গ্রামীণ ব্যাংক: কিছু প্রশ্ন ও প্রকৃত তথ্য

grameen bank bangladesh

সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংক, সহযোগী ৫৪টি প্রতিষ্ঠান ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে বিভিন্ন মহল ও গণমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, তোলা হচ্ছে নানা প্রশ্ন। এসব নিয়ে ইউনূস সেন্টার থেকে গণমাধ্যমে বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাঠানো হয়। ‘গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গে সমালোচকদের কিছু প্রশ্ন ও প্রকৃত তথ্য’ শীর্ষক ওই ব্যাখ্যায় ২৯টি প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়। পাঠকের চাহিদা ও আগ্রহের কথা বিবেচনা করে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর হুবহু জবাব ছাপানো হলো।

প্রশ্ন: সরকার গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে তদন্ত করতে চাইলে এত বাধা বা সমালোচনা হচ্ছে কেন? নোবেল বিজয়ী বলে তিনি কি তদন্তের ঊর্ধ্বে?

উত্তর: সাধারণত কোনো প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তদন্ত করা হয়, যখন সেই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নানা দুর্নীতির অভিযোগ ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়। গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সে রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। গ্রামীণ ব্যাংক একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান বলেই সারা দেশে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতিবছর বাংলাদেশ ব্যাংক নিবিড়ভাবে গ্রামীণ ব্যাংক পরিদর্শন করেছে। প্রতিবছর দুটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অডিট ফার্মও গ্রামীণ ব্যাংক অডিট করে এসেছে। কোনো অডিট টিম কোনো অনিয়ম নিয়ে কোনো দিন প্রশ্ন তোলেনি। তা ছাড়া সরকারপ্রধান সংসদে, সংসদের বাইরে এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছে গ্রামীণ ব্যাংক ও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন, যা বিদ্বেষমূলক বলে মনে হয়েছে অনেকের কাছে। অন্যদিকে সরকারপ্রধানের এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ জাগা কি স্বাভাবিক নয়? এই তদন্ত কি তাঁর মন্তব্য দ্বারা প্রভাবিত হবে না? শুধু এ কারণেই বিভিন্ন সুধীজন এই তদন্ত সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন, অন্য কোনো কারণে নয়।

নোবেল বিজয়ী বলে তিনি তদন্তের ঊর্ধ্বে নন। যাঁরা আপত্তি তুলেছেন, তাঁরা এই তদন্ত বিদ্বেষমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে—এই ধারণা নিয়েই আপত্তি তুলেছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা এই মর্মে শপথ গ্রহণ করেন যে, ‘আমি সংবিধানের সংরক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব, এবং ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব।’ আচরণ নিয়েই সমস্যা, তদন্ত নিয়ে নয়। বাস্তবে এই আচরণ থেকে বিচ্যুত হতে দেখলে তার প্রতিবাদ করা কি সব নাগরিকের কর্তব্য নয়?

প্রশ্ন: সরকারের আইন অনুসারে ৬০ বছর বয়সের পরও অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থেকেছেন। এটা কি বেআইনি কাজ হয়নি? এই অতিরিক্ত সময়ে বেতন-ভাতা গ্রহণও কি বেআইনি নয়?

উত্তর: ১৯৯০ সালে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ সংশোধনের মাধ্যমে ব্যাংকের মালিকানা বিন্যাস পরিবর্তন হয়ে সরকারের মালিকানা ৬০ শতাংশ থেকে কমে ২৫ শতাংশ এবং ব্যাংকের সদস্যদের মালিকানা ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়। মালিকানা বিন্যাস পরিবর্তন হয়ে সরকারের মালিকানা হ্রাস পাওয়ায় অধ্যাদেশ সংশোধনের মাধ্যমে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন সাপেক্ষে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। সংশোধিত অধ্যাদেশে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়ার পূর্বানুমতিদানের অনুরোধ জানিয়ে ১৯৯০ সালের ১৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয়, পরে ২৫ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাপক ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগের বিষয়ে পূর্বানুমোদন দেয়। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংক তার অনুমোদনপত্রে অধ্যাপক ইউনূসকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগের বেলায় কোনো বয়সসীমা উল্লেখ করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদনপত্রের ধারাবাহিকতায় কোনো বয়সসীমা উল্লেখ না করে তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কর্মরত অবস্থায় ১৯৯৯ সালের ২০ জুলাই অনুষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালকমণ্ডলীর ৫২তম সভায় স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর অবসর গ্রহণের বিষয়টি সম্পর্কে বোর্ডকে অবহিত করেন। পরিচালকমণ্ডলী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে যত দিন পর্যন্ত পরিচালকমণ্ডলী অন্য কোনো সিদ্ধান্ত না নেবে, তত দিন পর্যন্ত অধ্যাপক ইউনূস ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে বহাল থাকবেন।

উল্লিখিত পর্ষদ সভায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ব্যাপারে একটি রেগুলেশন তৈরির সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। ওই রেগুলেশনেও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদের জন্য কোনো বয়সসীমা আরোপ করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের স্থিতিভিত্তিক পরিদর্শন প্রতিবেদনে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে মুহাম্মদ ইউনূসের নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি মর্মে আপত্তি উত্থাপন করা হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর ব্যাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত ১৯৯৯ সালের স্থিতিভিত্তিক বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদনের অনিষ্পত্তিকৃত কিছু বিষয়ের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনজন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের তিনজন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ২০০১ সালের ১৫ জানুয়ারি একটি যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। যৌথ সভায় আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদনের কতিপয় অনুচ্ছেদ নিষ্পত্তি হয়েছে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং কিছু অনুচ্ছেদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, গ্রামীণ ব্যাংক যাচিত ডকুমেন্টসমূহের কপি সরবরাহ করলে আপত্তিসমূহ নিষ্পত্তি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। সে প্রেক্ষিতে গ্রামীণ ব্যাংক ২০০২ সালের ১৬ জানুয়ারি যাচিত ডকুমেন্টসহ পুনঃপরিপালন প্রতিবেদন প্রেরণ করে। পুনঃপরিপালন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ব্যাপারে আপত্তির বিষয়টি নিষ্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করে। এ সময় অধ্যাপক ইউনূসের বয়স ছিল ৬১ বছর ছয় মাস। অর্থাৎ তাঁর বয়স এ সময় ৬০ বছর অতিক্রান্ত হলেও এ বিষয়ে ঘটনা-উত্তর অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা বলেনি। এর ফলে নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরবর্তী কোনো বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদনে প্রসঙ্গটি আর কখনোই আসেনি।

উল্লেখ্য, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনই অধ্যাপক ইউনূসের বয়স ৬০ বছর উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সরকার তাঁর বয়স নিয়ে কোনো আপত্তি তোলেনি।

মোট ১১ বছরে এটা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আর কোনো প্রশ্ন তোলেনি। ২০১১ সালে প্রশ্ন তোলা হলো। অধ্যাপক ইউনূস আদালতে গেলেন। আদালত তাঁর আবেদন গ্রহণ করলেন না এই বিবেচনায় যে, তাঁর প্রতিকার চাওয়ার লুকাস স্ট্যান্ডি (Locus Standi) নেই, অর্থাৎ আবেদন করার যোগ্যতা নেই। তিনি আপিল বিভাগে গেলেন। সেখানেও তাঁর আবেদন একই যুক্তিতে অগ্রাহ্য হলো।

তিনি এরপর পদত্যাগ করলেন। তিনি যে ১১ বছর দায়িত্ব পালন করলেন, এটা কি তাঁর অপরাধ, নাকি যাঁরা তাঁকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তাঁদের অপরাধ, নাকি যে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্মতি দিয়ে এই নিয়োগকে গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছে তাদের অপরাধ, এটা স্থির করতে হবে।

প্রশ্ন: গ্রামীণ ব্যাংক কি অত্যন্ত উচ্চ সুদের হারে মহাজনী কায়দায় গরিব মানুষকে শোষণ করে আসছে না?

উত্তর: বাংলাদেশে সরকারি ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাসহ যাবতীয় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার সর্বনিম্ন। গ্রামীণ ব্যাংকের সর্বোচ্চ সুদের হার ২০ শতাংশ। এটা সরল সুদ। ক্রমহ্রাসমান পদ্ধতিতে সুদের হার ঠিক করা হয়, যা ফ্লাট পদ্ধতিতে ১০ শতাংশে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) দেশের সব ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সর্বোচ্চ সুদের হার নির্ধারণ করেছে ২৭ শতাংশ। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার এই হারের চাইতে ৭ শতাংশ কম।

গ্রামীণ ব্যাংকের গৃহনির্মাণ ঋণের বার্ষিক সুদের হার ৮ শতাংশ। উচ্চশিক্ষা ঋণের সুদের হার, শিক্ষাজীবনে শূন্য শতাংশ (অর্থাৎ সুদ নেই) এবং শিক্ষা সমাপ্তির পর ৫ শতাংশ। ভিক্ষুক সদস্যদের জন্য প্রদত্ত ঋণের সুদের হার শূন্য শতাংশ (অর্থাৎ সুদ নেই)। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক ঋণের ওপর সর্বনিম্ন সুদ নেয় এবং সঞ্চয়ের ওপর সর্বোচ্চ (সাড়ে ৮ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ) সুদ দেয়।

এসব তথ্য দীর্ঘদিন ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন নীতিমালা প্রকাশনা ও ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়ে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছেও এ তথ্য রয়েছে। তবু অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গে কল্পিত বিভিন্ন উচ্চতর সুদের হার গণমাধ্যমে উল্লেখ করে থাকেন, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

উল্লেখযোগ্য যে, ২০১১ সালে অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পরও এই সুদের হার এবং আদায়ের পদ্ধতি সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রয়েছে।

প্রশ্ন: অধ্যাপক ইউনূস বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে ওয়েজ আর্নার স্কিমের আয় দেখিয়ে কি কর ফাঁকি দেননি?

উত্তর: অধ্যাপক ইউনূস বিদেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুর টাকা আয় করেন। বিদেশ থেকে যেসব খাতে তিনি আয় করেন সেগুলো হলো: ১) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বা সম্মেলনে বক্তৃতা, ২) তাঁর লেখা বিভিন্ন বই, যেগুলো বহু দেশে বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে বিক্রি হচ্ছে, তার স্বত্ব বা রয়্যালটি, ৩) নোবেল পুরস্কারসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার। অধ্যাপক ইউনূস অত্যন্ত উচ্চহারের ফির বিনিময়ে বিদেশে বিভিন্ন সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। অনেক স্থানে তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য শ্রোতাদের অর্থের বিনিময়ে টিকিট কাটতে হয়। তাঁর লেখা কয়েকটি বই বিভিন্ন দেশে ২৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর বই নিউইয়র্ক টাইমসের ‘বেস্ট সেলার লিস্টে’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বক্তৃতা, বই ও পুরস্কার থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা তিনি বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে নিয়মিত দেশে আনেন। বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বিদেশে অর্জিত তাঁর ব্যক্তিগত আয় যদি ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে আনেন এবং প্রতিবছর আয়কর বিবরণীতে তা প্রদর্শন করেন, তাহলে তা আয়কর আইনে করমুক্ত। তাই আইনগতভাবেই তাঁর বৈদেশিক আয় করমুক্ত। তিনি এই আইনের ভিত্তিতেই আয়কর রিটার্ন দাখিল করে এসেছেন, আয়কর বিভাগ কোনো দিন আপত্তি জানায়নি। তাঁর অন্যান্য সব দেশি ও বিদেশি আয় তিনি আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করেন এবং আয়ের ওপর তিনি আয়কর বিভাগ কর্তৃক নিরূপিত আয়কর আইন অনুযায়ী নিয়মিত দিয়ে আসছেন।

প্রশ্ন: গ্রামীণ ব্যাংক তো সরকারের অর্থে চলে। তা ছাড়া, বিদেশ থেকেও গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য শত শত কোটি টাকা আসে। এই টাকা কীভাবে ব্যবহূত হয়েছে, তা দেখা কি সরকারের কর্তব্য নয়?

উত্তর: না, গ্রামীণ ব্যাংক সরকারের অর্থে চলে না। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই চেষ্টা হচ্ছিল যেন ব্যাংকটি কেবল সদস্যদের মালিকানায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকার এটাতে রাজি হয়নি। জন্মকালে (১৯৮৩ সালে) গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার ৬০ শতাংশ ছিল। অধ্যাপক ইউনূস ৬০ শতাংশ সরকারি মালিকানায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় মোটেও রাজি ছিলেন না। তাঁকে বোঝানো হলো যে ব্যাংক চালু হয়ে গেলে এটা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। ১৯৮৬ সালে সেটা করা হয়েছিল। ৭৫ শতাংশ শেয়ার বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল অধ্যাদেশ সংশোধন করে। ড. ইউনূস সরকারের শেয়ারের অংশ টোকেন অংশীদারিত্ব হিসেবে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন, যার ফলে সরকার ২০০৮ সালে ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সরকারের শেয়ার ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনে এবং বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ বোর্ডের হাতে ন্যস্ত করে। পরে বর্তমান সরকার তা সংসদে পেশ করে আইনে পরিণত না করায় সরকারের শেয়ার পূর্বের মতো ২৫ শতাংশে ফিরে গেছে। চেয়ারম্যান নিয়োগ সরকারের কাছে থেকে গেছে।

সরকার ব্যাংকের জন্মকালে এক কোটি ২০ লাখ টাকার শেয়ার কিনেছিল। এখনো সরকারের মোট শেয়ারের পরিমাণ এক কোটি ২০ লাখ টাকা। সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংক প্রত্যেকে ৩০ লাখ টাকা করে মোট ৬০ লাখ টাকার শেয়ার কিনেছে। ফলে সরকারের মোট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছিল এক কোটি ৮০ লাখ টাকা। জন্মের পর থেকে সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে এক কোটি ৮০ লাখ টাকার বেশি আর কোনো টাকা দেয়নি। সরকার তার মূলধনের পরিমাণ না বাড়ানোয় কার্যত সরকারের মালিকানা ৩ শতাংশে নেমে এসেছে।

সরকারের অনুরোধে বিভিন্ন সময়ে গ্রামীণ ব্যাংক বিদেশি ঋণ ও অনুদান নিয়েছে। বিদেশি ঋণ ও অনুদান নেওয়ার জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর সময় সময় চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেই সব তথ্য বিভিন্ন প্রকাশনায় লিপিবদ্ধ করা আছে। যেসব বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তা চুক্তি মোতাবেক শোধ করে দেওয়া হয়েছে। ঋণ পরিশোধে গ্রামীণ ব্যাংক কোনো সময় এক দিনের জন্যও বিলম্ব করেনি।

১৯৯৫ সালে গ্রামীণ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা আর বিদেশি ঋণ বা অনুদান নেবে না। চালু ঋণ/অনুদানগুলো ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত চালু থাকে। এর পর থেকে গ্রামীণ ব্যাংক আজ পর্যন্ত কোনো বিদেশি ঋণ বা অনুদান নেয়নি। সরকারি অনুদান গ্রামীণ ব্যাংক কোনো কালেও নেয়নি।

গ্রামীণ ব্যাংকের মূলধনের প্রধান উৎস সদস্যদের শেয়ার কেনা বাবদ অর্থ। প্রতি শেয়ারের মূল্য ১০০ টাকা। সরকারের বেঁধে দেওয়া মূলধনের সর্বোচ্চ সীমা ২০০৮ সালের পূর্বে কম ছিল বলে গ্রামীণ ব্যাংক কোনো সদস্যকে একটির বেশি শেয়ার দিতে পারেনি। যদিও সদস্যদের ইচ্ছা তাঁরা বেশি করে শেয়ার কিনবেন। কারণ গ্রামীণ ব্যাংক শেয়ারপ্রতি ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ মুনাফা দিয়ে থাকে।

প্রশ্ন: গ্রামীণ ব্যাংকের যদি শেয়ারহোল্ডার থেকে থাকে, তবে কোনো দিন তাদের লভ্যাংশ দেওয়া হলো না কেন? মুনাফার টাকা কি অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর সঙ্গী-সাথিরা হজম করে ফেলেছেন?

উত্তর: গ্রামীণ ব্যাংক বরাবর শেয়ারহোল্ডারের ডিভিডেন্ড দিয়ে এসেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রত্যেক সদস্য যেকোনো সময় ১০০ টাকা দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের একটি শেয়ার কিনতে পারেন। ৮৪ লাখ ঋণগ্রহীতার মধ্যে ৫৫ লাখ ঋণগ্রহীতা এ পর্যন্ত শেয়ার কিনেছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা ৫৫ কোটি টাকার শেয়ার কিনে ৯৭ শতাংশ মূলধনের মালিক হয়েছেন। সরকার ও সরকারি ব্যাংক এক কোটি ৮০ লাখ টাকার শেয়ার কিনে ৩ শতাংশ শেয়ারের মালিক।
এ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক সরকারকে এক কোটি ২০ লাখ টাকার শেয়ারের বিনিময়ে দুই কোটি ৫২ লাখ টাকা, সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের প্রত্যেককে ৩০ লাখ টাকার শেয়ারের বিনিময়ে ৬৩ লাখ টাকা লভ্যাংশ দিয়েছে।

সদস্যরা ৫৫ কোটি টাকার শেয়ারের বিনিময়ে ৭৭ কোটি টাকা লভ্যাংশ পেয়েছেন (সদস্যরা তুলনামূলকভাবে কম পেয়েছেন, যেহেতু ২০০৬ সালের পরবর্তী সময়ে যাঁরা শেয়ার কিনেছেন, তাঁরা অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মেয়াদে লভ্যাংশ পেয়েছেন)। প্রত্যেক সদস্যের লভ্যাংশ প্রতিবছর তাঁর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।

পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে বাৎসরিক হিসাব অনুমোদন করার সময় বছরের অর্জিত মুনাফা কীভাবে বণ্টন করা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুনাফার কী পরিমাণ অংশ লভ্যাংশ হিসেবে শেয়ারের মালিকদের কাছে বণ্টন করা হবে, সে বিষয়ে বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ব্যাংকের মুনাফার পরিমাণ লভ্যাংশ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত না থাকায় লভ্যাংশ দেওয়া হয়নি। ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সরকারের দেওয়া শর্ত পূরণের জন্য লভ্যাংশ দেওয়া সম্ভব হয়নি। লভ্যাংশ না দিয়ে সব মুনাফা পুনর্বাসন তহবিলে প্রদানের শর্তে সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে আয়কর অব্যাহতি প্রদান করে। এ জন্য বোর্ড লভ্যাংশ প্রদান করতে পারেনি। ২০০৬ সাল থেকে সরকারের এই শর্ত রহিত হওয়ার পর বোর্ড ২০০৬ সালে ১০০ শতাংশ, ২০০৭ সালে ২০ শতাংশ এবং ২০০৮, ২০০৯ ও ২০১০ সালে প্রতিবছর ৩০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিয়েছে। মুনাফার পরিমাণ কম হলে গ্রামীণ ব্যাংক যাতে একই হারে মুনাফা বণ্টন করে যেতে পারে, সে জন্য ‘মুনাফা সমতা আনয়ন তহবিল’ গঠন করেছে। ২০১০ পর্যন্ত এই তহবিলে ৬৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা জমা আছে।

গ্রামীণ ব্যাংকে যেহেতু অধ্যাপক ইউনূস বা তাঁর সহকর্মীদের কোনো শেয়ার নেই, তাই তাঁরা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কোনো লভ্যাংশ নিতে পারেন না। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে তাঁরা শুধু বেতন-ভাতা পান। শুধু সেটুকুই তাঁরা নিয়েছেন।

প্রশ্ন: ‘গ্রামীণ’ নামের প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক কারা?

উত্তর: ‘গ্রামীণ’ নামের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কোম্পানি আইনের সেকশন ২৮ দ্বারা গঠিত। এই আইনে গঠিত প্রতিষ্ঠানের কোনো মালিক থাকেন না। কেউ ব্যক্তিগতভাবে মুনাফা নিতে পারেন না। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আইনের ভাষায় ‘নন স্টক কোম্পানী লিমিটেড বাই গ্যারান্টি’ বলা হয়। এতে পরিচালকেরা প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যক্তিগত গ্যারান্টি দেন কিন্তু কোনো মুনাফা গ্রহণ করতে পারেন না।

কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ‘ফর প্রফিট’ কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত। উল্লিখিত কোনো না কোনো নন-প্রফিট প্রতিষ্ঠান এদের মালিক। ফলে এগুলোর মুনাফা নন-প্রফিট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেই যায়। কোনো ব্যক্তির কাছে যেতে পারে না।

প্রশ্ন: যে ৫৪টি ‘গ্রামীণ’ নামধারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গ্রামীণ ব্যাংকের টাকা ও সুনাম ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো কি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠান নয়?

উত্তর: ‘গ্রামীণ’ নামধারী ৫৪টি প্রতিষ্ঠানে গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো বিনিয়োগ করা হয়নি। এসব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সূত্র থেকে এই মূলধন এসেছে। অনেকের মূলধন এসেছে দাতা সংস্থার অনুদান থেকে। কারও এসেছে ঋণ থেকে। কারও এসেছে অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ থেকে। কোনো প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কোনো বিনিয়োগ নেয়নি।

প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অর্থের সূত্র কী, সেই টাকা কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তা প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক নিরীক্ষাকৃত আর্থিক প্রতিবেদনে বিস্তারিতভাবে দেওয়া আছে। সেসব প্রতিবেদন প্রতিবছর সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়।

‘গ্রামীণ’ নামের সুনাম এসেছে অধ্যাপক ইউনূসের উদ্ভাবনীমূলক সৃষ্টির সাফল্য থেকে। গ্রামীণ ব্যাংকের জন্মের আগে থেকেই তিনি ‘গ্রামীণ’ নামটি তাঁর কাজে ব্যবহার করে এসেছেন। জোবরা গ্রামে তিনি কৃষি ব্যাংকের যে শাখা পরিচালনা করেছিলেন, সেটার নাম দিয়েছিলেন ‘পরীক্ষামূলক গ্রামীণ শাখা’। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে যে প্রকল্প পরিচালনা করেছিলেন, তার নাম দিয়েছিলেন ‘গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প’। এই গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর নেওয়া সব উদ্যোগের সঙ্গে ‘গ্রামীণ’ নামটি জুড়ে দিয়ে এসেছেন। দেশেও করেছেন, বিদেশেও করেছেন। পৃথিবীর বহু দেশে এই বাংলা শব্দটি অনেকের কাছে খুবই পরিচিত শব্দ এবং এটা অত্যন্ত সম্মানিত শব্দ।

প্রশ্ন: অধ্যাপক ইউনূসসৃষ্ট ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের উত্তরাধিকারী কে? তাঁর অবর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক হবেন কে?

উত্তর: কোনো প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপক ইউনূসের কোনো মালিকানা নেই। তিনি কোথাও একটি শেয়ারেরও মালিক নন। কাজেই তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে চিন্তিত হবারও কিছু নেই। অধ্যাপক ইউনূসসৃষ্ট ৫৪টির অধিকাংশ ‘নট ফর প্রফিট’ প্রতিষ্ঠান, যা কোম্পানি আইনের সেকশন ২৮-এর আওতায় নিবন্ধিত। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কোনো মালিক থাকেন না। সে জন্য মালিকানার কোনো উত্তরাধিকারের প্রশ্ন আসে না। পরিচালনা পর্ষদ বা সাধারণ পর্ষদে কোনো পদ শূন্য হলে কোম্পানির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে তা পূরণ করা হয়। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে।

‘গ্রামীণ’ নামের যে কয়েকটি ‘ফর প্রফিট’ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেই কয়েকটির মালিক উল্লিখিত কোনো না কোনো ‘নন-প্রফিট’ প্রতিষ্ঠানের। যেহেতু এই ‘ফর প্রফিট’ প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক যেসব প্রতিষ্ঠান, তাদের অস্তিত্ব নিরবচ্ছিন্নভাবে বজায় থাকছে, সেহেতু কখনো মালিকানায় শূন্যতা সৃষ্টির কোনো অবকাশ নেই।

যেহেতু প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই প্রচলিত আইনের আওতায় সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান, তাই তাদের ওপর নজরদারি করার জন্য উপযুক্ত আইনি কর্তৃপক্ষ আছে। এমনকি এগুলোর অবসায়ন করতে হলেও হাইকোর্টের মাধ্যমে করতে হবে।

প্রশ্ন: গ্রামীণফোনের মালিক কে?

উত্তর: ‘গ্রামীণফোনের’ বড় অংশের মালিক হলো ‘টেলিনর’ নামক নরওয়ের একটি টেলিফোন প্রতিষ্ঠান। আবার টেলিনরের বড় অংশের মালিক হলো নরওয়ে সরকার। গ্রামীণফোনের দ্বিতীয় মালিক হলো গ্রামীণ টেলিকম। এটা কোম্পানি আইনে নিবন্ধনকৃত একটি মালিকবিহীন নন-প্রফিট প্রতিষ্ঠান (যার ব্যাখ্যা অন্য একটি উত্তরে দেওয়া হয়েছে)। তৃতীয় মালিক হলো বাংলাদেশের অসংখ্য শেয়ারহোল্ডার, যাঁরা শেয়ারবাজারের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তাঁদের শেয়ার বেচাকেনা করেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে গ্রামীণফোনের কোনো শেয়ারের মালিক ছিলেন না এবং এখনো নেই।

প্রশ্ন: গ্রামীণফোনের শেয়ার কেনার জন্য গ্রামীণ টেলিকম এত টাকা কীভাবে সংগ্রহ করেছে?

উত্তর: গ্রামীণফোনে মূলধনে বিনিয়োগের জন্য গ্রামীণ টেলিকম তিনভাবে পুঁজি সংগ্রহ করেছে। অধ্যাপক ইউনূসের ব্যক্তিগত অনুরোধে প্রখ্যাত মার্কিন ধনী ব্যক্তি জর্জ সারোস তাঁর ফাউন্ডেশন থেকে গ্রামীণ টেলিকমকে ১১ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেন। সেই অর্থ গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণফোনে বিনিয়োগ করে। সেই অর্থ গ্রামীণ টেলিকম যথাসময়ে সারোস ফাউন্ডেশনকে পরিশোধ করে দিয়েছে। গ্রামীণ টেলিকম দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে গ্রামীণফোনের মূলধনে বিনিয়োগ করেছে। এ টাকাও যথাসময়ে পরিশোধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণ কল্যাণ থেকেও ঋণ নিয়েছে। গ্রামীণ কল্যাণ কোম্পানি আইনে সৃষ্ট মালিকবিহীন একটি প্রতিষ্ঠান।

প্রশ্ন: গ্রামীণফোনের লাভের টাকা গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরা পান না কেন?

উত্তর: প্রথম পর্যায়ে গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামীণফোনের কোনো শেয়ারের মালিক ছিল না। কয়েক বছর আগে গ্রামীণফোন যখন তার শেয়ার বাজারে ছাড়ে, তখন গ্রামীণফোনের কিছু শেয়ার গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের কল্যাণে গঠিত ‘গ্রামীণ ব্যাংক বরোয়ারস ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট’-এর জন্য কেনা হয়। সেই শেয়ারের মুনাফা ‘গ্রামীণ ব্যাংক বরোয়ারস ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট নিয়মিত পেয়েছে।

প্রশ্ন: ‘গ্রামীণ’ প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে আদৌ কোনো কর, মূূল্য সংযোজন কর (মূসক) দেয়?

উত্তর: অধ্যাপক ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত সব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত কর, মূসক দেয়। বার্ষিক নিরীক্ষা হয়। অন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো এগুলো সব ধরনের নিয়ন্ত্রক সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। যেসব প্রতিষ্ঠানের জন্য বিনিয়োগ বোর্ড থেকে অনুমোদন প্রয়োজন, সেসব প্রতিষ্ঠান সেই অনুমোদন নিয়েছে। যেসব বিবরণী (রিটার্ন) রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজকে (আরজেএসসি) দেওয়ার কথা, সেগুলো নিয়মিত দিয়ে আসছে। যেসব প্রতিষ্ঠান এনজিও ব্যুরো থেকে অনুমোদন দরকার, তারা সেখান থেকে অনুমোদন নিয়েছে। সরকারের নজরদারির বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করে না।

প্রশ্ন: অধ্যাপক ইউনূসের নাকি এত আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, বিদেশে নাকি তাঁর খুব প্রভাব-প্রতিপত্তি, কিন্তু তাঁর কিছুই দেশের কাজে লাগাতে দেখি না। আমেরিকার বাজারে আমাদের তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের ব্যাপারে, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে, সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ‘আকামা’ সমস্যার সমাধানে, তাঁকে তো কোনো দিন তাঁর প্রভাব খাটাতে দেখি না। দেশের কোনো উপকার করতে তিনি এত নারাজ কেন?

উত্তর: একজন নাগরিকের প্রভাব থাকলে তা খাটানোর কাজে সরকারের একটা ভূমিকা দরকার হয়। সরকারের রায় থেকে সেই নাগরিককে এই দায়িত্ব অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও দিতে হয়। দুই দিকের সরকারকে বুঝতে হবে যে সেই নাগরিকের সঙ্গে কথা বললে তিনি সে কথা অন্য দিকের সরকারকে জানাতে পারবেন এবং তাঁরা সেটা বিবেচনা করবেন; নাগরিক শুধু তাঁর প্রভাব খাটিয়ে আলোচনাকে সহজ করে দিচ্ছেন মাত্র। তখন যেকোনো আলোচনা অগ্রসর হতে পারে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বর্তমান পরিস্থিতি সে রকম নয়। বর্তমান যুগের শক্তিশালী মিডিয়ার কারণে সব দেশের সরকার জেনে গেছে, অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনেকটা অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। তা ছাড়া সেটা তাঁরা চাক্ষুষ করেনও। অধ্যাপক ইউনূসের সম্মানে যখন কোনো একটি দেশে একটি অনুষ্ঠান হয়, সেখানে সে দেশের মন্ত্রীরা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা আমন্ত্রিত হন; অনেকে আগ্রহসহকারে উপস্থিত হন। কিন্তু শতভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত অনুপস্থিত থাকেন। সবাই জানতে চায়, যে দেশের একজন বিশিষ্ট মানুষের সম্মানে অনুষ্ঠান, সে দেশের রাষ্ট্রদূতের তো সেখানে গৌরবের সঙ্গে উপস্থিত থাকার কথা, অথচ তিনি অনুপস্থিত কেন? অবশ্য কারণ বুঝতে কারও কষ্ট হয় না। তাঁদের ধারণাটি আরও বদ্ধমূল হয় যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না।

অধ্যাপক ইউনূস একটা সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিন বছর আগে। তার নাম গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস। প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। বিভিন্ন দেশের কোম্পানি সরাসরি এর মাধ্যমে জনশক্তি আমদানির জন্য তাঁর কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কয়েকটি কোম্পানি অগ্রিম চাহিদাও দিয়ে রেখেছিল। সেসব দেশের সরকারও এই উদ্যোগে উৎসাহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত আমাদের সরকারের কাছ থেকে এ কাজ শুরু করার অনুমোদন পাওয়া যায়নি। তাই এই কোম্পানির কার্যক্রম কোনো দিন আর শুরু করা যায়নি। অটোমেকানিক, অটো-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য জাপানি একটা কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে ‘প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ খোলার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। সে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাও সহজ হবে কি না এখনো বলা মুশকিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার জন্য জার্মানির একটা বিখ্যাত কোম্পানি ২০ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করার সব প্রস্তুতি নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন, তাঁরা হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন।

তিন বছর আগে সৌদি রাজপরিবারের একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য প্রিন্স তালাল বিন আবদুল আজিজ আল সাউদ বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি চিঠি লেখেন যে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘আরব গালফ ফান্ডের’ বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভাটি বাংলাদেশে করতে চান। তাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে আরব দেশগুলোর সংবাদমাধ্যম উপস্থিত থাকবে। তিনি নিজে এবং আরব দেশগুলোর অন্যান্য গণ্যমান্য বক্তি এখানে উপস্থিত থাকবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করার জন্য তিনি আমন্ত্রণ করেন এবং অনুষ্ঠানের সামগ্রিক অনুষ্ঠানসূচি বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দেন। প্রিন্স তালাল অধ্যাপক ইউনূসের দীর্ঘদিনের বন্ধু। আরব গলফ ফান্ডের মাধ্যমে তিনি আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সাতটি দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের অনুকরণে ‘মাইক্রো ফাইন্যান্স ব্যাংক’ স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশ সরকার থেকে জানানো হয় যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সানন্দে তাঁর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন, তাঁর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কোনো বাংলাদেশি বক্তৃতা করতে পারবেন না। এই জবাবে প্রিন্স তালাল অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। তিনি অধ্যাপক ইউনূসকে জানান যে অধ্যাপক ইউনূসকে সম্মান জানানোর জন্যই সমগ্র অনুষ্ঠানটি তিনি বাংলাদেশে করতে চেয়েছিলেন। যদি অধ্যাপক ইউনূস উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে না পারেন, তাহলে তিনি বাংলাদেশে এই অনুষ্ঠান করবেন না। তিনি এই অনুষ্ঠান কুয়ালালামপুরে নিয়ে যান। ১ ডিসেম্বর, ২০০৯ তারিখে প্রিন্স তালাল এবং আরব বিশ্বের অন্য গণ্যমান্যদের উপস্থিতিতে এই অনুষ্ঠান কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হয়। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের সব আতিথেয়তা দেখিয়ে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন অতিরিক্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নাজিব অধ্যাপক ইউনূসকে সম্মানিত করেন। প্রধানমন্ত্রী নাজিবের পরিবারের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের অনেক আগের সম্পর্ক। ১৯৯৪ সালে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে অধ্যাপক ইউনূসকে ‘তুন আবদুর রাজ্জাক পুরস্কার’ দেওয়া হয়েছিল। তাঁর বাবার স্মৃতিতে এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে।

অধ্যাপক ইউনূস নিশ্চয়ই আনন্দিত হবেন, যদি তাঁর কোনো ভূমিকা দেশের কোনো সমস্যা সমাধানে কাজে লাগতে পারে। কিন্তু তাঁকে কাজে লাগাতে হবে তো।

প্রশ্ন: বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের ওপর কি নিপীড়ন করা হচ্ছে না?

উত্তর: গ্রামীণ ব্যাংকের জন্মলগ্ন থেকে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের নীতি নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ক্রমান্বয়ে এর পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে যেহেতু সদস্যরা নিজেরাই সঞ্চয়ের ব্যাপারে অভ্যস্ত ও আগ্রহী হয়ে গেছেন, সে কারণে পরে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের নিয়ম রহিত করা হয়। সেই সময় থেকে সব সঞ্চয় সম্পূর্ণরূপে ঐচ্ছিক। এখন গ্রামীণ ব্যাংকে কোনো বাধ্যতামূলক সঞ্চয় নেই। গ্রামীণ ব্যাংক গোড়া থেকেই সঞ্চয়ের ওপর ৮.৫% থেকে ১২% চক্রবৃদ্ধি হারে পর্যন্ত সুদ দেয়। (মাইক্রো ফাইন্যান্স রেগুলেটরি অথরিটি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর জন্য সঞ্চয়ের সর্বনিম্ন সুদের হার নির্ধারণ করে দিয়েছে ৬%)। সদস্যরা এর ফলে উৎসাহী হয়ে বেশি টাকা সঞ্চয়ে জমা করেন। যেমন, পেনশন ফান্ডে জমা করার ব্যাপারে তাঁদের খুবই উৎসাহ। কারণ, এ টাকায় ১২% সুদ পাওয়া যায়। তাঁদের জমা টাকা তাড়াতাড়ি বড় হয়। অনেকে এককালীন দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ে টাকা জমা রাখেন। সঞ্চয়ের টাকা যখন ইচ্ছা তখন তোলা যায়, জমা দেওয়ার পরদিনই তোলা যায়। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংক সদস্যদের মোট সঞ্চয়ের ব্যালান্স সাত হাজার কোটি টাকা। যেখানে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের কোনো ব্যাপার নেই, সেখানে নিপীড়নের মাধ্যমে সঞ্চয় নেওয়ার কথা ওঠে কী করে?

প্রশ্ন: ড. মুহাম্মদ ইউনূস কি গ্রামীণ ব্যাংককে নানা কৌশলে আয়কর থেকে মুক্ত রাখেননি; এবং সে জন্য ধিক্কৃত হননি?

উত্তর: সরকারের সহযোগিতায় অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের গরিব মহিলাদের স্বার্থে ব্যাংককে ২০১০ সাল পর্যন্ত আয়কর থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। অথচ ২০১০-১১ সালে তাঁর এই কাজের জন্য অনেকে তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন। সরকার ২০১০-এর পরে আর ট্যাক্স অবকাশের সুবিধা রাখতে সম্মত হয়নি। ২০১১ সালের মে মাসে গ্রামীণ ব্যাংকের আবেদন অগ্রাহ্য করে সরকার ১০ কোটি টাকা অগ্রিম আয়কর আদায় করে। অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক ছেড়ে যাওয়ার পর সরকার নতুন করে ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংককে কর অবকাশ দিয়েছে। অথচ এ নিয়ে সমালোচনার আর কোনো ঝড় দেখা যাচ্ছে না।

প্রশ্ন: অধ্যাপক ইউনূসের অবর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংক কি আগের চেয়েও ভালোভাবে চলছে না? তাঁর অনুপস্থিতিতে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার ও ঋণগ্রহীতাদের ওপর নির্যাতনও কি কমে যায়নি?

উত্তর: অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় যে উদ্ভাবনীমূলক বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসন ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন, তার ফলে ব্যাংকের দৈনন্দিন স্বল্পমেয়াদি পরিচালনায় কোনো ধস নামেনি। ধস নামার কথাও নয়। কারণ এখনো গ্রামীণ ব্যাকের সুদের হার, কর্মপদ্ধতি, ঋণ প্রদান, ঋণ আদায়সংক্রান্ত অধ্যাপক ইউনূস-প্রবর্তিত নিয়মাবলি—সবই হুবহু একইভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করা হচ্ছে। যাঁরা বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা করছেন, তাঁরা সবাই তাঁর হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাঁর সময়ে সুদের হার যা ছিল, বর্তমানেও তাই রয়েছে, ঋণগ্রহীতাদের ওপর নির্যাতন আগেও ছিল না; এখনো নেই। তাই কমার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভুল লোকের হাতে পড়ে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কিংবা ভুল নীতির জন্য পুরো ব্যবস্থাপনা ধসে পড়তে পারে।

প্রশ্ন: কোনো রকম আইনি ভিত্তি ছাড়া অধ্যাপক ইউনূস কি সামাজিক ব্যবসার নামে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছেন না?

উত্তর: সামাজিক ব্যবসা ও প্রচলিত ব্যবসার মধ্যে আইনগত কোনো পার্থক্য নেই। ব্যবহারিক পার্থক্য একটাই, তা হলো, প্রচলিত ব্যবসায় মালিক ব্যবসার মুনাফা নিজে গ্রহণ করে, আর সামাজিক ব্যবসায় মালিক ব্যবসার মুনাফা ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেন না। মুনাফার টাকা কোম্পানির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে ব্যবহূত হয়। এটি মালিকের সিদ্ধান্তের বিষয়। এখানে আইনের কোনো ভূমিকা নেই। সামাজিক ব্যবসার জন্য নতুন করে আইন করার কিছু নেই। প্রচলিত ব্যবসাসংক্রান্ত আইনই এর জন্য যথেষ্ট। সামাজিক ব্যবসার জন্য কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা সরকার দিক, এটাও অধ্যাপক ইউনূস চান না।

সামাজিক ব্যবসা অধ্যাপক ইউনূসের একটি আইডিয়া। যে কেউ নিজের উদ্যোগে সামাজিক ব্যবসা করতে পারেন। বাংলাদেশে ও বিদেশে অনেকেই সামাজিক ব্যবসা শুরু করেছেন। যেখানে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়াটাকে সম্পূর্ণ পরিহার করা হয়েছে, সেখানে ধোঁকাবাজির প্রশ্ন ওঠার সুযোগ কোথায়? বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো দেশের প্রচলিত আইন মেনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং পরিচালিত হচ্ছে।

প্রশ্ন: ৬০ বছর পার করে অতিরিক্ত ১১ বছর অবৈধভাবে চাকরি করে মোট কত টাকা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক থেকে নিয়ে গেছেন? তার হিসাব জনসমক্ষে তিনি প্রকাশ করছেন না কেন?

উত্তর: ৬০ বছর উত্তীর্ণ হওয়ার পর জুন ২৯, ২০০০ তারিখ থেকে মে ১২, ২০১১ তারিখ পর্যন্ত অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই ১১ বছরে তিনি মোট ৫২ লাখ ৯৪ হাজার টাকা বেতন-ভাতা ইত্যাদি বাবদ পেয়েছেন। এ টাকা থেকে বাড়িভাড়া এবং মূল বেতনের ৭.৫% হিসেবে মেইনটেন্যান্স খরচ কেটে রাখার পর, তিনি নগদ (টেক হোম পে) টাকা পেয়েছেন ৩৮ লাখ ৮২ হাজার টাকা। তাতে তাঁর মাসিক গড় নগদ বেতনের (টেক হোম পে) পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৯০০ টাকা।

প্রশ্ন: গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড চাইলেও অধ্যাপক ইউনূস নিজে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ আঁকড়ে রাখতে চান কেন? তাঁর যে বয়স হয়ে গেছে, এটা কি তিনি বোঝেন না?

উত্তর: অধ্যাপক ইউনূস বহুবার চেষ্টা করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থেকে অবসর নেওয়ার জন্য। কিন্তু বোর্ডের বাধার মুখে তিনি তাতে সফল হননি। সর্বশেষ তিনি কয়েক বছর আগে বর্তমান অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে একটা ব্যক্তিগত চিঠি লেখেন। তাতে তিনি তাঁর পদ থেকে সরে আসার ব্যাপারে তাঁর সহযোগিতা চান। মাননীয় অর্থমন্ত্রী তাতে মৌখিক সম্মতিও দেন। কিন্তু প্রস্তাবিত পথে তিনি অগ্রসর হননি। (চিঠিটি হুবহু কোনো কোনো পত্রিকায় ছাপানোও হয়েছিল)।

অধ্যাপক ইউনূসের আপত্তিটা তাঁর সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে নয়। তাঁর আপত্তিটা ছিল, যে কারণে তাঁকে সরে যাওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছিল সেটা নিয়ে। তিনি আদালতকে জানাতে চেয়েছিলেন যে তাঁর ৬০ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও তাকে তাঁর পদে বহাল থাকার ব্যাপারে বোর্ডের যে রকম আগ্রহ ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংকেরও তাতে তেমন সম্মতি ছিল। এগুলো নথিপত্রেই আছে। তিনি আদালতের কাছে এগুলো দেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মহামান্য আদালত তাঁর আবেদন শুনতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি তো চলে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীবই ছিলেন। কাজেই তাঁর পদে বহাল থাকার জন্য লড়াই করার প্রশ্নই ওঠে না। এটা ছিল প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরার একটা উদ্যোগ, যাতে এটা নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝি না হয়।

তারিখ: ৩০-০৮-২০১২
সূত্র: ইউনূস সেন্টার / প্রথম আলো
তারিখ: ৩১-০৮-২০১২
সূত্র: ইউনূস সেন্টার / প্রথম আলো