হাওরাঞ্চলের মুকুটহীন সম্রাট এমপি রতন

মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। নিজ এলাকায় এখন অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ধরমপাশা, জামালগঞ্জ ও তাহিরপুরÑ এ তিন উপজেলার নির্বাচিত অভিভাবক তিনি। সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা অনেক ত্যাগী নেতাকে কোণঠাসা করেছেন তিনি। সবাইকে এড়িয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন মহাজোটের। এখন তিনি হাওরাঞ্চলের মুকুটহীন সম্রাট। তার ইশারায় নিয়ন্ত্রিত হয় হাওরাঞ্চলের সবকিছু। দেশের সর্ববৃহৎ মৎস্য ভাণ্ডারসহ এলাকার সবক’টি জলমহাল, পাথর কোয়ারি ও শুল্ক স্টেশন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তার ডজনখানেক ‘পিএস-এপিএস’। কথিত এ পিএস-এপিএসদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে এসব খাত থেকে। তাদের নিয়েই গঠন হয় রতনের অঘোষিত সিন্ডিকেট। এমপির ছত্রছায়ায় থাকা এ সিন্ডিকেটের হুকুম তামিল করতে হয়রান তিন উপজেলা-থানা প্রশাসন। এমপি রতন ও সিন্ডিকেট ক্ষমতার এপিঠ-ওপিঠ হয়ে ওঠায় চারদলীয় জোট সরকারের সময়ের লুটপাটকারীরাও হাত মেলায় এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে। সঙ্গত কারণেই এমপি রতন হয়ে ওঠেন এ সিন্ডিকেটের প্রধান। এসব লুটপাটের প্রতিবাদ করলে নানা হয়রানির শিকার হতে হয় প্রতিবাদকারীকে। সরাসরি আক্রমণ ছাড়াও প্রতিবাদকারীদের ফাঁসানো হয় বিভিন্ন মিথ্যা মামলায়। এমপির মনোনীত সিন্ডিকেটই যেখানে সর্বেসর্বা, সেখানে অনেকটা অসহায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। রতন বাহিনীর নির্যাতন, হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। দুর্নীতি ও লুটপাটের প্রতিবাদ করে তার সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত হন জামালগঞ্জ উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শামীমা শাহরিয়ার। উপজেলা মাসিক সমন্বয় সভা চলাকালে সন্ত্রাসীরা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের ওপর হামলা চালায়। প্রতিবাদে সিলেট ও সুনামগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন।

কে এই রতন? সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার পাইকুরাটি ইউনিয়নের নওদা গ্রামে জš§ মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের। তার পিতা মৃত আবদুর রশীদ ওরফে দারোগা আলী ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক। তার ৪ ছেলে ৩ মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। ১৯৮৮ সালে বাদশাগঞ্জ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে রতন এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। পরে অবশ্য তিনি দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাস করেন। কর্মমুখী শিক্ষার জন্য তিনি সিলেট পলিটেকনিক কলেজে ভর্তি হন। ১৯৯৩ সালে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং (পাওয়ার টেকনোলজি) পরীক্ষা পাস করেন ২য় বিভাগে। পরে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলায় বিআরটিএ’র টেলিফোন বিভাগে কিছুদিন চাকরি করেন। সেখান থেকে অবৈধভাবে গোপনে ভিওআইপি ও কলিং কার্ডের ব্যবসা শুরু করেন। রতনের সঙ্গে প্রাইমারি স্কুল থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন এমন অনেক সহপাঠী জানান, রতনের বাবা কৃষক হলেও তাদের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ভূ-সম্পত্তি ছিল না। গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভের আগ পর্যন্ত রতন কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি-না তা স্পষ্ট জানা যায়নি। এমপি হওয়ার পর রতন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সুনামগঞ্জ-১ আসনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সাবেক এমপি সৈয়দ রফিকুল হক সোহেল ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরোধকে কাজে লাগিয়ে রহস্যজনকভাবে রতন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী হন। এরপর ভোটের জোয়ারে অচেনা-অজানা রতন বনে যান এমপি। তার পরের কাহিনী সব কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। রতনের হাতে যেন আলাদীনের চেরাগ ধরা দিয়েছে, যার দ্বারা তিনি শুধু নিজেই নয়Ñ আশপাশে থাকা সুলতানরাও আড়াই বছরে বাড়ি-গাড়িসহ নগদ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

