতিরোধ ও ব্যারিকেডের ফলে সেনারা শহর কেন্দ্র (স্বর্গের দ্বার) তাদের নিয়ন্ত্রন লাভে ব্যার্থ হয়ে সেনানিবাসে ফেরৎ যেতে বাধ্য হয়েছে। সেখানে আরও জানানো হয়েছে যে,শধুমাত্র চিনের প্রত্তন্ত এলাকা থেকে আগত আপামর ছাত্র জনতার ঢলই কেবল নয় পার্শবর্তী রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চল ও মঙ্গোলিয়া থেকেও ছাত্ররা তিয়েন আন মেন স্কয়ার অভিমুখে ছুটে আসছে। ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী ঐতিহাসিক এ বিস্ময়কর ঘটনাগুলির বিস্তারিত অবগত হওয়ার ফলে, এবং সয়ং চীনা কমুনিষ্ট পার্টির সাধারন সম্পাদক ঝাও জিয়াং ছাত্রদের এ আন্দোলনের প্রতি তার ব্যক্তিগত সহানুভুতি ও সমর্থন ব্যাক্ত করায় হংকং এর প্রো-চাইনিজ ছাত্ররা প্রো-ডেমোক্রেটিভ ছাত্রদের সাথে তাদের দীর্ঘদিনের দুরত্ব ঘুচিয়ে একাত্মা ঘোষনা করেছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে এমতাবস্থায় হংকং এর ছাত্রদের পিছিয়ে থাকার কোন অবকাশ নেই বিধায় ছাত্র জনতার সকল দল ও গ্রুপের সমন্নয়ে বেইজিংমুখী ছাত্র ও জনতার দল গঠনের। ইতিপুর্বে প্রো-ডেমোক্রেটিভ ছাত্রদের সংগঠিত বেইজিংমুখী দলের সাথে প্রো-চাইনিজ ছাত্ররা যোগ দেয়ায় এ দলের সর্বশেষ সংখ্যা ৭৫ জনে উন্নীত হয়েছে। উল্লেখ্য যে প্রো-ডেমোক্রেটিভ ছাত্রদের প্রথম সংগঠিত এদলে আমি ইতিপুর্বেই সামীল হয়েছিলাম । সেদিন গভীর রাত অবধি চলতে থাকে বেইজিং যাত্রার যাবতীয় পরিকল্পনার বিবরন । সিদ্ধান্ত হয় ৩/৪ দিনের যাবতীয় প্রস্তুতি শেষে আগামী ২৭শে মে আমরা বেইজিং এর উদ্দেশ্যে আমাদের বহুল প্রত্যাশিত ঐতিহাসিক এ যাত্রা শুরু করবো।

ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দিপনা নিয়ে পরদিন থেকেই আমাদের বেইজিং যাত্রার যাবতীয় প্রস্তুতি শুরু হলো। বেইজিং এর এই ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাড়াও অভিবাসি ইচ্ছুক বাঙ্গালীদের একটি দল নিয়ে ট্রান্স-সাইবেরীয়ান ট্রেন যোগে ইউরোপ গমনের সম্ভব্যতা যাচাই ও তার প্রস্তুতির লক্ষে যাবতীয় তথ্য উপাত্ব সংগ্রহ ছিল ব্যক্তিগত ভাবে আমার প্রস্তুতি ও আয়োজনের দ্বিতিয় অন্যতম অংশ, সারাটা দিন সে সকল আয়োজনের উত্তেজনায় পার হয়ে গেল।

একদিন যেতে না যেতেই মুখে মুখে কিছুসংখ্যক নেতীবাচক সংবাদের প্রাচারে হটাৎ করেই আমাদের এ যাত্রা প্রস্তুতির সামগ্রীক দৃশ্যপট পালটে যেতে শুরু করলো। বেইজিংমুখী ছাত্র জনতার বিভিন্ন দলকে হংকং-সেনঝেন সিমান্ত থেকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ব্যাপক ভাবে তল্লাশী ও জিজ্ঞাসাবাদ চালানো হচ্ছে চিন অভিমুখের নিয়িমিত ও অনিয়মিত সকল যাত্রীকে। ছাত্রদের এ আন্দোলনের প্রতি প্রকাশ্যে সহানুভুতি ও সমর্থন প্রকাশ করে বক্তব্য রাখার অপরাধে চিনা কমুনিষ্ট পার্টির পলিটবুর্যো্র সর্বজন শ্রদ্ধ্যেয় সাধারন সম্পাদক ঝাও জিয়াং কে চিনা সরকার তার বেইজিং শহরস্ত বাসভবনে অন্তরিন করেছে, এ নেতীবাচক সংবাদটি এলো ঐদিন সন্ধ্যা নাগাদ। এ সংবাদের ফলে প্রো-চাইনিজ ছাত্রদের সকল প্রকার উৎসাহ-উদ্দিপনা হাওয়ায় বিলীন হলো এবং যাবতীয় দৃশ্যপট থেকে হটাৎ করেই তারা উধাও হয়ে গেল। এহেন অবস্থার প্রেক্ষিতে এখনো এ যাত্রায় সামীল হতে বদ্ধপরিকর প্রো-ডেমোক্রেটিভ ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিলো দলবদ্ধ না হয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে বেইজিং অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার। এবং ৩১শে মে সন্ধ্যায় বেইজিং এ সকলে একত্রিত হওয়ার স্থান নির্ধারন করা হলো, এবং সকলকে তা জানিয়ে দেয়া হলো। চিন অভিমুখী হংকং এর ছাত্ররা চিনা সিমান্ত বাহীনি কতৃক ব্যাপক তল্লাশীর শিকার হচ্ছে বিধায় আরও সিদ্ধান্ত নেয়া হল এ আন্দোলনের জন্য ছাত্রদের সংগৃহীত অর্থ বহন করবে শুধুমাত্র বিদেশী যাত্রীরা। জাপানের ছাত্র ফুকুদা, তাইওয়ানের ছাত্রী লী-রি, ভারতের তাজ সিং ও আমি এই বিদেশী গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। ২৭ শে মের প্রত্যুসে সেনঝেন সিমান্তের পরিবর্তে ততকালীন পর্তুগিজ কলোনী ম্যাকাও হয়ে চিন সিমান্ত অতিক্রমে আমরা চার জনেই একমত হলাম।
এখানে উল্লেখ্য যে, হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের শা তিন ক্যাম্পাসের বাইরেও সারা হংকং এর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাও অগ্নিঝরা এ আন্দোলনে সামীল থাকলেও সে মুহুর্থে এ বিষয়ে আমার জ্ঞান ছিল অত্যান্ত সীমিত। তবে সে সময়ের সামগ্রীক চিত্র আমার অজানা থাকলেও সীমিত ঐ পরিসরের উদ্দীপনা ও উত্তেজনা যেন আমার রক্তে নাচন ধরিয়েছিল। বয়স স্বল্পতার কারনে বাল্যবয়সে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অগ্নিঝরা মার্চের বা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের সেই ঐতিহাসিক উন্মাদনার সক্রিয় অংশ হতে পারি নাই বিধায় এতদিন আমার মাঝে যে দুঃখ ও ক্ষোভ ছিল, সেটা যেন অচিরেই দুরিভুত হওয়ার আলোকিত দারপ্রান্তে । মনে হচ্ছিল আমিও কোন মুক্তিকামী জনতার ঐতিহাসিক এক সংগ্রামের অংশ ও সাক্ষী হতে চলেছি।

চলবে......।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন