সীমান্তের এপার ওপার (পত্মীতলার ডায়েরী) - পর্ব ৩

Submitted by WatchDog on Thursday, April 23, 2009

দুপুর গড়াতেই শীতের আগমনী বার্তা প্রকৃতির সাথে মানুষের কাছেও পৌছে যায় বিনা নোটিশে। সূর্য্যটা হেলে পরে পশ্চিম আকাশে, খন্ড খন্ড মেঘ চাদরের মত আকড়ে থাকে দিগন্ত রেখায়। যে দিনের শুরুই হয়নি তাকে বিদায় জানাতে ব্যস্ত হয়ে পরে সীমান্তপারের মানুষগুলো। পত্নীতলা; উপজেলা শহরের এমন একটা ভূতূরে নাম থাকতে পারে প্রথমটায় শুনে বিশ্বাষ হয়নি। পত্নীতলা, বদলগাছি, ধামইরহাট, এ গুলো নিয়ে বরেন্দ্র এলাকা। উন্নতির ছোয়া বলতে অটোমেটিক ক’টা রাইস মিল, এ ছাড়া চোখে পরার মত কিছু নেই বল্‌লেই চলে। চারদিকে মাইলের পর মাইল ধান ক্ষেত। সবুজের চোখ ধাধানো তরংগ মেলার সাথে খেটে খাওয়া মানুষের বেচে থাকার লড়াই, এ নিয়েই অনুন্নত বরেন্দ্র মানুষের জীবন। রাজশাহী হতে বাসে প্রায় ৮০ কিলোমিটারের জার্নি। অবহেলিত উত্তর বাংলার জীবনকে স্লো মোশনে দেখতে হলে এ জার্নির কোন বিকল্প আছে বলে জানা নেই। প্রকৃতির সাথে মানুষের লড়াই কত বহুমূখী এবং চীরন্তন হতে পারে উত্তর বাংলার জনপদ গুলিকে কাছ হতে না দেখলে বিশ্বাষ করা কষ্টকর। বাসের ভেতরটা খালি রেখে মানুষগুলো কেন যে ছাদের উপর চড়তে ভালবাসে, এর উত্তর খুজে পেতে আজও কষ্ট হয়।

বিদ্যুৎ দিতে হবে বরেন্দ্র এলাকার হাজার হাজার গভীর নলকুপ গুলোতে, খরচ কমাতে হবে ধান উৎপাদনের। এমন একটা দায়িত্ব নিয়ে বিএডিসি এবং পিডিবির চুক্তিবদ্ব উপদেষ্টা হয়ে যেতে হয়েছিল ঐ এলাকায়। সবেমাত্র ১১ বছর ইউরোপীয় জীবন শেষে দেশে ফিরেছি, নতুন বাস্তবতার সাথে নিজকে খাপ খাইয়ে নিতে দিনের পর দিন চেষ্টা করে যাচ্ছি। লন্ডন হতে পত্মীতলা, - এমন একটা সমীকরনের জন্যে মোটেও তৈরী ছিলামনা, তাই চাকরীর নতুন জায়গাটার কথা ভাবতেই শিউড়ে উঠতে হল। কিন্তূ রক্তের ভেতর নতুনের ডাক আমাকে নেশার মত টানে, তা ছাড়া নিজ জন্মভূমিকে অনেকদিন কাছ হতে দেখা হয়নি, তাই রাজি হতে খুব একটা ভাবতে হলনা। কাধে ঝুলানো রুগস্যাগ আর হাতের ছোট ব্যাগট নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম অজানার উদ্দেশ্যে। ঠিকানা; নওগা জেলার পত্মীতলা।

