ইউরোপের পথে প্রান্তে - ১ম পর্ব

Submitted by WatchDog on Friday, November 6, 2009

Europe Travel Story

বিতেভ্‌স্কি রেল ষ্টেশনে পৌঁছতে রাত প্রায় ১১টা বেজে গেল। ঘড়ির সময়ে রাত হলেও সূর্য্যটা তখনও ডুবেনি। জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ, এ সময়টায় পৃথিবীর এ অংশে সূর্যাস্ত বলতে আমরা সাধারনত যা বুঝে থাকি তার দেখা পাওয়া বেশ র্দুলভ। রাত ১২ টার পর ফিকে হয়ে আসে সূর্য্যের তেজ, বাকি সময় পৌষের সকালের মত নিস্তেজ হয়ে ঘুরে বেড়ায় মধ্য গগনে। পুরো জুন মাস ধরে চলতে থাকে প্রকৃতির এই অভাবনীয় দৃশ্য। ’সাদারাত্রি’ উপভোগ করার জন্যে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ হতে হাজার হাজার ট্যুরিষ্ট ভীড় জমায় এ শহরে। সেন্ট পিটার্সবার্গ (প্রাক্তন লেলিনগ্রাদ), এ শুধু পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর শহরই নয়, এ শহরকে ঘিরেই এক সময় আবর্তিত হয়েছিল রাশিয়ার রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবন। জারতন্ত্রের রাজধানী এ শহরেই বাস করতেন বিখ্যাত রুশ কবি আলেক্সজান্ডার পুশকিন, এখানেই জন্ম নিয়েছিল ভ্লাদিমর ইলিচ লেনিনের নেত্রীত্বে সর্বহারাদের বলশেভিক বিপ্লব। এ শহরের প্রতিটা ইট কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের সময় টানা ৮৭২ দিন ঘেরাও ছিল এ শহর, হিটলার বাহিনীর এ ঘেরাও কেড়ে নিয়েছিল ১২ লাখ শহরবাসীর জীবন। বলা হয় মূলত এ শহর হতেই শুরু হয়েছিল নাৎসী বাহিনীর পতন।

এলোমেলো চলাফেরার ভীড়ে ট্রেনটা খুঁজে পেতে বেশ কষ্ট হল। ১১টা ৫৫মিনিটে ছেড়ে যাবে বার্লিনগামী লেনিনগ্রাদ এক্সপ্রেস ট্রেনটা। গ্রীষ্মের ছুটিতে কাজ করতে লন্ডন যাচ্ছি আমরা তিন বন্ধু; ইসলাম, রহমান এবং আমি। রহমান আগের গ্রীষ্মে ঘুরে গেছে লন্ডন, তারই পরিকল্পনায় এবার যোগ হয়েছি আমরা বাকি দুই জন। ইউরোপ তুলনামূলক ছোট মহাদেশ এবং এর দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে উন্নত রেল যোগাযোগ। সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে লন্ডন আক্ষরিক অর্থেই লম্বা জার্নি; রুশ সীমান্ত পার হয়ে প্রথম ষ্টপেজ হবে পোলান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে, পরবর্তী ঠিকানা পূর্ব জার্মানীর রাজধানী পূর্ব বার্লিন, এখানেই বিদায় জানাতে হবে পূর্ব ইউরোপকে এবং ছাড়তে হবে রুশ ট্রেনটা। একে একে পায়ে হেটে অতিক্রম করতে হবে ঐতিহাসিক বার্লিন দেয়াল, পশ্চিম বার্লিন হতে ধরতে হবে পশ্চিম জার্মানী হয়ে হোক ভ্যান হল্যান্ডগামী নেদারল্যান্ডের ট্রেন, বন্দর শহর হোক ভ্যান হল্যান্ড হতে জাহাজে করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হবে ইংলিশ বন্দর হারউইচ, এবং এই হারউইচ হতে ট্রেনে চড়ে পৌঁছ্‌তে হবে আমাদের শেষ গন্তব্যে, লন্ডনের লিভারপুল ষ্টেশন। সফলভাবে এ জার্নির সমাপ্তি হলে জীবন হতে ইতিমধ্যে খসে যাবে পূরো দু'টা দিন এবং দু’রাত্রি। পথে অপেক্ষা করবে হাজারও অনিশ্চয়তা, এমনটা জেনেও জার্নির ধারণা মাথায় নিতে সাহষ করেছি রহমানের কারণে। কলম্বাস কায়দায় ইতিমধ্যে সে আবিস্কার করে ফেলেছে 'র্দুগম' এ পথ, এবং এর সূবিধা অসূবিধাগুলো তিন জন সাথে থাকলে কোন ব্যাপারইনা এমনটা বুঝিয়ে রাজী করিয়েছে আমাদের দু’জনকে। এমনিতেই শীতের দাপানিতে ক্লান্ত ছিলাম আমরা, তার উপর সমাজতান্ত্রিক আইন কানুন মানতে গিয়ে তেতিয়ে উঠেছিল আমাদের জীবন। ইউরোপের এ অঞ্চলে শীতের ব্যাপ্তি প্রায় ৭ মাস। ডিসেম্বর এবং জানুয়ারীতে তাপমাত্রা অনেক সময় -৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্য্যন্ত নেমে যায়। প্রচন্ড শীতের সাথে যোগ হয় তুষার ঝড়, সূর্য্যের দেখা মেলেনা মাসের পর মাস। একনাগাড়ে এমন একটা পরিবেশে বাস করলে শরীর এমনিতেই কাহিল হয়ে আসে, বিষন্নতায় বন্দী হয়ে যায় জীবনের ছন্দ। নতুন সেমিষ্টার শুরু হওয়ার আগে এমন একটা ব্রেকের দরকার ছিল আমাদের, তাই রহমানের প্রস্তাবে রাজী হতে ভাব্‌বার বিশেষ কোন প্রয়োজন হলনা।

ট্রেনের ভেতরটা দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল প্রশান্তিতে। চার জনের শোয়ার ব্যবস্থা সহ ছোট ছোট বিলাসী কামড়ায় ভাগ করা প্রতিটা বগি। কামড়াগুলোর পাশ দিয়ে চলে গেছে কার্পেট বিছানো কড়িডোর। ৬টা কামড়ার জন্যে একটা করে টয়লেট, ট্রেনটায় ঢুকার মুখে ছোট একটা কামড়া যেখানে সমস্ত আয়োজন নিয়ে বসে আছে একজন হোষ্ট। এক কথায় লম্বা জার্নির পার্ফেক্ট আয়োজন। ‘দব্রে বেহেচর চর্নাঝপিয়ে রিবিয়াতা‘, শুভ রাত্রি কালো নিতম্বের বালকগন, এমন একটা সম্ভাষনে গালাগালির চাইতে উষ্ণতার ছোয়াই ছিল বেশী। মধ্য বয়সী হোষ্ট ইলেনা দিমত্রিয়েভ্‌নাকে আপন করে নিতে বেশী সময় ব্যয় হলনা আমাদের। নির্ধারিত সময়ের এক মিনিটও দেরী হলনা ট্রেনটা ছাড়তে। বাতাসে লম্বা দু’টা হুইসেল ছড়িয়ে হিস হিস শব্দে বেরিয়ে গেল প্ল্যাটফর্ম হতে। শুরু হল আমাদের যাত্রা।

-চলবে

দ্রষ্টব্যঃ ভ্রমন কাহিনীর সময়কাল ৭০ দশকের শেষ ভাগ।


ভালো লাগলে শেয়ার করুন