ঘুরে যায় ভাগ্যের চাকা : ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করে রতন জগন্নাথপুরের টিএন্ডটি অফিসে কিছুদিন কাজ করে চলে যান সিলেটে। নগরীর অভিজাত এলাকা উপশহরে শুরু করেন অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা। নিজের নামে, স্ত্রীর নামে ও অন্যান্য নামে-বেনামে টেলিফোন সেট সংগ্রহ করে গোপনে ভিওআইপি ব্যবসা চালিয়ে যান। ওই ব্যবসা রাতারাতি তার ভাগ্য খুলে দেয়। ঘুরে যায় তার ভাগ্যের চাকা। খুব কম সময়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠেন। সিলেট ছেড়ে পাড়ি জমান ঢাকায়। জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার পর মহাজোটের ভোট জোয়ারে ভেসে রতন এখন এমপি, হাওরাঞ্চলের অঘোষিত রাজা। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রায়ই তিনি পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন। এমপি হওয়ার পরপরই তিনি সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসককে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে ক্ষমতা প্র্যাকটিস করেন। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক গোপন প্রতিবেদন প্রেরণ করেছিলেন কেবিনেট সচিবের কাছে।

দল না করেই মনোনয়ন : দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোন সম্পৃক্ততাই ছিল না রতনের। তবুও দলের অনেক ত্যাগী ও বাঘা বাঘা নেতাকে পাশ কাটিয়ে অদৃশ্য জাদুর ছোঁয়ায় মহাজোটের মনোনয়ন ছিনিয়ে নেন রতন। অথচ মাত্র এক বছর আগে ২০০৮ সালের উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার খায়েশে পোস্টার লাগিয়েছিলেন তিনি। এমপির ঘনিষ্ঠজনদের দাবি, জনৈক প্রবাসীর মাধ্যমে কোটি টাকায় রতন আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। নির্বাচনে বিনিয়োগের সেই টাকা তুলতেই তিনি সিন্ডিকেটকে চাঁদাবাজির সুযোগ করে দিয়েছেন।
পিএস-এপিএস সিন্ডিকেট : সংসদ সদস্য রতনের ডজনখানেক কথিত পিএস-এপিএস নিয়ে গঠিত সিন্ডিকেটের কয়েক সদস্যের নাম ও অবস্থান জানা গেছে। এর মধ্যে ৪ জন থাকেন ঢাকায়, আরও ৬ জন থাকেন নির্বাচনী এলাকার ৩ থানায়। ঢাকায় থাকেন আর্নিক, শামীম, সেলিম ও কবীর। ৩ উপজেলার সধ্যে ধরমপাশায় বশির ও অপর এক সহযোগী, জামালগঞ্জে দেওয়ান আলী ও রফিক, তাহিরপুরে পলাশ ও কাইয়ুম। এদের ছাড়াও রতনের আরও ৫ জন এপিএস রয়েছে বলে জানা গেছে। তারা নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন পাথর কোয়ারি, বালু মহাল ও কয়লা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিন লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে।