পত্মীতলা পৌছে হোটেলের খোজ করতেই মাথায় আকাশ ভেংগে পরল, হোটেল বলতে ওখানে শুধু ক’টা ভাত খাওয়ার হোটেল। চারদিকে খোজ লাগিয়ে সন্ধান পেলাম একটা আশ্রয়ের, বাস ষ্ট্যান্ডের পাশের দালানটার প্রথম তলা ভাড়া দিতে রাজী হল ২০ বছর বয়ষী বাড়িওয়ালা। কেনাকাটির ম্যারাথন শেষ হতে সন্ধ্যা নেমে এল লোকালয়ে। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পরে পত্মীতলা সত্যিকার ধুম্রজালের সৃষ্টি করল, সাথে ঠক ঠকানো শীত। মধ্য এবং উত্তর ইউরোপের ভয়াবহ শীতের সাথে পরিচয় অনেক দিনের, কিন্তূ উত্তর বাংলার এমন নেংটা শীতের কাছে কাবু হব তা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। কিন্তূ তাই হল, রাত যত বাড়তে থাকল শীতের তীব্রতা বাড়তে থাকল জ্যামিতিক হারে। সদ্য কেনা লাল শালূর লেপটা কোন কাজেই লাগলনা। আমাদের দালানটার তিনদিকে ধান খেত, একপাশে কাচাপাকা একটা রাস্তা চলে গেছে পার্শ্ববর্তী বদলগাছি উপজেলায়। উত্তরের কনকনে হাওয়া শরীর ভেদ করে দক্ষিনে চলে যায় বীরদর্পে, আর আমি বোবা হয়ে এপাশ ওপাশ করতে থাকি কখন সকাল হবে। পৃথিবীর বহু দেশে বহু অভিজাত হোটেলে সকাল হতে দেখেছি, কিন্তূ বাংলাদেশের একপ্রান্তে এমন মায়াবি সকাল দেখব তা আশা করিনি।

ফজরের আজান হতে তখনও অনেক বাকি। তন্দ্রামত এসেছিল, কিন্তূ সে তন্দ্রা ছুটে গেল টুং টাং শব্দে। দরজা খুলতেই সাপের মত হিসহিস শব্দে ঘন কুয়াশা ঢুকে পরল আমার রুমটায়। দু’হাত দূরে কি ঘটছে তা দেখার উপায় নেই। চেয়ারটা বাইরে টেনে বসে পরলাম র্দুলভ কিছু দেখার আশায়। টুং টাং শব্দটার উৎস খুজতে চারদিকে চোখ বুলালাম। কুয়াশার বুক চিরে ভূতের মত উদয় হল একটা মহিষের গাড়ি। মহিষ দু’টোর গলায় ঝুলানো ঘন্টা হতে আসছে শব্দটা। গাড়িয়ালের শরীর আপদমস্তক চাদরে মোড়া, গাড়িটার দু’দিকের দুই খোলা মুখও চাদরে আবৃত। ভেতর হতে ক্যাসেটে হাèা ভাটিয়ালি গানের আওয়াজ। যেমন ভূতের মত উদয় হয়েছিল ঠিক তেমনি আবার মিলিয়ে গেল ভূতের মত। দ্বিতীয় গাড়িটার জন্যে বেশীক্ষন অপেক্ষা করতে হলনা, একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। পর্দা ছিড়ে ওরা বেরিয়ে আসে ভোজবাজইর মত, আবার মিলিয়ে যায় পর্দার অন্তরালে। শুধু টুং টাং শব্দের রেশটা স্থায়ী হয় কিছুক্ষন। অনেকক্ষন ধরে চলল আলো আধারীর এ খেলা। ফজরের আজানের সাথে হাওয়ার মত মিলিয়ে গেল সব কিছু। সকাল হতেই বাড়িওয়ালার কাছে জানতে পারলাম এর রহস্য। বাংলাদেশের এ অংশের মানুষের জীবন ধানের জীবনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে বেড়ে উঠে। এক একটা ধানী ফসলের শেষে মানুষ উৎসবে মেতে উঠে, বাপের বাড়ি নাইওর যাওয়ার সময় এটা। রক্ষনশীল সমাজের রক্তচক্ষু হতে রেহাই পাওয়ার জন্যে গৃহবধুদের রাতের ভ্রমন করতে হয়। পায়ে আলতা, লালপেড়ে শাড়ী আর সাথে ক্যাসেটপ্লেয়ারে ভাটিয়ালী গান, - দিনের আলোতে এমন ছবি সমাজে গ্রহনযোগ্য নয়, তাই রাতের এই অভিসার। এ এক মহাকাব্যিক উপন্যাসের উপাদান যেন, আমি থ হয়ে হাতড়ে বেড়ালাম অতীত অভিজ্ঞতার ঝুলি।

এমন দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি চলল রাতের পর রাত। আমিও ঘন কুয়াশায় ঘাপটি মেরে উপভোগ করে গেলাম এ রহস্যময় দৃশ্য পরবর্তী এক মাস। ধানের দেশে নতুন ধানের সময় হতেই মানুস ফিরে যায় আপন ঠিকানায়, শুরু করে নতুন লড়াই। কান পাতলে আজও হয়ত শুনতে পাব সেই টুং টাং শব্দ আর ভাটিয়ালি গানের সূর। এক জনম হয়, শত জনমের শ্বাশত সৃত্মি হয়ে বেচে থাকবে পত্মীতলার ক’টা মাস।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন