সীমান্তের এপার ওপার (ওপার) পর্ব ৬

Submitted by WatchDog on Saturday, May 23, 2009

বৃষ্টি পড়ছে সকাল হতে। প্রথমে গুড়ি গুড়ি তারপর হুড়মুর করে। দিগন্ত রেখায় সান্ডিয়া পাহাড়ের অবস্থানটা গ্রাস করে নিয়েছে সাদা মেঘরাশির দৈত্যমেলা। জানালাটা খুলে আজ আর দেখা মিল্‌লনা পাহাড়ের চূড়াটা, পূবের আকাশে আজ শুধুই মেঘের খেলা। প্রকৃতির এমন বিরামহীন কান্নার সাথে আমেরিকার হিংস্র পশ্চিম খুব একটা পরিচিত নয়, এখানে সূর্য্য রাজত্ব করে বেড়ায় বছর জুড়ে। গড় পড়তায় ৮ ইঞ্চির বেশী বৃষ্টি হয়না এ অংগরাজ্যে। ডিসেম্বর জানুয়ারীর হাড় কাপানো শীত আর মাঝে দু'একদিনের তূষারপাত বাদ দিলে সত্যিকার অর্থেই অঞ্চলটা ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েষ্ট। দু'বছর আগে নিউ ইয়র্কের মেগালাইফ পেছনে ফেলে এমন একটা ছোট শহরে পা রাখতেই চমকে উঠেছিলাম আমেরিকার অন্য এক ছবি দেখে।

নিউ মেক্সিকো! নামের ফাদে ধরা পরার ভয়েই হয়ত ইংল্যান্ডের ইয়র্ক শহরের নামটাতে নিউ শব্দটা জুড়ে নামকরন করা হয়েছিল আজকের মেগা সিটি নিউ ইয়র্কের। তেমনি মেক্সিকো হতে দখল নেয়া অংশটুকুতে মেক্সিকান ঐতিয্য বৈধ করার জন্যেই হয়ত নিউ শব্দটা সংযোজন করে অংগরাজ্যের নাম রাখা হয়েছে নিউ মেক্সিকো। শহরের কেন্দ্র হতে বের হয়ে হাইওয়ে ধরলেই চোখে পড়বে আমেরিকান বৈচিত্র, সত্যিকার অর্থেই এ যেন মেক্সিকো। মেক্সিকান এবং আদিবাসী আমেরিকান-ইন্ডিয়ানদের জীবন আর দশটা সাধারন আমেরিকানদের মত নয়, এ পার্থক্যটা দেখতে শহরতলীর কোন এক লোকালয়ে গেলেই চোখে পরবে। তামাটে চেহারা, লম্বাচুলের পেছনে ঝুটি আর এলোমেলো পথচলার কাউকে দেখলে ধরে নিতে হবে র্নিঘাত রেড ইন্ডিয়ানদের কেউ। এদের সমস্ত শরীর জুড়ে অবহেলা, অনাদর আর দারিদ্রের ছোয়া, প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে একদল গৃহহীন জিপসী। কিন্তূ আসলে তা নয়, ঐতিয্যবাহী পোশাক আর চলাফেরায় আলস্যভাব হতে ওরা বোধহয় বেরিয়ে আসতে চায়না, তাই প্রথম দর্শনে এদের দারিদ্রের ভাবটাতেই চোখ আটকে যায়। কিন্তূ মানুষ হিসাবে এরা অন্য দশটা আমেরিকানদের মতই, পার্থক্য শূধু চেহারায় আর পোশাকে।

আল্‌বকুরকে শহর হতে এ রাজ্যের রাজধানী সান্‌টা ফে'র দূরত্ব ৫৭ মাইল। পাহাড়ের বুক চিড়ে হাইওয়েতে ড্রাইভ করার অন্যরকম অভিজ্ঞতা পেতে হলে এমন একটা জার্নির কোন বিকল্প নেই। চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়, চূড়াগুলো স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালের স্বাক্ষী হয়ে। সাপের মত আকাবাকা আর উত্তাল ঢেউয়ের মত উচুনীচু পথ দিগন্ত রেখায় মিশে অদ্ভূত এক ভৌতিকতার সৃষ্টি করে, যা মরীচিকার হয়ে আমন্ত্রন জানায় নৈশব্দিক পৃথিবীতে। খোলা পাহাড়ি এলাকায় হতশ্রী রেড ইন্ডিয়ানদের রিজারভেশন গুলো মার্কিনীদের এমন এক অধ্যায় খুলে দেয় যেখানে সবকিছুই ঝমকালো অথবা ঝাঝালো নয়। মাটির ঘরবাড়ি সাথে ইন্ডিয়ানদের ঐতিয্যবাহী মৃৎশিল্প ক্ষনিকের জন্যে হলেও বিভ্রান্ত করবে, এ কোথায় আমি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে না মধ্য আমেরিকার কোন উন্নয়নশীল দেশে! হাইওয়ের খোলামেলা আকাশ ফুড়ে সহসাই হাজির হবে ক্যাসিনোর ঝলমলে আলো। সান ফেলিপে পুয়েবলো দিয়ে শুরু, এরপর আসবে সান্‌তা এ্যনা সহ ছোট বড় অনেক ক্যাসিনো। এই ক্যাসিনোই রেড ইন্ডিয়ানদের রুজি রোজগারের প্রধান এবং অনেক ক্ষেত্রে একমাত্র মাধ্যম। আল্‌বকুরকে শহরকে চারদিক হতে ঘেরাও করে রেখেছে রেড ইন্ডিয়ানদের ক্যাসিনো। Sandia, La Isleta, Route 66'র মত ক্যাসিনো গুলো কাজ করছে ২৪ ঘন্টা, ৩৬৫ দিন। তামাটে মুখ এবং মোটা থ্যাবড়ানো শরীরের হাজার হাজার রেড ইন্ডিয়ান গায়ে গতরে খাটছে ক্যাসিনো গুলোতে। কাজের শেষে এই ক্যাসিনোরই কোন এক স্লট মেশিনে আয়ের সবটুকু ঢেলে কপর্দ্যশূন্য হয়ে বাড়ি ফিরছে তারা। ড্রাগ এবং জুয়া, এ দু'টোর জয়জয়কার আদিবাসীদের ঘরে ঘরে। এ বাস্তবতা কাগজের লেখায় পড়ে উপলদ্বি করা কষ্টকর, Santa Domingo পুয়েবলোর মত যে কোন ইন্ডিয়ান reservation'এর ফটকে পা রাখলেই এর নির্মম বাস্তবতা চোখে পরতে বাধ্য।

অনেক সময় ভূল হতে বাধ্য আদিবাসীদের মেক্সিকান হতে আলাদা করতে। চেহারায় অনেকটা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে এই দুই জাতি স্বত্তা। মাথায় সাদা হ্যট এবং পায়ে তীক্ষ্ম সরু বুটের সাবলীল চলাফেরার কাউকে দেখলে ধরে নিতে হবে সে মেক্সিকান; ঝাল, মেয়ে মানুষ, মদ আর লাগামহীন সন্তানাদী তৈরীর রুপকথার নায়ক মেক্সিকান মারিয়াচী। এদের জীবন নিয়ে লিখতে গেলে এই ক্ষুদ্র পরিসর কুলিয়ে উঠবেনা, তার জন্যে চাই বৃহত্তর পরিধি। আজ নয়, সময় করে অন্য এক পরিবেশে লেখা যাবে এদের কাহিনী। বাইরে আজ বৃষ্টির চমক, প্রকৃতির এ কান্নাকে উপেক্ষা করার মত সাহস নেই আমার। এ বর্ষন প্রবাসে নয়, বাড়ির পাশে বয়ে যাওয়া মেঘনা নদীর মধ্যরাতের কান্নার মত এ বর্ষন।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন