উইকিলিকসের তথ্য - ছাত্রনেতারা টাকা কামানোয় ব্যস্ত

বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর ছাত্রসংগঠনের নেতারা এখন অনৈতিক চর্চা ও টাকা কামানোর কাজে ব্যস্ত। তিন দশক ধরে তাঁরা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে এসব করে আসছেন। রাজনৈতিক দলগুলোও ছাত্রদের ব্যবহার করছে। এসব কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষ-দখল এবং মারামারির মতো ঘটনা ঘটছে।

ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো এক তারবার্তায় বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে এসব মন্তব্য উঠে এসেছে। ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ২০১০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘ইনক্রিজেস স্টুডেন্ট ভায়োলেন্স রেইজেস অ্যালামর্স’ শিরোনামে এই বার্তাটি ওয়াশিংটনে পাঠান। প্রায় দেড় লাখ নতুন কেবলের সঙ্গে এ বার্তাটিও গত ৩০ আগস্ট প্রকাশ করেছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকস। ওই বার্তায় বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সহিংসতায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তিনি মন্তব্য করেন, ২০১০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে যেভাবে ছাত্র সংঘর্ষের জের ধরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, তা নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার মতোই কোনো পরিস্থিতি হতে পারে।

ওই বার্তায় বলা হয়, টাকা, ক্ষমতা আর প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতিযোগিতা ছাত্রসংগঠনগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। এখন নাগরিকদের অনেকের পক্ষ থেকে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দেওয়ার দাবি উঠেছে।

বার্তায় বলা হয়, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর পরই বেশির ভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের দখল নেয় ছাত্রলীগ। মার্কিন এক কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে এ নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রক্টর নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। তিনি মার্কিন ওই কর্মকর্তাকে জানান, এখনকার ছাত্রনেতারা টাকা আয় করতে ব্যস্ত। ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রলীগের নেতারা ঠিকাদারি, দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি বাণিজ্য, টেন্ডার দুর্নীতি এবং হলগুলোতে ছাত্র আসন বরাদ্দের অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন।

ওই বার্তায় বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগের ভর্তি বাণিজ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। ছাত্রলীগ সাধারণভাবে ভর্তির নিয়ম উপেক্ষা করে টাকার বিনিময়ে ছাত্র ভর্তি করছে। এ কারণে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। এ ছাড়া কোন্দলের কারণে দুই বছরে অন্তত ১১টি হত্যাকাণ্ডের জন্য ছাত্রলীগ দায়ী। এ ছাড়াও প্রতিপক্ষের ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতির কথাও উঠে আসে ওই বার্তায়। এতে বলা হয়, ছাত্র-আন্দোলনের সংগ্রামের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ইতিহাসে জড়িত। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ছাত্রদলের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ অন্তত ৫০ জন আহত হন। টুকুর অভিযোগ, ছাত্রদলের বিদ্রোহী পক্ষের নেতাদের অস্ত্র ও লোকবল দিয়ে সহায়তা করেছে ছাত্রলীগ। এই সংঘর্ষে পিস্তল ও দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেছে।

সাংসদ ও বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা পল্লফের কাছে অভিযোগ করেছেন, পুলিশ ওই হামলা ঠেকাতে কোনো ভূমিকা নেয়নি। এমনকি অস্ত্রসহ মহড়া দেওয়ার পরেও তারা কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। বার্তায় বলা হয়, কারা ওই হামলা চালিয়েছে, সেটি স্পষ্ট হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলের কথাও উঠে আসে এই বার্তায়। এতে বলা হয়, হল দখল নিয়ে ছাত্রলীগের কোন্দলের কারণেই পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে সংঘর্ষের সময় টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে। এই সংঘর্ষের কারণে মেধাবী ছাত্র আবু বকর মারা যান। আবু বকরের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগে শিবির ঢুকে পড়েছে এবং তারাই এসব কাজ করছে। সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

বার্তায় বলা হয়, ৯ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিবের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। শিবিরের কর্মীরা নির্মমভাবে ফারুক হোসেন নামের এক ছাত্রলীগের কর্মীকে হত্যা করে ম্যানহোলে ফেলে রাখেন। তাঁরা চারজনের রগ কেটে ফেলেন। এরপর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল ইসলাম টুকু রাজশাহী যান। এর পরপরই সারা দেশে শিবিরের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে পুলিশ। বিভিন্ন স্থান থেকে তিন দিনে ১৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরা অধিকাংশই জামায়াত-শিবিরের সদস্য।

বার্তায় সংঘর্ষের ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমালোচনা করা হয়। এতে বলা হয়, ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ির কারণে শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ ছিলেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও ছাত্রলীগকে সতর্ক করতে চেয়েছেন। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের অনানুষ্ঠানিক প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারবারই বলেছেন, কঠোর অ্যাকশন (ব্যবস্থা) নেওয়া হবে। কিন্তু কোনো ঘটনার পরই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা স্বীকার করেছেন, তাঁরা চাইলেও ছাত্রলীগের এই অনিয়ম বন্ধ করতে পারছেন না।

বার্তায় বলা হয়, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারায় এই সরকারের ভাবমূর্তি অনেক ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিএনপিও এই সুযোগ নিয়েছে এবং তারা সব সময় সাধারণ মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধে বিষিয়ে দিতে ছাত্রলীগের অপকর্মের কথা বলেছে। এ কারণেই ক্যাম্পাসগুলো থেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিও তুলেছে নাগরিক সমাজ।

প্রতিক্রিয়া: মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রক্টর ও লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ আজ রোববার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সময় বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়েছে। ছাত্ররাজনীতি নিয়েও কথা হয়েছে। আর উইকিলিকস যেসব বার্তা প্রকাশ করেছে সেগুলো এখন পর্যন্ত অস্বীকার করেনি মার্কিন সরকার। কাজেই ওই তথ্য অসত্য, সেটি আমি বলব না। সেখানে যা বলা হয়েছে, তাতে বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।

ছাত্ররাজনীতি আর ছাত্রলীগের এই সমালোচনা নিয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, ‘অতীতে ছাত্রলীগ নামধারীরা এসব করেছে। কিন্তু দায় এসেছে ছাত্রলীগের ওপর। আমরা এ অবস্থা থেকে ছাত্রলীগকে বের করে নিয়ে আসতে সব ধরনের চেষ্টা করছি। বর্তমান সময়ে ভর্তি বাণিজ্যসহ কোনো অনিয়মের অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নেই। আমরা এখন থেকে এসব অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেব।’

সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: ০৪-০৯-২০১১