লুটপাট : ২০১০-১১ অর্থবছরে সুনামগঞ্জ-১ আসনের বরাদ্দকৃত ৮৭ লাখ টাকার পুরোটাই আÍসাতের অভিযোগ রয়েছে এমপি রতনের বিরুদ্ধে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক অফিসে ভুয়া প্রকল্প দাখিল করে এ টাকা আÍসাৎ করা হয়। অভিযোগকারীদের দাবি, ৮৭ লাখ টাকার কোন প্রকল্পই কারও চোখে পড়েনি। এই আÍসাতের ঘটনা তদন্তের জন্য তাহিরপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ১৩ জুন প্রধানমন্ত্রী বরাবর অভিযোগ দায়ের করে। এছাড়াও সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় দেড়শ’ জলমহালের কোটি কোটি টাকার মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনার নামে চলছে লুটপাটের মহোৎসব। উন্নয়নের নামে প্রকল্প দাখিল করে এবং ডিও লেটারের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে লুটপাটের ক্ষেত্র। সরকারকে কোন ধরনের রাজস্ব না দিয়ে একাধিক দখলদার গ্র“প এবং এমপির আÍীয়-স্বজন লুটে খাচ্ছেন এসব রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন ব্যক্তি। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের ডিও লেটারে এডিবি থেকে বরাদ্দকৃত ২৫ লাখ টাকা জামালগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে উত্তোলন করা হয়। অথচ এসব প্রকল্পের কোন অস্তিত্বই নেই। এমনকি প্রকল্প কর্মকর্তারাই এসব কথিত প্রকল্পের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। মসজিদ-মন্দিরের নামেও অর্থ আÍসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ সাচনা বাজার জামে মসজিদের ৫ লাখ, জামালগঞ্জ রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম ১ লাখ, গদাধরপুর মন্দির ১ লাখ, উলুকানী শ্মশানঘাট ১ লাখ, উত্তর কামলাবাজ মসজিদ ১ লাখ, সপ্তক শিল্পী গোষ্ঠী ১ লাখ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ১ লাখ, জামালগঞ্জ ঈদগাহ ১ লাখ ও তায়েরনগর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১ লাখ টাকা। এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের মাধ্যমে তাহিরপুর উপজেলার বালু-পাথর কোয়ারি এবং বড় জলমহালগুলো বিনা খাজনায় লুটপাটের ব্যাপারে তাহিরপুর উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক বিষ্ণুপদ দে লিখিতভাবে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে অভিযোগ করেছেন। গত বছর অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর তাহিরপুর সফরকে সামনে রেখে তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও ধরমপাশার সরকারি অফিস-আদালত ছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে এমপি রতনের বিরুদ্ধে। চারদলীয় জোট সরকারের এমপি নজির হোসেনের মতো মোয়াজ্জেম হোসেন রতনও জোর করে কোন কাগজপত্র ছাড়াই তাহিরপুরের ফাজিলপুরের কোয়ারি দখল করে লুটপাট করছেন। সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান এমপির সুপারিশসহ এমন অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন করেছে স্থানীয় শ্রমিক লীগ। তাহিরপুর থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা মোজাহিদ হোসেন বলেন, ‘টিআর, কাবিখা থেকে এমপি সাহেবদের ভাগ দিতে হয় তা আগে কোনদিন শুনিনি। কিন্তু রতন সাহেব শুধু ভাগ নেন না, বেশিরভাগ অংশ নিজে রেখে সামান্য ভাগ দেন পিআইসিদের। এমপির নামে ৩ বছরে যা বরাদ্দ এসেছে তা ভুয়া ও মিথ্যা প্রকল্প দেখিয়ে আÍসাৎ করা হয়েছে। সংসদ সদস্যের প্যাডে ডিও লেটার দিয়ে প্রায় কয়েকশ’ ভুয়া প্রকল্পের বিপরীতে লাখ লাখ টাকার বরাদ্দ লুটপাট করা হয়েছে। হাওরে বাঁধ নির্মাণে এমপি রতন অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছেন। এক এলাকার বাঁধের কাজের জন্য প্রকল্প কমিটি গঠন করে দেন অন্য এলাকার লোকজনকে দিয়ে। পিআইসির কাছ থেকে জোর করে অগ্রিম স্বাক্ষর নিয়ে সব বরাদ্দ বিক্রি করে দেন নিজের লোকদের দিয়ে। অগ্রিম স্বাক্ষর দিতে রাজি না হলে পিআইসিকে প্রকল্প থেকে চাপ প্রয়োগ করে অব্যাহতি নিতে বাধ্য করেন।

দুর্নীতি : এমপি রতনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির এন্তার অভিযোগ তার এলাকাবাসীর মুখেই। তারা জানালেন, ২০১১ সালের ১২ জানুয়ারি স্থানীয় গ্রামবাসী এবং হাওর এলাকার লোকজন সংসদ সদস্যের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমাবেশ ও মিছিল করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এমপি রতনের ক্যাডাররা উপজেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি ও প্রবীণ জননেতা অজিত রায়কে মারধর করে। জামায়াতের সঙ্গে এমপির সখ্য ও তার বাহিনীর হাতে বাম রাজনৈতিক নেতা নির্যাতনের পর এ ঘটনায় বিস্মিত হননি খোদ আওয়ামী লীগ নেতারাও। এর আসল রহস্য কি তা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন স্থানীয় সবাই। এমপি রতন ও তার ক্যাডার বাহিনী ভুয়া প্রকল্প দিয়ে ৪৬ মেট্রিক টন গমের ডিও লেটার দেখিয়ে মালামাল উত্তোলন করতে চেয়েছিলেন জামালগঞ্জ উপজেলার পিআইও’র কাছ থেকে। এতে পিআইও রাজি না হওয়ায় পিআইওকে মারধর করে জোর করে ডিও লেটারে স্বাক্ষর আদায় করে এমপির বাহিনী। এ সংবাদ প্রকাশ হলে সাংবাদিকদেরও মারধর করা হয়। ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর ফেনারবাক ইউপি কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য ডিও লেটার দেন রতন। তার ডিও লেটারে যথারীতি কাজও শুরু হয়। আগের ডিও লেটারকে গোপন করে ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি আরেকটি ডিও লেটার দিলে থমকে যায় কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ। জামালগঞ্জ উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শামীমা শাহরিয়ার প্রতিবাদ করেছিলেন হাওর লুটপাটের। এতে রতনের বাহিনী ক্ষুব্ধ হয়। উপজেলা মাসিক সমন্বয় সভা চলাকালে সন্ত্রাসীরা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের ওপর হামলা চালায়। প্রতিবাদে সিলেট ও সুনামগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। স্থানীয় যুবলীগ নেতা বিষ্ণুপদ দে অভিযোগ করেন, ২০১০ সালে অকাল বন্যায় হাওরের ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা যখন দিশেহারা, তখন জামালগঞ্জে টিআরের গম বিক্রির টাকায় কনসার্ট করেছিলেন এমপি রতন। ২০১০ সালের ৩১ জুলাই ধরমপাশার জয়শ্রী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে নৌকায় তুলে নিজে মারধর করেন এমপি রতন। কেউ তার এমন অপকর্মের ব্যাপারে মুখ খুললে তার রেহাই নেই। প্রতিবাদকারীদের দমাতে আকস্মিক মোবাইল কোর্ট বসিয়ে নিরীহ কয়েক গ্রামবাসীকে কারাদণ্ডের সম্মুখীন করা হয় এমপির ইঙ্গিতে।

চাঁদাবাজি : তাহিরপুর এবং জামালগঞ্জের বালু ও পাথর কোয়ারি থেকে অবৈধভাবে টোল আদায় হয় প্রতিদিন। টংঘর বানিয়ে চলে এ চাঁদাবাজি। এমপি রতনের ভাই, ভাগিনা ছাড়াও দলীয় ৪-৫ জনের নেতৃত্বে এ চাঁদা আদায় হয়। বিভিন্ন নৌকা, ট্রলার ও কার্গো থেকে আদায় করা চাঁদার পরিমাণ ৫০০ থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। তাদের চাহিদামতো চাঁদা না দিলে বারকী শ্রমিকদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। সব মিলিযে প্রতিদিন ২-৩ লাখ চাঁদা আদায় হয়। এমপির লোকজনের চাঁদাবাজির অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে নৌকার শ্রমিকরা নৌমার্চ, মিছিল, সমাবেশসহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও করে কয়েক দফা। এখানেই শেষ নয়, বাংলাদেশ জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অনুমোদিত নিবন্ধনকে পুঁজি করে তাহিরপুর কয়লা আমদানিকারক গ্র“প বড়ছড়া চারাগাঁও শুল্ক স্টেশনে এমপি রতনের নামে চালাচ্ছে ব্যাপক চাঁদাবাজি। সাড়ে তিন শতাধিক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সারাদেশের ২০ হাজার কয়লা চুনাপাথর সরবরাহকারী ব্যবসায়ী তাদের কাছে জিম্মি। জোট সরকারের সময় বিএনপি নেতা হাজী মোঃ আলকাছ উদ্দিন খন্দকার তাহিরপুর কয়লা আমদানিকারক গ্র“পের আহ্বায়ক থাকাবস্থায় গ্র“পটি বাংলাদেশ জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে নিবন্ধনপ্রাপ্ত হয়। এই রেজিস্ট্রেশন বর্তমানে যথাযথভাবে নবায়ন করা আছে কি-না তা নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৯ সালে গ্র“পের দ্বিবার্ষিক নির্বাচনে বিএনপি নেতা মোঃ আলকাছ উদ্দিন খন্দকারের নেতৃত্বে বিএনপির এ গ্র“পটি হাত মেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য রতনের সঙ্গে। ফলে পরবর্তী নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন খানের নেতৃত্বাধীন প্যানেল পরাজিত হয়।

বিজয়ী হয় রতনের আশীর্বাদপুষ্ট আলকাছপন্থীরা। ২০০৯ সালের ১২ জুন হাজী মোঃ আলকাছ উদ্দিন খন্দকার গ্র“পের অভিষেক ও শপথ গ্রহণের পর কয়লা আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিনা রসিদে দেদারসে চাঁদা আদায় শুরু হয়। আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা জানান, অতিরিক্ত টাকা রাখার জন্য কোন রসিদ দেয়া হয় না। শুধু মৌখিকভাবে জানিয়ে দেয়া হয়, প্রতি নৌকা ১ হাজার ৫৫০ টাকার মধ্যে গ্র“পের অনুদান ৫শ’ টাকা, ইউনিয়ন পরিষদের ট্যাক্স ২৫০ টাকা, নিরাপত্তা রক্ষীর জন্য ৩শ’ টাকা ও অতিরিক্ত ৫শ’ টাকা এমপির জন্য আদায় করা হচ্ছে। প্রতি কার্গোর ৭ হাজার টাকার মধ্যে গ্র“পের ৪ হাজার টাকা অনুদান, ৫শ’ টাকা নিরাপত্তা রক্ষীর, ৫শ’ টাকা ইউনিয়ন ট্যাক্স ও অবশিষ্ট ২ হাজার টাকা এমপির জন্য। সিএন্ডএফ এজেন্ট ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এ টাকা গ্র“পের হিসাবরক্ষক রাজেশ আদায় করে থাকেন। মাস শেষে এমপির নামে আদায় করা টাকা নিয়ে যান উত্তর বাদাঘাট ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন। বাগলী চুনাপাথর ও কয়লা আমদানিককারক সমিতির কোন রকম নিবন্ধন না থাকলেও শাহজাহান খন্দকার সভাপতি ও হামিদুর রহমান স্বঘোষিত সাধারণ সম্পাদক সেজে চাঁদা আদায় করে চলেছেন। আড়াই বছর ধরে দেড়শ’ আমদানিকারকের কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে সমিতি ও এমপির নামে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছেন তারা। শাহজাহান খন্দকার প্রতি মাসে এমপির পিএস আর্নিকের মাধ্যমে এমপির হাতে টাকা পৌঁছে দেন। এমপির আশীর্বাদ থাকায় সেখানে চাঁদাবাজি ছাড়াও শাহজাহান কয়লা ও চুনাপাথর চুরির কয়েকটি সংঘবদ্ধ গ্র“পকে লালন করে প্রতি মাসে বাড়তি লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সব অভিযোগ অস্বীকার এমপি রতনের : এ ব্যাপারে সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে পক্ষ-প্রতিপক্ষ আছে। প্রতিপক্ষের কেউ শত্র“তাবশত এসব অপপ্রচার করছে বলে তিনি দাবি করেন। সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, আল্লাহ তাকে অনেক দিয়েছেন, দুর্নীতি করে টাকা কামানোর দরকার নেই। এ সময় তিনি খোঁজখবর নিয়ে তথ্যভিত্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের অনুরোধ জানান। এ ব্যাপারে এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের ব্যক্তিগত সহকারী রেজওয়ান আলী খান আর্নিক যুগান্তরকে বলেন, এমপি রতন ও আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। একটি স্বার্থান্বেষী মহল ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে না পেরে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি বলেন, এমপি রতনের নেতৃত্বে তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও ধরমপাশায় যে উন্নয়ন হচ্ছে; স্বাধীনতার পর ৪০ বছরেও তা হয়নি। এমপি রতনের উন্নয়নে ঈর্ষাণ্বিত হয়ে তার ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য কুচক্রী মহল ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এ অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাহিরপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমি বিপুল ভোটে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ ডাহা মিথ্যা ও অপপ্রচার। তিনি বলেন, তাহিরপুর উপজেলায় কোন জলমহাল নেই। সব জলমহাল রামসা’র অন্তর্ভুক্ত। বর্তমান সরকারের আমলে তাহিরপুরে কোন টেন্ডারবাজি হয়নি বলে তিনি দাবি করেন। তিনি নিজেকে বালু ও পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দাবি করে বলেন, বালু মহালে কোন চাঁদাবাজি হয় না। হাইকোর্টে রিটের কারণে সরকারি রয়্যালিটি আদায় হচ্ছে না। এর সঙ্গে এমপি রতন বা আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই। তিনি বলেন, ৩ বছরে তাহিরপুর থানায় কোন তদবির পড়েনি। আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষাণ্বিত হয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অপপ্রচার চালাচ্ছে।

http://jugantor.us/enews/issue/2011/11/26/all0280.htm