সীমান্তের এপার ওপার (এপার) - পর্ব ৪

Submitted by WatchDog on Saturday, April 25, 2009

মেঘনা পারের মানুষ আমরা। জন্ম নিয়েই দেখেছি কি করে নদী আর মানুষ মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় জীবন স্রোতে। ভরা বর্ষায় মেঘনার উত্তাল গর্জন কান পাতলে শোনা যেত হূদয়ের খুব গভীরে, আবার সেই মেঘনাই শীতের কুয়াশায় আধমরা হয়ে হারিয়ে যেত উজান চরের বাকে। প্রতি বছর মাঘের শেষ বুধবার মরা নদীর পাড় ঘিরে জমে উঠত বাউলের মেলা। দূর দূরান্তের অনেক বন্দর হতে মাঝিরা সওদা বোঝাই ডিঙি ভেড়াত মেলার হাটে, লাল নীল সবুজ রঙের বাহারী পালে ছেয়ে যেত খেয়াঘাট। আমরা ভাইবোনরা দলবেধে সকাল বিকাল উপভোগ করতাম মেলার চোখ ধাধানো আসর। ৭ দিন ধরে চলত মেলার আয়োজন যার জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকতাম বছরের বাকি ৩৫৮ দিন। প্রায় ২০ বছর পর কৈশোরের সেই মেঠোপথে হাটতে গিয়ে বার বার হোচট খেলাম স্মৃতির মনিকোঠায়। সেই মেঘনা একই জায়গায় দাড়িয়ে, কুলে দাড়িয়ে দুহাত বাড়ালে সেই পুরানো বাতাস বুকে টেনে নেয়। কিন্তূ কোথায় যেন কি একটা নেই, অকৃত্তিম উচ্ছাসে কোথা যেন কিসের ঘাটতি। আসলে এসব কিছু নয়, বয়স হয়ে গেছে হয়ত। নদীকে ভালবাসার ভেতর অন্যরকম একটা আনন্দ ছিল সেটা বোধ হারিয়ে গেছে। এমন কাউকে খূজে পেলাম না যার মাঝে ২০ বছর আগের নিজকে দেখতে পাব, নদী তীরে খালি পায়ে হাটা এখন বোধহয় আর বাঙালীপনা নয়। অথচ প্রতিদিন গোধূলী বেলা খেয়াঘাটে সূর্য্য ডোবা না দেখলে দিনটাই মনে হত অসমাপ্ত। মাঝে মধ্যে গুন টানা নৌকায় চড়ে মেঘনার আশপাশের জনপদে বেড়ে উঠা সর্ষে খেতের হলুদ সমুদ্রে হারিয়ে যেতে কি যে ভাল লাগত তা ভাষায় বর্ণনা করার মত ছিলনা।

এত বছর পর বাড়ি ফেরার শুরুটা মোটেও ভাল হয়নি। আমাদের অর্ধশতাব্দি পুরানো শিল্প প্রতিষ্ঠানটা বাইরে যত চকচক করছিল ভেতরের অবস্থা খুজে পালাম ঠিক উলটো। ক্ষয় রোগ ধরেছে সব কিছুতে, মূল্যবোধের ক্ষয়! পংগপালের মত একদল রক্তখেকো পশু মাস শেষ না হতেই ভীড় জমায় নগদ কিছুর দাবি নিয়ে। বাবা বেচে থাকতে যাদের দেখেছি চোখ তুলে কথা বলতনা তারা এখন এ শহরের অভিবাবক, এবং আমাদের রাতের অতিথি। ’৭১এর এপ্রিলে আমাদের শহর লন্ডভন্ড হয়ে যায় পাকিদের বিমান হামলায়, এককালের জমজমাট বাজার দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে যুদ্বের স্বাক্ষী হয়ে। দিনটা কিছুতেও ভূলার ছিলনা। আগের দিন শহরের নামী ক’জন ছাত্রনেতা বিহারী কলোনীর বেশ ক’জন অসহায় মানুষকে ব্রাশ ফায়ারে মেরে মেঘনার পানি লাল করে তুলে। সকাল হতেই বোমারু বিমানের গুর গুর আওয়াজে কাপতে শুরু করে শহর। ভয়াবহ শব্দে আকাশ হতে উড়ে আসতে শুরু করে আগুনের গোলা। পুড়ে ছাই হয়ে যায় আমাদের বাড়ির একাংশ। বাজারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বলতে যা ছিল তা দিনের শেষে মাটিতে সাথে মিশে যায় ভোজবাজির মত। চোখ বুজলে আজও দেখতে পাই সে দিনটার ছবি; শহর জ্বলছে, মানুষের কাফেলা উন্মত্ত হয়ে ঝাপিয়ে পরছে লুটপাটের মহোৎসবে। ২০ বছর পর এই লুটেরাদের অনেককেই দেখলাম নতুন সাজে; কেউ বিশিষ্ট শিল্পপতি, কেউ ডকসাইটে রাজনীতিবিদ, কেউবা আবার নামকরা মাওলানা। আমি যাদের চিনলাম তাদের অনেকে আমাকে চিনলান অথবা চিনতে চাইলনা।

প্রথম ধাক্কাটা এল শ্রম দপ্তর হতে। অফিসে বসে আছি, পিওন এসে জানাল ঢাকা হতে এক ভদ্রলোক এসেছেন স্যুট টাই লাগিয়ে, কথা বলতে চান আমার সাথে। আমার এক ভাইকে বললাম চৈত্র মাসের ভর দুপুরে কেন এই বেচারা ঢাকা হতে এসেছেন তা জেনে আমাকে রিপোর্ট করতে। মিনিটের ভেতর ফিরে এসে গাল ভরা হাসি দিয়ে ভাই জানাল, এ শ্রম দপ্তরের ইলিয়াস আলী সাহবে, এসেছেব বাৎসরিক তোলা তুলতে। প্রতি বছরের ট্রাডিশনাল অংক এবার উনি মানতে চাইছেন্‌না, দাবি আরও অনেক বেশী।

লম্বা সালাম দিয়ে পরিচয় প্রকাশ করলেন, হাজী ইলিয়াস আলী, পরিদর্শক। উনার অভিযোগ, আমাদের কারখানায় শ্রমিকদের স্বার্থ দেখা হচ্ছেনা, ঢাকায় কেউ নালিশ করেছে। ভনিতা না করে সড়াসড়ি জিজ্ঞেষ করলাম, কত পেলে খূশী হবেন। বিরাট অংকের দাবি, তাই পরের সপ্তাহে আসতে বল্‌লাম,

মাথায় একটা বুদ্বি খেলে গেল। মিনি একটা ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল আমার, ওটাকে ব্যবহার করতে হবে। ইতিমধ্যে শহরের অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান হতে এই ইলিয়াস আলীর চরিত্রের কিছুটা নমুনা যোগাড় করে রাখলাম, প্রয়োজনে কাজে লাগাব বলে। রেকডিং ব্যবস্থা পাকা করে রাখলাম বেচারার আসার আগের দিন।

আবারও সেই স্যুট কোট! এবার সড়াসড়ি চলে এলেন আমার কক্ষে, বিনা আমন্ত্রনে বসে পরলেন ভগবানের মত। খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞেষ করলাম প্রতি বছর যে চাঁদা তোলা হয় তা যায় কোথা। সব কিছুর জন্যে উনি কুৎসিত ভাবে দায়ী করলেন ঢাকার মহাপরিচালককে। ঘুষখোর, চরিত্রহীন আখ্যা দিয়ে চৌদ্দগুষ্টি উদ্বার করলেন নিজ বসের। দশ মিনিট সময় চাইলাম এবং এই দশ মিনিটে পরখ করলাম অডিও রেকর্ডিং, পারফেক্ট! আবার ডেকে পাঠালাম ইলিয়াস আলীকে। খুব ঠান্ডা মাথায় ক্যাসেটটা বাজিয়ে শোনালাম, আপনি হতে তুই তুকারীতে নেমে আসলাম। বিনা নোটিশে বিদ্যুৎ গতিতে ঝাপিয়ে পরল পায়ের উপর, দোহাই দিল নাবালক সন্তানাদির। আমিও কড়া হতে পারলামনা, ক্ষমা করে দিলাম দুটা শর্তেঃ আশপাশের কারখানা হতে উঠানো আড়াই লাখ টাকা নিয়ে দু’দিন পর ফিরে আসতে হবে, এবং অফিসের মেঝেতে নাক খত দিতে হবে। অস্বীকার করলে আজকেই ঢাকা গিয়ে ডিজি সাহেবের সাথে কথা বলব।

রাজনীতির পরাগাছাদের সাথে ছিল এ আমার প্রথম লড়াই, যে লড়াই চলবে সামনের আরও ৩টা বছর।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন